অমর একুশে বইমেলায় বাজছে বিদায়ের সুর। দু’দিন পরই পাঠক, লেখক, প্রকাশকের এ মিলনমেলার পর্দা নামছে। মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অনুবাদ সাহিত্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই শেষ প্রান্তে এসে লেখক আর পাঠকের মুখেও অনুবাদের বইয়ের প্রসঙ্গ উঠে আসছে বারবার। বিগত শতাব্দীর স্প্যানিশ ভাষার শ্রেষ্ঠতম লেখকদের একজন অক্টাভিও পাজ। সৃজনশীলতা ও মননের বিপুল ঐশ্বর্য তাঁর রচনার সম্ভার। অক্টাভিও পাজের রচনার সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় থাকলেও তাঁর সাহিত্যিক জীবনের আদ্যোপান্ত জানা নেই অনেকের। প্যারিস রিভিউতে প্রকাশিত অক্টাভিও পাজের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার এবার অনূদিত হয়েছে বাংলায়। সে অনুবাদ সংকলিত হয়েছে অনুবাদক বিপাশা চক্রবর্তীর ‘অক্তাভিও পাস : কথায় কথায় বহুদূর’ গ্রন্থে।
অমর একুশে বইমেলায় বইটি এনেছে জার্নিম্যান বুকস।
শুধু স্প্যানিশ সাহিত্য নয়; লাতিন, আফ্রিকান, জাপানি, কোরিয়ান, চীনের শিল্প-সাহিত্য অনুবাদ হচ্ছে। আরবি, উর্দু, ফারসি থেকে সরাসরি অনূদিত বইও প্রকাশিত হয়েছে এবারের মেলায়। তরুণ পাঠকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ অনুবাদ সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত। তাঁরা বলছেন, বিশ্বসাহিত্যের নানা অধ্যায়ের পাশাপাশি ভিনদেশি শিল্প-সাহিত্য জানা-বোঝার উপায় হলো অনুবাদের বই। সাহিত্যের পাঠক বইমেলা ঘুরে ফেরার পথে তাই অনুবাদের বই কিনতে ভোলেন না।
এবারের বইমেলার আরেকটি উল্লেখযোগ্য অনুবাদ গ্রন্থ হলো হুয়ান রুলফোর ‘পেদ্রো পারামো’। এটি মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে অনেক আগে বের হলেও এই প্রথম মূল বই থেকে অনূদিত হয়েছে বাংলায়। অনুবাদ করেছেন আনিসুজ্জামান। এ বছর উরুগুয়ের ঔপন্যাসিক হুয়ান কার্লোস ওনেত্তির একটি বইয়েরও অনুবাদ করেছেন তিনি। নাম ‘কুয়ো’। বইটি বাজারে এনেছে পাঠক সমাবেশ।
এবার ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে মেলায় এসেছে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ ও এতগার কোরেতের ‘দ্য গার্ল অন দ্য ব্রিজ’-এর অনুবাদ। অনুবাদক যথাক্রমে ইফতেখার আমিন ও মাহীন হক। অঁতোয়ান দ্য স্যান্ত একজুপেরির বইয়ের অনুবাদ করেছেন সাবিদিন ইব্রাহীম। এটিও এ প্রকাশনী থেকে এসেছে।
বইমেলায় মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে মশিউল আলমের দুটি বই- ‘নিরীহ’ ও ‘তলকুঠুরির কড়চা’। রুশ লেখক ফিয়োদর দস্তয়েভস্কির মূল বই থেকে অনুবাদ করেছেন তিনি। ‘তলকুঠুরির কড়চা’ উপন্যাসে দার্শনিক, নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে।
রামকৃষ্ণ পাল অনুবাদ করেছেন মার্থে সাফেনার ‘স্পাই গার্ল’। এটি এসেছে শব্দশৈলী থেকে। গ্রন্থিকের স্টলে পাওয়া যাচ্ছে আঁলা বাদিউ, ম্যাক্সিম গোর্কি ও গালিনা নেবেদেভার বিভিন্ন সাহিত্যের অনুবাদ। অনুবাদ সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারজয়ী সালেহা চৌধুরী এ বছর অনুবাদ করেছেন নোবেলজয়ী লাতিন ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের গল্প। এ গল্প সংকলন পাওয়া যাবে ক্রিয়েটিভ ঢাকার স্টলে। জাপানের কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির গল্পের অনুবাদ পাওয়া যাবে চলন্তিকায়।
এবার পাঠক সমাবেশ থেকে এসেছে বেশকিছু অনুবাদের বই। এ প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিনের ‘বোর্হেস ও মারিও-আলাপে পরস্পর’ নামে সাক্ষাৎকারের বই। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে এসেছে ইংরেজ কবি-ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডির ‘দ্য মেয়র অব দ্য ক্যাস্টারব্রিজ’, চার্লস জন হাফ্যাম ডিকেন্সের ‘দ্য পিকউইক পেপার্স’, সময় প্রকাশন থেকে এসেছে বার্ট্রান্ড রাসেলের রচনা সমগ্রের অনুবাদ। এটি অনুবাদ করেছেন বাংলা একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া।
উমা ত্রিলোকের লেখা ‘অমৃতা-ইমরোজ : অ্যা লাভ স্টোরি’ লেখকের অনুমতি ও আলাপ সাপেক্ষে অনুবাদ করেছেন দিলওয়ার হাসান। ‘অমৃতা-ইমরোজ :একটি প্রেমকাহিনি’ নামে বইটি প্রকাশ করেছে বাতিঘর।
২০১৭ সালে অনুবাদে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারজয়ী নিয়াজ জামান বলেন, ‘এক সময় বদনাম ছিল, আমাদের দেশে ভালো অনুবাদক নেই। কিন্তু এখন তরুণদের মধ্যেও অনেক ভালো অনুবাদক রয়েছেন। ভালো অনুবাদক হতে গেলে তাঁকে মূল বইয়ের লেখার মধ্যে একদম ডুবে যেতে হবে। তাড়াহুড়া করে অনুবাদ হয় না। তারপর নিজের ভাষায় যতটা সুন্দর করে বলা যায়, অনুবাদকর্মটি তত ভালো সাহিত্যমানের হয়।’ ভিনদেশি অনেক গবেষক-লেখক এখন নিজেরাই বাংলা ভাষা শিখে বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যগুলো বই আকারে প্রকাশ করছেন জানিয়ে নিয়াজ জামান বলেন, ‘তাঁরা যখন আমাদের বইয়ের এসব অনুবাদ তাঁদের ভাষাভাষী মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছেন, তখন আমাদের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।’
অনুবাদ সাহিত্যের পাঠকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্বসাহিত্যের ক্ল্যাসিক অনুবাদ হিসেবে যে বইগুলো মেলায় বিক্রি হচ্ছে, তার অধিকাংশই মানহীন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক ফাহমিদা হক বলেন, কিছু অনুবাদের বই হাতে নিয়ে দেখলাম, গুগল ট্রান্সলেট করে ছেপে দিয়েছে।
এ বিষয়ে অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিন বলেন, অনুবাদকের দক্ষতা, কোন সাহিত্যটি অনুবাদের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে তা নিয়ে অধিকাংশ প্রকাশকই সচেতন নন। বাণিজ্যিক দিকটি মাথায় রেখে তাঁরা গুণগত মান বিচার করছেন না। বাংলাদেশে অনুবাদকর্ম যেন এক অবহেলিত শিল্প। অনুবাদের গুণগত মান বিচারের লোকবল নেই। তিনি বলেন, অনুবাদ ভীষণ কঠিন কাজ। তবে সেরা কাজ অনুযায়ী তাদের পারিশ্রমিক নিতান্ত কম। অনেক প্রকাশক অনুবাদককে সঠিক পারিশ্রমিক দিতে পারেন না।
সময় প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ বলেন, কপিরাইট আইন অনুযায়ী, মূল লেখক বা প্রকাশকদের অনুমতি নিতে হয় অনুবাদক, প্রকাশককে। সে ক্ষেত্রে মূল লেখক বা প্রকাশকরা এত অর্থ দাবি করেন যে, তখন আর এগোনো সম্ভব হয় না। ভালো সাহিত্যের অনুবাদ তাই এত কম।