বিপাশা চক্রবর্তী:
এদেশের পুরুষ কামুক না ধর্ষক? সত্যিকারে কাম বা যৌনতা কত পার্সেন্ট এইদেশের পুরুষ জানে? বাংলাদেশে ধর্ষণ বা নারীর প্রতি অন্যায় যৌন আচরণের খবর পড়ে পড়ে যেকোনো বাঙালি নারীর মনে এই প্রশ্ন জাগতে পারে। আমার মনে তো এই প্রশ্ন আসছে।
আচ্ছা, প্রিয় নারীর সাথে (অবশ্যই তার সম্মতিতে) সংগম কতখানি আনন্দ, কতটুকু সুখ পাওয়া যেতে পারে, এটা কয়জন বাঙ্গালী পুরুষ জানে? এইখানে আরো একটা প্রশ্ন আছে, অপরপক্ষের কোন সাড়া টাড়া ছাড়া কীভাবে একজন পুরুষ উত্তেজিত হয়? জোর করে ধস্তাধস্তি করে আসলে কেমন সুখ পায়? (এর উত্তর একজন ধর্ষক দিতে পারবে, আমি পারবো না) ।
শুধু বাঙালি বাঙালি করছি কেন? সভ্য, স্বশিক্ষিত বাঙালি পুরুষও আছে। যদিও তাদের সংখ্যা কম। এই কমটাকে বাড়ানো যায় না?
ধর্ষণ শুধু বিকৃত রুচির পুরুষের দ্বারাই সম্ভব। এমন বিকৃত রুচির পুরুষ একটা সমাজে কতজন থাকতে পারে? মানসিক সমস্যা বা অসুস্থতায় কতজন আক্রান্ত হতে পারে। তাহলে কি আমাদের সমাজে গোপনে গোপনে এমন কোন অবক্ষয় বাসা বেঁধে ফেলেছে যে আর নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না?
একদিকে আবেগ, ভালবাসা, প্রেমময় যৌন সম্পর্ক আরেক দিকে ধর্ষণের মতো পাশবিক নির্যাতনের নিষ্ঠুরতা। কোনটা বেশি উপভোগ্য? ধর্ষণের মধ্য দিয়ে একজন পুরুষ নিজেই নিজেকে বঞ্চিত করছে না সত্যিকারের আবেগময় যৌন আনন্দ থেকে?
হিউম্যান নেচার তো সবখানেই এক। ধর্ষণ তো সব দেশেই হয় কম আর বেশি। এভাবে কি নিজেকে সান্ত্বনা দেয়া যায়? জোর করে সেক্স করা কি পুরুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির মধ্যে পড়ে? কী করবো? চুপচাপ থাকবো? কিছুই কি করার নাই? আমাদের তুলনায় এগিয়ে থাকা উন্নত সমাজের কথা ভাবলে কি যুক্তি আসতে পারে? ধর্ষণ কি আন্তর্জাতিক সমস্যা? সম্ভবত না, এটা বর্তমানে আমাদের জন্য স্থানীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ধর্ম আগেই অকার্যকর হয়েছে। আইনের প্রয়োগ নেই। আর কত নারী ধর্ষিত হলে এটাকে বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা হিসেবে ধরা হবে?
ধরে নিলাম এখন অনেক বেশি রিপোর্ট হয়। মেয়েদের সাহস বাড়ছে, লজ্জা কমছে। এই জন্য তারা পুলিশে খবর দেয়, মিডিয়াকে জানায়। আর এখন তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে ব্যাপারটাকে আরো বেশি চর্চা করা হয়। তার মানে আগেও ধর্ষণ হতো। কম না বেশিই হতো মনে হয়। খালি খবর জানতাম না। সমাজ ও সময়ের পরিবর্তন- বিবর্তনের সাথে সাথে তো মানুষেরও উন্নয়ন হয়। মানুষ আরো বেশি সভ্য হয়। এতদিন তো এমনটাই জানতাম।
তাহলে? যতদিন যাচ্ছে আমাদের সমাজে ধর্ষণ কি একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হচ্ছে না? আমরা কি তাহলে এখন রেপ কালচারে বসবাস শুরু করেছি? ভবিষ্যতে আমরা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে আর গর্ব করতে পারবো তো?
ধর্ষণ তেমন বড় কিছু না, স্রেফ সামান্য শারীরিক ক্ষতি বা আঘাত! আঘাতের মাত্রা বুঝে দায়ী ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া উচিত। এইভাবে আমরা ধর্ষণ বা রেপকে নরমালাইজ করলাম!
তারপর দিন শেষে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় হঠাৎ আমার বোনের কথা, মেয়ের কথা, স্ত্রীর কথা মনে পড়লো। আমি নারী হওয়ায় আমি আমার নিজের কথাই ভাবলাম। নাহ, সামথিং ইজ রং। মনে হলো, কোথাও কিছু একটা চেঞ্জ করতে হবেই।
কিন্তু ধর্ষণের পর খুন করা? মারতে মারতে মেরে ফেলা। নির্মম নির্যাতন অত্যাচার করে হত্যা কেন করে পুরুষ। বাঙালি পুরুষ এত নিষ্ঠুর। খারাপ লাগে না ভাবতে? একবার ভাবছেন, এই মাত্র যে শরীরটাকে আনন্দের জন্য ব্যবহার করছেন, সেই শরীরটাকেই আবার একটু পর ক্ষত-বিক্ষত করে হত্যা করছেন। বীর্যপাত। ব্যস। তারপর, হায় হায়, একী করলাম! এখন জানাজানি হবে। থানা পুলিশ হবে। তারচেয়ে দে শালীরে মেরে!
এটাই তো মনে হয়, ধর্ষণের পরে ধর্ষকের সাইকোলজি! এখন কথা হলো যৌনতাটাকে আমরা মাথায় তুলে তুলে এমন জায়গায় নিয়ে গেছি যে, আসলে পুরাটাই অনেক জটিল, কঠিন, আরাধনার ব্যাপার হয়ে গেছে। পুরাটাই অবদমনের ফসল। এই ফসল এতোটাই পচা আর ভয়ংকর যে, একটা দেড় দুই বছরের বাচ্চা মেয়ে (কোন কোন ক্ষেত্রে আরো কম) দেখলেও প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ যৌন কামনা অনুভব করে।
কখনো এর বিপরীতটা ভেবেছেন? একজন নারী কি এমন অনুভব করে ছোট একটা বাচ্চা ছেলেকে দেখে? করে না, বায়োলজিক্যালি সে এইটা করবে না। পুরুষ কেন করে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাকে কী শিখিয়েছে এতোকাল? কুমারী, অল্প বয়স্ক নারী এদের সাথে মিলনে বেশি আনন্দ? কিছু পুরুষ কুমারী আর অল্পবয়স্কদের তালিকায় দুই/তিন বছরের শিশুও যোগ করে নিচ্ছেন। পশুরা মিলিত হয় প্রজননের উদ্দেশ্যে। বংশবৃদ্ধির জন্য মিলন মৌসুমে। আর মানুষ কেবল বংশবৃদ্ধির জন্য না, আনন্দের জন্যও মিলিত হয়। ধর্ষণ বলতে পশু সমাজে কিছু নাই। কিন্তু মানুষের সমাজে আছে। আমাদের সমাজে প্রবল আকারে আছে।
আমাদের চেয়ে উন্নত সমাজে কী অবস্থা? এই তাদের নতুন নতুন আবিষ্কার, গবেষণা, রাজনৈতিক-কূটনীতিক লড়াই, নানারকম সৃষ্টিশীল নির্মাণ, শৈল্পিক বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড, খেলাধূলা, প্রযুক্তি (যেগুলো আমরা কিছু কিছু আমদানিও করি) এইগুলো কি এই জঘন্য বিকৃত যৌন চাহিদাকে ভুলে থাকার জন্য তাদের সাহায্য করে না? আর যৌনতাটাকে সহজভাবে নেওয়া জীবন যাপনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে নেওয়া। ছেলেমেয়েদের শৈশব-কৈশোরে যৌনতার সঠিক শিক্ষা দেয়া এইসব? কেউ কি লিখে গেছে সেক্সচুয়ালিটির নিয়ম? আমরাই তো লিখি সব। আমরা মানে মানুষরা।