ক্রিস্টোফার মার্লো শেক্সপিয়রের সহ-লেখক ছিলেন!

তর্কটা অনেক দিনের। এর বিস্তারও কম নয়। বহুলেখক-গবেষকের পর্যবেক্ষণ, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষনের ডালপালায় তর্কটি বিস্তার লাভ করেছে। তর্কের উৎসে প্রাণ সঞ্চার করেছে মূলত এই তথ্য যে ক্রিস্টোফার মার্লো ছিলেন শেক্সপিয়রের সমসাময়িক, তারচেয়েও বড় কথা তারা বন্ধু ছিলেন। দুজনই ছিলেন নাটকের অভিন্ন জগতের বাসিন্দা। কিন্তু অভিন্ন জগতের বাসিন্দাতো বেন জনসনও ছিলেন, কিন্তু শেক্সপিয়রের সাথে তাকে জড়িয়ে এই তর্কটা তৈরি হয়নি, হলো মার্লোকে নিয়েই। এর কারণও আছে। কারণগুলো ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই বহু গবেষকের আলোচনায় উঠে এসেছে। সম্প্রতি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস শীঘ্রই শেক্সপিয়রের নাটকগুলি নিয়ে একটি নতুন সমালোচনামূলক সংস্করণ প্রকাশ করতে যাচ্ছে। সেই সংস্করণটির নাম দা নিউ অক্সফোর্ড শেক্সপিয়র। এটির অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ক্রিস্টোফার মার্লোকে শেক্সপিয়রের সহ-লেখক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান। তিনি ‘ষষ্ঠ হেনরি’ নাটকের তিনটি অংশেই শেক্সপিয়রের সহ-লেখক ছিলেন।

যুগ যুগ ধরেই সাহিত্য গবেষকরা শেক্সপিয়রের রচনায় মার্লোর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে আসছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ক্রিস্টোফার মার্লো ও শেক্সপিয়র একই ব্যাক্তি ছিলেন বলেও অবহিত করেছিলেন।

এই জন্য ধন্যবাদ জানাতে হয় সেই সমস্ত উদ্যোক্তাদের যারা বছরের পর বছর ধরে শেক্সপিয়রের শব্দভান্ডার, নৈতিক দর্শন ও কাব্যিক শৈলী নিয়ে গাণিতিক বিশ্লেষণ এবং সাহিত্যে ছাত্রবৃত্তি দিয়েছেন। অবশেষে এভাবেই একদল আন্তর্জাতিক গবেষণা-দল সকল রহস্যের সমাপ্তি টানলেন।

একটি বহুল প্রচলিত ধারণা হচ্ছে এই যে, শেক্সপিয়র আদৌ মিশুক ছিলেন না। ১৯৮৬ সালে অক্সফোর্ড যখন জানালো শেক্সপিয়রের আটটি নাটকের উপাদানে অন্য লেখকদের অবদান ছিলো তখন অনেক মানুষই ক্ষিপ্ত হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের পর গবেষণার জন্য নতুন নতুন বৃত্তি, কৌশল ও প্রয়োজনীয় সম্পদ ও আধুনিক প্রযুক্তি বিনিয়োগের ফলেই আজ পরিষ্কার হলো যে, তখন শেক্সপিরের নাটকে অন্য লেখকদের অবদানকে খাটো করা হয়েছিল।

সাহিত্য অনুরাগীদের জন্য শেক্সপিয়র ও মার্লোকে ঘিরে পান্ডিত্যপূর্ণ বিতর্কে নিয়ে অনেক অজানা কথা আজ প্রকাশিত হলো। কে এই ক্রিস্টোফার মার্লো?

ক্রিস্টোফার মার্লো ছিলেন শেক্সপিয়রের সমসাময়িক এক কবি ও নাট্যকার। তিনি এলিজাবেথীয় যুগের কবি ও নাট্যকার হিসেবে বেশ সমাদৃত ছিলেন। বছরের পর বছর ধরে চলমান অনেক প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় তার ও শেক্সপিয়রের মধ্যে যোগাযোগের প্রমাণ খুঁজে পাওয়া গেছে। এ দু’জনেই একে অপরকে চিনতেন ও জানতেন। তারা একই ক্ষেত্রে কাজও করেছেন।

যদিও তাদের সম্পর্কের ব্যাপ্তিতে সব সময়ই একটি যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। কেউ কেউ মনে করেন যে, শেক্সপিয়রের উপর মার্লোর ব্যাপক প্রভাব ছিল। অন্য আরেক দলের দাবি, আসলে মার্লোই শেক্সপিয়র। এরকম ধারণার পিছনে যে কারণগুলি অনুমান করা হয়, তাহলো মার্লো ১৫৯৩ সালে ২৯ বছর বয়সে হঠাৎ করেই মারা যান, তিনি ছুরিকাহত হয়ে মারা যান। সম্ভবতঃ গুপ্তচরবৃত্তির কলঙ্কের ফাঁদে পড়েই এরকম মৃত্যু হয়েছিল। হ্যাঁ, একটি গুপ্তচরবৃত্তি কলঙ্ক। এই অনুমানের প্রবক্তরা যে যুক্তি তুলে ধরেন তাহলো, মার্লো শেক্সপিয়রের মাত্র দু’মাস আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এবং মার্লোর মৃত্যুর দু’মাস পরে সাহিত্যে শেক্সপিয়রের নাম দু সপ্তাহকাল ধরে কম-বেশী উচ্চারিত হওয়া শুরু করে। তবে সার কথা হলো বাস্তবে মার্লো একজন মানুষ যিনি মৃত্যুর একটি মনগড়া কাহিনী দাঁড় করিয়ে ছদ্মনাম শেক্সপিয়র গ্রহণ করেছিলেন।

কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো শেক্সপিয়র ও মার্লোর লেখার ধরন আলাদা ছিল। এই আলাদা ধরন নিয়ে আর্হেন্তিনীয় বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেস তার The Enigma of Shakespeare প্রবন্ধে খুবই যুক্তিগ্রাহ্য কিছু উদাহরণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছিলেন বহু বছর আগে। যদিও ‘ষষ্ঠ হেনরী’ নাটকটির লেখক হিসেবে মার্লো বিষয়ে কোনো মন্তব্য তিনি করেননি। এটা ঠিক যে তাঁদের দু’জনের লেখার শব্দ ভান্ডার ছিল ভিন্ন। শব্দের ব্যবহারের শৈলীতেও বেশ পার্থক্য ছিল। যেমনটা বোর্হেস তার লেখাতে স্পষ্ট করেই বলেছেন। অনেক গবেষক আজ বলছেন, যে দু’জনের মধ্যকার পার্থক্যের বিষয়ে তাঁদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। আর এতেই প্রমাণিত হয় যে, তারা দু’জনেই ভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন।

বর্তমানে পাঁচটি ভিন্ন দেশের ২৩ জন গবেষকের একটি যৌথ দল বলেছেন যে, তারা শেক্সপিয়রের শব্দ ভান্ডারের সকল শব্দের সাথে এলিজাবেথীয় যুগের নাটক ও সাহিত্যের তুলনা করেছেন। তারা এক একজন লেখকের সমস্ত সাহিত্যকর্মে লেখার ধরন ও বিশ্লেষণ করে দেখছেন সেখানে কোন সহ-লেখকের উপস্থিতি আছে কি না।

শেক্সপিয়রের সাহিত্যের বিশাল জগতে প্রবেশ করে এখন গবেষকরা মনে করেন তারা এখন বেশ আত্মবিশ্বাসী। আগের যে কোন সময়ের তুলনায় এখন অনেক অজানা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারছেন তারা। যে প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য যুগ যুগ ধরে অনেক সাহিত্যপ্রেমী অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছিলেন।

এই গবেষক দলের সব থেকে বড় সাফল্য ‘ষষ্ঠ হেনরি’ ধারাবাহিক নাটকের উপর গবেষণা। এর মাধ্যমেই তারা আজ দাবি করছেন যে তাদের কাছে বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, এই সাহিত্যকর্মে মার্লোর সহযোগিতা ছিল। তারা এই নাটকের শব্দের ব্যবহারের উপর গাণিতিক ধারা ব্যবহার করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন।

উদাহরণস্বরূপ, কোন কিছুর বৈশিষ্ট্য ও নিদর্শনকে গবেষকরা অভিহিত করেছেন “শেক্সপিয়র-প্লাস” হিসেবে। কতগুলি শব্দ যেমনঃ “beseech”, “spoke” কিংবা “tonight” ইত্যাদি শেক্সপিয়রের অনেক সাহিত্যকর্মে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। আর এই শব্দগুলি মার্লোর অনেক লেখা মধ্যে দেখা যায়।

“শেক্সপিয়র-প্লাস” বলতে গবেষকরা বুঝিয়েছেন শব্দ ব্যবহারের পৌনঃপুনিকতা বা ইংরেজিতে যাকে বলা যেতে পারে ফ্রিকোয়েন্সি। অর্থাৎ, কতক্ষণ পর পর একটি নির্দিষ্ট শব্দের প্রয়োগ করা হয়। যেমনঃ প্রথম দিকের সমস্ত নাটকে “tonight” শব্দের সর্বোচ্চ ১৬০০ বার পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছিল। যে কেউ এই শব্দগুলি ব্যবহার করতে পারে। এগুলি শেক্সপিয়রের উদ্ভাবিত কোন শব্দ না। কিন্তু গবেষকরা বলেন, শেক্সপিয়র “tonight” শব্দটি এত বেশিবার ব্যবহার করেছেন যে ঐ সময়ে ২০ বছরের মধ্যে আর কোন নাট্যকার তা করেননি।

দলটি উল্লেখ করেছে যে, তারা নির্দিষ্ট কিছু শব্দ ব্যবহার ও শব্দের সমন্বয়ের মাধ্যমে বের করেছেন সেগুলি কে কী লিখেছেন। তারা মার্লোর বহুল ব্যবহৃত শব্দগুলি যেমনঃ “glory droppeth” অথবা “shape thou” শেক্সপিয়রের লেখায় খুঁজে পেয়েছেন। গবেষকদের কাছে এ সংক্রান্ত গাণিতিক প্রমাণাদি রয়েছে। যদিও অনেক গবেষকই আছেন যারা শেক্সপিয়র ও মার্লো একসাথে কাজ করেছেন এ ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করেন। পক্ষান্তরে, তাঁরা মনে করেন, শেক্সপিয়র যখন নাটকে প্রথম কাজ করা শুরু করলেন, তখন মার্লো নাট্যজগতে বেশ পরিচিত ছিলেন। ফলে, তাঁর নাটকের দ্বারা অভিনেতারা বেশ প্রভাবিত ছিলেন।

শেক্সপিয়র বিশেষজ্ঞ ক্যারোল রাটার বলেন, শেক্সপিয়র যখন একটি কোম্পানীতে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন, যেখানে তিনি আগে থেকে একজন অভিনেতা হিসেবে কাজ করছিলেন, তখন তিনি নাট্যকারের চেয়ে অভিনেতাদের সাথে মেলামেশা বেশী করেছিলেন। যে কারণে নাট্যকার হিসেবে মার্লোর সাথে তেমন পরিচয় না থাকলেও মঞ্চে মার্লোর সমর্থক ও ভাষার বেশ প্রাধান্য ছিল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দি নিউ অক্সফোর্ড শেক্সপিয়র-এ প্রকাশ হতে যাওয়া এই তথ্যের ফলে এখন থেকে ‘ষষ্ঠ হেনরি’ বা ‘হেনরি দ্য সিক্সথ’ নাটকের তিনটি খন্ডের শিরোনাম পাতায় শেক্সপিয়রের সাথে সহ-লেখক হিসেবে ক্রিস্টোফার মার্লোর নামটিও কি লিখতে হবে? সব কিছু সম্পর্কে আগামীতে অনেক কিছুই জানা যাবে। শুধু অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছরে প্রকাশিত হতে যাওয়া দি নিউ অক্সফোর্ড শেক্সপিয়র-এর জন্য।

কে জানে, ভবিষ্যতে শেক্সপিয়র গবেষকরা আরো নতুন নাটকীয় তথ্য হয়তো আমাদের সামনে উপস্থাপন করবেন। তবে এটাও ঠিক,এসব গবেষণা আলোচনা সমালোচনার মাধ্যমেই শেক্সপিয়র জীবিত থাকবেন যেমনটি এখনো আছেন।

তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, সায়েন্স এলার্ট ডটকম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart