জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গম: অর্ধনারীশ্বর অথবা তৃতীয় প্রকৃতি

গ্রীক পুরাণে কথিত আছে, কেরিয়াতে কোনো এক ছোট নদীতে বাস করত অতি সুন্দরী এক জলপরী । নাম সালমেসিস। সে প্রেমে পড়ে যায় হারমিস ও আফ্রোদিতির পুত্র, রুপবান যুবক হারমাফ্রোডিটাসের। প্রণয়কাতর সালমেসিস দেবতাদের কাছে প্রার্থনা শুরু করল । তার এই নিবিড় প্রেমকে চিরন্তন করতে করুণা ভিক্ষা করল । দেবতারা যেন হারমাফ্রোডিটাসের সঙ্গে তাকে চিরকালের জন্য মিলিত করে দেন । দেবতারা তার প্রার্থনা শুনলো – তারা তাদের দু’জনকে জুড়ে দিলো একই শরীরে। তারপর থেকে এই প্রাণীটি হয়ে গেল উভলিঙ্গ।

এদিকে উপনিষদ বলছে, সৃষ্টিকর্তার মনেও নাকি শান্তি ছিল না। সেই পুরাণ পুরুষ ভীষণ একা বোধ করছিলেন। কোন সুখ, আনন্দ ছিল না তাঁর । স বৈ নৈব রেমে, যস্মাদ একাকী ন রমেতে। আনন্দের জন্য শেষমেশ নিজেকে দু’ভাগে ভাগ করে ফেললেন নিজেকে- নারী-পুরুষ, অর্থাৎ জায়া-পতি। পরবর্তী শাস্ত্রকারদের মনে উপনিষদের এই বিমূর্ত কল্পনা নিশ্চয়ই এমনভাবে ক্রিয়া করেছিল যার জন্য তারা নির্দেশ দিয়েছিলেন, একটি পুরুষ বা একটি নারী আলাদাভাবে কখনোই সম্পূর্ণ নয়। একটি পুরুষ বা একটি নারী মানুষরূপে অর্ধেক মাত্র। এই কারণেই কি পুরাণ-পুরুষ নিজেকে দ্বিধা ছিন্ন করছিলো? ছিন্ন দুই ভাগের মধ্যে পরস্পরের মিলিত হবার, সম্পূর্ণ হবার টান ছিল কি?

আমরা দেখতে পাই, মহাভারতের লেখক সম্পূর্ণ মনুষ্যরূপে নমস্কার করেছিলেন- ‘নারী-নরশরীরায়’ বলে। বিনত হয়েছিলেন, ‘স্ত্রী-পুংসায় নমো’স্তুতে’ বলে। পূর্ণাঙ্গ মানুষ রূপের এই বিমূর্ত শিব ভাবনার আদি রূপ খুঁজে পাওয়া যায় বৈদিক যম-যমীর মধ্যে । মাঝের চিন্তাটা আসে উপনিষদ পুরুষের ইচ্ছায়। আর শেষটা পাব বিভিন্ন পুরাণের অর্ধনারীশ্বর কল্পনায় ।

দেখা যাক, ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ কী বলছে। এখানে বলা হয়েছে , অর্ধনারীশ্বরের জন্ম নাকি ব্রহ্মার রোষ থেকে। আগুনপানা তাঁর চেহারা। ‘অর্ধনারী-নরবপুঃ’। জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই মিথুনীকৃত মূর্তিকে ব্রহ্মা আদেশ দিলেন- ‘তুমি নিজেকে দ্বিধা বিভক্ত কর’। বলা মাত্রই সেই মিথুন দেবতা বিভক্ত করলেন নিজেকে। সৃষ্টি হলো পৃথক স্ত্রী, পৃথক পুরুষ। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে , ঋষির কল্পনা এখানে এক থেকে দুই হচ্ছে আবার এক হবার টানে দুই থেকে এক হচ্ছে। অর্ধনারীশ্বরকে নিয়ে বেশ জনপ্রিয় একটি কিংবদন্তী প্রচলিত আছে, সেটি অনেকটা এরকম।

“একদা দেবতা ও ঋষিগণ কৈলাসে হর-পার্বতীকে প্রদক্ষিণ করছিলেন। ঋষি ভৃঙ্গী ছিলেন শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি পার্বতীকে অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র শিবকে প্রদক্ষিণ করতে থাকেন। ঋষি ভৃঙ্গীর এই স্পর্ধিত উপেক্ষায় পার্বতী অপমানিত বোধ করেন এবং ক্রুদ্ধ হয়ে ভৃঙ্গীকে নিছক চর্ম-আবৃত কঙ্কালে পরিণত করেন। ফলে ভৃঙ্গী দু-পায়ে দাঁড়াতেও অক্ষম হয়ে পড়েন। ভক্তের প্রতি এমন অবস্থা দেখে শিবের মায়া হয় । তিনি তাই ভৃঙ্গীকে তৃতীয় পদ দান করেন। কিন্তু পার্বতীর সম্মান রক্ষার্থ স্বয়ং পার্বতীর সঙ্গে একদেহ হয়ে তিনি অর্ধনারীশ্বর-রূপে অবস্থান করেন, যাতে ভৃঙ্গী পার্বতীকেও প্রদক্ষিণ করতে বাধ্য হন”।

পৌরাণিক উপাখ্যানে অর্ধনারীশ্বরের সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা আছে কালিকা পুরাণে (নবম দশম শতাব্দী)। যেখানে ফুটে উঠেছে সেই গৌরী মেয়েটির আকুলতা। যে মেয়ে প্রিয়তমের দিকে তাকালেই প্রিয়তমের মরমে ছায়া পড়ে। হ্যাঁ, মহাদেবের বুকে নারীর ছায়া দেখে ব্যাকুলা হলেন গৌরী। তার মনে হলো, অন্য কোনো রমণী বুঝি শিবের হৃদয় জুড়ে আছে। মহাদেব তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন, ঐ ছায়া অন্য নারীর নয়, ওটি গৌরীরই ছায়া। শিবের আশ্বাস আর নিজের বিশ্বাস থাকার পরেও মন থেকে তার ভাবনা গেল না। যদি সত্যি অন্য কোনো নারী শিবের হৃদয় জুড়ে বসে! গৌরি কাতর হয়ে বললেন- ‘আমি তোমাকে আরও কাছে পেতে চাই, স্বামী! সাহচর্যে ঠিক তোমার ছায়ার মতো। এমন দূরে, আলাদা করে নয়। তোমার সমস্ত অঙ্গের পরমাণুর স্পর্শ চাই আমি, যাতে তুমি বাঁধা পড়বে আমার নিত্য আলিঙ্গনে’। – সর্বগাত্রেণ সংস্পর্শং নিত্যালিঙ্গণ বিভ্রমম। (কালিকাপুরাণ, ৪৫।১৪৯-১৫০)

শিব বললেন – ‘তবে তাই হোক’।

মুহূর্তেই ঈশ্বর-ঈশ্বরী পরস্পরের অর্ধেক শরীর হরণ করলেন। ধরা দিলেন অর্ধনারীশ্বর মূর্তিতে । ঋষিরা স্বস্তিবাচন করলেন। প্রণাম করলেন ‘নমঃ স্ত্রীপুংসরুপায়’।

পুরাণে পুরাণে যে গল্পই থাকুক। কথা কাহিনীর বিস্তারে অর্ধনারীশ্বর মূর্তির যতই রসোল্লাস থাক না কেন, এর নিশ্চয়ই কোন দার্শনিক মূল্য থাকতে পারে ।

মহাকবি কালিদাস তাঁর মহাকাব্য ‘রঘুবংশ’-এর সূচনায় লিখেছিলেন-

“বাগর্থাবিব সম্পৃক্তৌ বাগর্থ-প্রতিপত্তয়ে।

জগতঃ পিতরৌ বন্দে পার্বতী পরমেশ্বরৌ।।”

কালিদাস বলছেন, শব্দ এবং অর্থকে যেমন পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা করা যায় না, তেমনি জগতের জননী এবং জনক-পার্বতী ও মহেশ্বরও সতত পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত।

বায়ুপুরাণ এবং ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে দেবাদিদেবের অর্ধাঙ্গে নর রূপে আবির্ভাব-প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে। পদ্মপুরাণে (সৃষ্টিখণ্ড, ৫৬।৫৫-৫৬) বলা হয়েছে যে, ব্রহ্মার যজ্ঞ-সমাপ্তির পর শিব ও পার্বতী ব্রহ্মা-পত্নী সাবিত্রীকে যজ্ঞস্থানে আনয়ন করতে গেলে সাবিত্রী শিব ও পার্বতীকে একদেহ হওয়ার বরদান করেছিলেন ।

“শরীরার্ধে চ তে গৌরী স্থাস্যতি শঙ্কর।

অনয়া শোভসে দেব ত্বয়া ত্রৈলোক্যসুন্দর।।”

অর্ধনারীশ্বর বেশে শিব; একাদশ শতাব্দীর ব্রোঞ্জনির্মিত চোল ভাস্কর্য।

ভারতীয় পুরাণগুলিতে আরও কথিত আছে, পুরাকালে ব্রহ্মা নাকি নর-নারীর মিথুন সৃষ্টি করেছিলেন- দৈবমিথুন, মনুষ্যমিথুন শত শত যুগল মূর্তি। অর্ধনারীশ্বর মূর্তি এই ধারণার মূর্তরূপ। বলা যায়, পৌরাণিকদের মধ্যে সৃষ্টি রহস্য নিয়ে যে দার্শনিক সমাধান খোঁজার চেষ্টা, সেটা লুকিয়ে আছে এই অর্ধনারীশ্বর মূর্তিকল্পে । সৃষ্টির প্রতিমূর্তি জগজ্জননী দুর্গা এবং সংহারের প্রতিরূপ শিব। এই স্ববিরুদ্ধ দুই তত্ত্ব যেন তত্ত্বগতভাবে এক মূর্তিতে ধরা দিল । যদিও বা ধরা দিল কিন্তু তার রূপ দেয়া কঠিন হয়ে পড়ল। ভবিষ্যতের শিল্পী-ভাস্কররা যাতে অসুবিধায় না পড়েন , তাই ভেবে সম্ভবত মৎস্যপুরাণ অর্ধনারীশ্বরের একটি রূপকল্প তৈরি করে দিলেন। পাঠকদের কল্পনার সুবিধার্থে এখানে সেই বর্ণনাটি দেয়া হলো।

পুরাণ বলছে- দেবাদিদেবের অর্ধেকটাই নারীরূপের শোভা। মহাদেবের মাথায় আছে প্রতিপদের চাঁদজড়ানো জটা আর সীমন্তনী উমার কপালে তিলক। অর্ধনারীশ্বর মূর্তির ডান কানে যদি বাসুকি সাপের কুন্ডল থাকে, নারীর অর্ধেক কানে দিতে হবে সোনার দুল। শিবের ডান হাতে ত্রিশূল আরেক অর্ধে উমার হাতে মুখ দেখার আয়না। তবুও সেই হাতের ফাঁকে কোথাও থাকতেই হবে নীলপদ্মটি। শিবের সাজ খুব একটা নেই। পার্বতীর বাম বাহু ঘিরে সোনার কাঁকন কেয়ূর । নিরাসক্ত ভাস্করের খোদাই করা পীনস্তনভার, অধমাঙ্গে শ্রোণী। আধেক কোমরে মেখলার সুত্রখানি যদি থাকে তবে আধেক কোমরে থাকবে বাঘের ছাল ধরে রাখার সর্পসূত্র। শিবের পায়ের অলংকরণের কিছু নেই, তাই সম্মানার্থে পদ্মদলের ওপর স্থাপিত হবে একখানি পা। কিন্তু পার্বতীর পা থাকবে একটু উপরে এবং সেখানে আধ-বাজা নূপুর, পাঁচ আংগুলে পাঁচটি আংটি দিতে হবে। পা রাঙানো থাকবে আলতায়। এই মূর্তিতে দু’বাহুর বেলায় আমাদের বর্ণনা শেষ। তবে ইচ্ছে করলে আরও দু’টি বাহু যোগ করা যায়। তখন শিবের একবাহু উমার ডান কাঁধে থাকবে। আর বাঁ হাতটি পেছন দিয়ে এসে ছুঁয়ে থাকবে পার্বতীর পয়োধর । আর উমা! হার-কেয়ূরে কখনোও বা কর্ণিকার ফুলে বিভূষিতা, উমা অনিমেষ নয়নে চেয়ে থাকবেন প্রিয়তমের মুখে–ধূর্জটির মুখের পানে পার্বতীর হাসি। এতো গেল, অর্ধনারীশ্বরের রূপ কল্পনা। কিন্তু এই মূর্তিতে শিব পার্বতীর রসায়ন কেমন? পৌরণিক উপ্যাখানের পল্লবগ্রাহী পাঠকের হৃদয় তা নিশ্চয়ই জানতে ব্যাকুল হবে।

অর্ধনারীশ্বর অবস্থাতেই শিব হয়তো সন্ধ্যাহ্নিকে বসেছিলেন, কী করবেন? যোগী পুরুষ যে অভ্যাস ছাড়তে পারেন না। কিন্তু যেই মন্ত্রোচ্চারণের জন্য স্ফূরিত হয়েছে শিবার্ধের ওষ্ঠখানি ওমনি অপরার্ধের গৌরির ঠোঁট ফুলেছে রাগে। ‘সন্ধ্যার অনুরাগে অবহেলা হল বুঝি’! শিবের একটি হাত যখন সন্ধ্যার আহ্নিক শেষে প্রণাম জানাতে কপালে উঠেছে ওমনি পার্বতীর হাত এসে সে হাত নামিয়ে দেয়। শিবের এক আঁখি যখন ধ্যানে নিমীলিত, তখন আরেক অর্ধে পার্বতী চোখ ছোট করে প্রায় কটাক্ষ ভঙ্গে নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করে যাচ্ছেন সেই শিবনেত্রখানি। এ যেন একদিকে যোগী পুরুষের চরম অনিচ্ছা আর অনীহা । অন্যদিকে, রমনীর সৃষ্টি উচ্ছ্বাস কর্মপ্রচেষ্টা । পৌরণিক শাস্ত্রকারদের মতে, অর্ধনারীশ্বর মূর্তির এই রূপকল্পেই ত্রিজগৎ বাঁধা। এই রূপই সমস্ত জগৎকে রক্ষা করে ।

মানুষের সংসার জগৎও বাঁধা আছে এই ইছা অনিচ্ছার দ্বন্দ্বে। অর্ধনারীশ্বর যেন তাই নারী-পুরুষের প্রতিরূপ। জীবন মৃত্যুর আধার। অর্ধনারীশ্বর বেশে শিব তাই অর্ধেক পুরুষ অর্ধেক নারীদেহধারী। এই রূপের অপর একটি নাম হল “তৃতীয় প্রকৃতি”। কুইন্স ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এলান গোল্ডবার্গ এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে ‘সংস্কৃত অর্ধনারীশ্বর কথাটির অর্থ যে দেবতা অর্ধেক নারী; অর্ধেক পুরুষ অর্ধেক নারী নয়। হিন্দু দর্শন মতে ‘এই বিশ্বের পবিত্র পরমাশক্তি একাধারে পুরুষ ও নারীশক্তি’।

এত পৌরাণিক অর্ধনারীশ্বর, কিন্তু বাস্তবে যখন সত্যি অমন কোনো প্রাণী বা তৃতীয় প্রকৃতি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় ! তখন কিন্তু আমরা তাকে কখনোই নারী-পুরুষের প্রতিরূপ বা জীবন মৃত্যুর আধার ভাবি না। প্রকৃতিতে বিভিন্ন প্রজাতিতে এমন উভলিঙ্গ প্রাণী কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়।

মনে পড়ে যায়, সাগরজলের অধিবাসী পাণ্ডালিড চিংড়িদের কথা। যৌবনের প্রথম ভাগে যারা সর্বার্থে পুরুষ, মধ্যাহ্নে তারা রূপান্তরিত হয় পূর্ণাঙ্গ নারীতে। আবার কোরাল দ্বীপের নীল-মাথা র্যাশ মাছ। যাদের বেশির ভাগই নব যৌবনে ছোটখাটো অনুজ্জ্বল চেহারার নারী, পূর্ণ যৌবনে তারাই হয়ে যায় বড়সড়, চকচকে পুরুষ। প্রথম যৌবনে নারী হিসাবে, আর যৌবনের শেষ অর্ধেক পুরুষ হিসাবে চুটিয়ে জীবন রতিক্রান্ত করে তারা। কিছু মাছ অবশ্য নব যৌবনেই পুরুষ, কিন্তু তাদের পৌরুষ ঢেকে রাখে নারী রূপের ছদ্মবেশ । যার কারন হল বড় চেহারার পুরুষদের নজর এড়িয়ে তাদের দখলে থাকা সুন্দরী নারীদের কাছে পৌঁছবার ছলনা। দৈত্যাকার কাটল ফিশদের মধ্যেও এ রকম ট্রান্সভেসটাইট অর্থাৎ ‘বিপরীত লিঙ্গের ছদ্মবেশধারী’ পুরুষ দেখা যায়। একোরিয়ামে পোষা মিনো বা সোরডটেল খুব সাধারণ মাছ। সরাসরি বাচ্চা জন্ম দেয়। অনেক সময় দেখা যায়, বাচ্চা হবার পরে একটি কম বয়সী স্ত্রী মাছ বদলে হয়ে গেল পুরোপুরি পুরুষ। কিছু ব্যাঙদের মধ্যেও এমন দেখা যায়।

কয়েক প্রকার পরজীবী, পতঙ্গ , কেঁচো , পোকা , শামুক ইত্যাদির মধ্যে দেখা যায় উভলিঙ্গত্ব । নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের মধ্যে এটা স্বাভাবিকভাবে যতটা দেখা যায়, সেই তুলনায় উচ্চতর প্রাণীদের মধ্যে ততটাই বিরল ও অস্বাভাবিক। প্রকৃত উভলিঙ্গ হলো যেখানে উভয় প্রকারের যৌনঅঙ্গ উপস্থিত থাকে।

মানুষের মধ্যে যা অত্যন্ত বিরল। অন্যান্য প্রাণীদের মতো যৌন বহিরঙ্গ বদলে অন্য লিঙ্গের আকার নেবার দৃষ্টান্তও তত দেখা যায় না। নিজ প্রজাতিতে আমরা যা দেখতে পাই, তা মূলতঃ ঝুটো উভলিঙ্গত্ব । কেননা পরিবর্তনগুলি বাইরের আকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এই সব ব্যাক্তিদের যৌন গ্রন্থিগুলি একটি লিঙ্গের বৈশিষ্ট্যকেই সূচিত করে । সেক্ষেত্রে তা অপরিণত হতে পারে। মানুষের মধ্যে আমরা যে অসঙ্গতি দেখতে পাই, তা হলো কোনো ব্যক্তির আকৃতিতে বিপরীত লিঙ্গের চিহ্নগুলো প্রকট হওয়া।

প্রকৃতিতে আসল উভলিঙ্গ প্রাণীদের দুই প্রকারেরই লিঙ্গবহিরঙ্গ থাকে। একটি পুরুষ অংকুরকোষের সৃষ্টি করে। আরেকটি স্ত্রী অংকুরকোষের। তবে এই উভলিঙ্গ প্রাণীদের প্রজননযন্ত্রগুলির পূর্ণবিকাশ হয় না। তাদের শরীরের উৎপন্ন শুক্রকীট ও ডিম্বানু ব্যবহার করে নতুন জীবিত প্রাণ তারা সৃষ্টি করতে পারে না। তবে সংখ্যায় খুব কম হলেও কেউ কেউ স্ব-নিষেক , আত্মরতির মাধ্যমে এই কাজটি করতে পারে। বেশীরভাগ উভলিঙ্গ প্রাণী বংশবৃদ্ধি স্ত্রী ও পুরুষ উভয় রূপেই করে থাকে। অর্থাৎ, মিলন ঋতুতে জীবনের কোনো সময় স্ত্রীরূপে কোনো সময়ে পুরুষরূপে প্রজননের ভূমিকাটা চালিয়ে যায়। এই পরিবর্তন হয়ে থাকে প্রাকৃতিকভাবেই। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা কেমন?

ঢাকা জেলার পুড়পাড়া থেকে প্রাপ্ত ও বর্তমানে বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত শিব-পার্বতীর এই অর্ধনারীশ্বর মূর্তি। বাংলাদেশে প্রাপ্ত মূর্তিগুলির মধ্যে গঠনকৌশলের দিক থেকে এটি একটি মনোমুগ্ধকর মূর্তি এবং নির্মাণশৈলীর দিক থেকে এটি বারো শতকের মূর্তি বলে স্থির করা যায়।

মানব শিশুর জন্মকালে এমনকি পরবর্তী কালেও তার উভলিঙ্গত্ব ব্যাপারটা বলে দেয়া কঠিন। বেশিরভাগ সময় দেখা যায় শিশু জন্ম পরবর্তীকালে পালন-পোষণ করতে গিয়ে বিপরীতধর্মী প্রশিক্ষণজনিত গরমিলের কারণে বর্তমান মানুষটার মনের ভিত্তিটা এমনভাবে গড়ে উঠতে পারে যে সেটা তার যৌনগ্রন্থির সাথে মিলছে না। এক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, ব্যক্তির মানসিকতা বা বিশেষ লিঙ্গের অনুরূপ যৌনপ্রবনতা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে পারে । চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে অপারেশনের মাধ্যমে দৈহিক গঠনের এই ত্রুটি অপাসরণ করা সম্ভব হচ্ছে বেশ কিছুকাল আগে থেকেই। কোনো যৌনগ্রন্থি অপসারণ করা হবে সেটা ঠিক করার সময় শল্যবিদ সবার আগে বিচার করেন রোগীর মানসিকতার কথা। যৌনগ্রন্থির কার্যক্ষমতার কথা গৌণভাবে বিচার করা হয়। যদি চিকিৎসকের এমন মনে হয় যে, রোগীর মাঝে যৌন মানসিকতা নিয়ে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে তখনই কেবল যৌন গ্রন্থির অবস্থা নির্ণায়ক হিসেবে বিবেচিত হয় । খুব সম্প্রতি আমেরিকান অ্যাথলিট ব্রুস জেনার যেভাবে কেটলিন জেনার হয়ে উঠলেন। কিংবা স্মৃতিতে আনা যেতে পারে সেই বিখ্যাত বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানী জন রাফগার্ডেনকে যিনি একই ভাবে জন থেকে জোয়ানা হলেন।

উভলিঙ্গ, শিখণ্ডী, বৃহন্নলা কিংবা লিঙ্গ পরিবর্তন, ট্রান্সভেসটিজ্ম বা বিপরীত লিঙ্গের ছদ্মবেশ এসবই প্রকৃতির আস্তিনে লুকিয়ে থাকা প্রকৃতিরই অংশ। যা কখনোই আমাদের কাছে অর্ধনারীশ্বরের প্রতিরূপ হিসেবে ধরা দেয় না। অথচ এই পৌরাণিক প্রতিরূপ মানুষ সৃষ্টি করেছিল নিজেরই প্রতিরূপ হিসেবে। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ব্যাপারগুলির ব্যাখ্যা অনুসন্ধানে এই পৌরানিক চিন্তার জন্ম দেয় মানুষ। আর এর জন্ম তখন, যখন বিজ্ঞান বলে কিছু ছিল না। কিন্তু আজ বিজ্ঞানের চরম বিকাশের যুগেও মানুষ কাল্পনিক অর্ধনারীশ্বরের পূজায় নিজেকে যতটা নিবেদিত করতে পারে, ততটা প্রাকৃতিক বাস্তব রূপকে কাছে টেনে নিতে পারে না । তবে আমাদের চেয়ে তুলনামূলক শিক্ষিত উন্নত সমাজে মানুষের এ ধরণের বিপরীত মনোভাবে পরিবর্তন আসতে শুরু করছে । অনেকটা ‘ যত মত তত পথ’-এর মতোই প্রকৃতির নানা আচরণকে মানুষ গ্রহণ করা শিখছে।

তথ্য সূত্র:

১। ঋণ স্বীকার – (মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস । শ্রী নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী। জগন্নাথ এডুকেশন ট্রাস্ট )

২। Physiology for everyone by Boris Sergeev 1978 Mir publishers (Moscow)

৩। STUDYING HINDUSISM : key concepts and methods. Edited by Sushil Mittal and Gene Thursby , First published in the USA and Canada 2008 by Roultedge. 270 Madison Ave, New York, NY . 10016

৪। Article: Cognitive Science by Ellen Goldberg 2005

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart