পৃথিবীর মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কখনো কখনো যেমন সহজে বোঝা যায়, কখনো আবার তা অতি দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। বিপরীতমুখী এই দুই উদাহরণ পৃথিবীতে কম নয়। বিষয়টি যদি বই সংগ্রহের বেলায় ঘটে তাহলে কিভাবে তা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে? বিশ্বে মহান ব্যক্তিত্বদের যেমন বই সংগ্রহ ও পড়ার নেশা রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন শ্রেণী পেশার অনেক সাধারণ মানুষের মাঝেও এই অভ্যাস আসন গেড়ে আছে। এর মধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই্। কিন্তু যদি কোন কুখ্যাত মানুষের এমন অভ্যাস থাকে তাহলেই আমাদের ভ্রু কুঁচকে যায় বা মস্তিস্কের কোণে ধাক্কা লাগে। যদি সেই কুখ্যাত ব্যক্তিটির নাম হয় ওসামা বিন-লাদেন তা হলে কি অনুভূতি হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ কম্পাউন্ডে সিআইএ-্এর নেতৃত্বে ‘অপারেশন নেপচুন স্পার’ পরিচালনা করা হয়। এই অভিযানে আল-কায়েদা প্রধান লাদেনকে আটক করা হয় এবং পরে তাকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনা সবার জানা থাকলেও সেই অপারেশনের বিস্তারিত তথ্য আজও সকলের কাছে উন্মুক্ত নয়। তবে সম্প্রতি মার্কিন সরকার সে দেশের তথ্য প্রকাশের আইন অনুসরণ করে লাদেনের ব্যাপারে কিস্তি আকারে তথ্য প্রকাশ করা শুরু করে। এরই উদ্যোগ হিসেবে সম্প্রতি মার্কিন ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স (ডিএনআই) লাদেনের বুক শেলফ নামে তার পঠিত বিভিন্ন বই, চিঠি, ম্যাগাজিন, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি তাদের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করেছে। সেই প্রকাশিত তথ্যভান্ডার থেকেই চমক জাগানো এক তথ্য জনগণের সামনে আসে, আর তা হলো বিন লাদেনের বইয়ের প্রতি আগ্রহ ও সংগ্রহের বৈচিত্র্য।
আমেরিকার স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক ওয়াল্টার মোসলে যেমন বলেছিলেন, একজন ব্যক্তি কেমন তা তার বুক শেল্ফ দেখলেই ধারণা পাওয়া যায়। মোসলে হয়তো লাদেনকে ভেবে এই কথাটি বলেন নি। তবে বই পছন্দের ধরণ দেখে অবশ্যই ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যগত আচরণ অনেকটা অনুমান করা যায়।
লাদেনের কাছে যে সমস্ত বই পাওয়া গেছে তার সবই ডিজিটাল ভার্সন এবং আমেরিকার সরকার সম্প্রতি তা লাদেনের বুক শেল্ফ শিরোনামে তাদের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করেছে। যদিও লাদেনের সংগ্রহে থাকা অনেক বইয়ের প্রিন্টেড কপি এখন আর প্রকাশিত হয় না। তবে পুরোনো বইয়ের দোকানে তার সংগ্রহের বেশীর ভাগেরই দেখা মিলবে।
লাদেনের পাঠ্য তালিকায় ৩৯টি ইংরেজী ভাষার বইয়ের তথ্য উঠে আসে, যা পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো:
• Handbook of International Law by Anthony Aust
• Civil Democratic Islam: Partners, Resources, and Strategies by Cheryl Benard
• Killing Hope: U.S. Military and CIA Interventions since World War II by William Blum
• Rogue State: A Guide to the World’s Only Superpower by William Blum
• Necessary Illusions: Thought Control in Democratic Societies by Noam Chomsky
• Fortifying Pakistan: The Role of U.S. Internal Security Assistance (only the book’s introduction) by C. Christine Fair and Peter Chalk
• Hegemony or Survival: America’s Quest for Global Dominance by Noam Chomsky
• America’s “War on Terrorism” by Michel Chossudovsky
• Conspirators’ Hierarchy: The Committee of 300 by John Coleman
• New Political Religions, or Analysis of Modern Terrorism by Barry Cooper
• Guerilla Air Defense: Antiaircraft Weapons and Techniques for Guerilla Forces by James Crabtree
• New Pearl Harbor: Disturbing Questions about the Bush Administration and 9/11 by David Ray Griffin
• Christianity and Islam in Spain 756-1031 A.D. by C. R. Haines
• The Secret Teachings of All Ages by Manly Hall (1928)
• Black Box Voting, Ballot Tampering in the 21st Century by Bev Harris
• The U.S. and Vietnam 1787-1941 by Robert Hopkins Miller
• Military Intelligence Blunders by John Hughes-Wilson
• A Brief Guide to Understanding Islam by I. A. Ibrahim
• International Relations Theory and the Asia-Pacific by John Ikenberry and Michael Mastandano
• The Rise and Fall of the Great Powers by Paul Kennedy
• In Pursuit of Allah’s Pleasure by Asim Abdul Maajid, Esaam-ud-Deen and Dr. Naahah Ibrahim
• The 2030 Spike by Colin Mason
• America’s Strategic Blunders by Willard Matthias
• Secrets of the Federal Reserve by Eustace Mullins
• Unfinished Business, U.S. Overseas Military Presence in the 21st Century by Michael O’Hanlon
• Confessions of an Economic Hit Man by John Perkins
• The Best Democracy Money Can Buy by Greg Palast
• Bounding the Global War on Terror by Jeffrey Record
• Al-Qaeda’s Online Media Strategies: From Abu Reuter to Irhabi 007 by Hanna Rogan
• Crossing the Rubicon by Michael Ruppert
• Imperial Hubris by Michael Scheuer
• Checking Iran’s Nuclear Ambitions by Henry Sokolski and Patrick Clawson
• The Taking of America 1-2-3 by Richard Sprague
• Bloodlines of the Illuminati by Fritz Springmeier
• The Best Enemy Money Can Buy by Anthony Sutton
• Oxford History of Modern War by Charles Townsend
• Obama’s Wars by Bob Woodward
• Project MKULTRA, the CIA’s program of research in behavioral modification. Joint hearing before the Select Committee on Intelligence and the Subcommittee on Health and Scientific Research of the Committee on Human Resources, United States Senate, Ninety-fifth Congress, first session, August 3, 1977. United States. Congress. Senate. Select Committee on Intelligence.
• “Website Claims Steve Jackson Games Foretold 9/11,” article posted on ICV2.com (this file contained only a single saved web page)
এই তালিকা দেখলেই বুঝা যায়, লাদেন হালকা ধরণের বই পড়তেন না। বিন লাদেনের বইয়ের তালিকা থেকে ধারণা পাওয়া যায়, তিনি রাজনীতি, আইন, ধর্ম, যুদ্ধ, বিশেষ করে ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব সম্পর্কে খুবই আগ্রহী ছিলেন। অবশ্য বাস্তবে তার মত-পথের লক্ষ্য তো এমনটিই ছিল।
মার্কিন পণ্ডিত নোয়াম চমস্কি গণতান্ত্রিক সমাজের চিন্তা-ভাবনা নিয়ন্ত্রণের উপর ভিত্তি করে ১৯৮৯ সালে ‘নেসেসারি ইলিউশন’ লেখেন। বইটিতে তিনি রাজনৈতিক শক্তিগুলি কিভাবে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা প্রচার করে মানুষের মনে একধরণের বিভ্রান্তি ও বিকৃতি সৃষ্টি করে, গণতন্ত্রের কার্যকারিতা ব্যাহত করে মূলত তারই ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। নোয়াম চমস্কি মার্কিন নীতির কঠোর এক সমালোচক। লাদেন নিজেও যেহেতু মার্কিন সমালোচক সেহেতু চমস্কির বই আবশ্যিকভাবেই তার আগ্রহের বিষয় হবে। একই রকম ব্যাপার প্যলাস্টের ক্ষেত্রেও। তিনি দা বেস্ট ডেমোক্রেসি মানি ক্যান বাই বইতে গণতন্ত্রের আবশ্যকীয় বিষয় ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেছেন। লাদেনের কাছে এই বইটিরও একটি কপি পাওয়া গিয়েছে।
লাদেনের বইয়ের তালিকার অন্যতম একটি বইয়ের নাম ইম্পেরিয়াল হিউব্রিস। লিখেছেন মাইকেল স্কুয়ার। বইটির মূল কথা হলো- কেন পশ্চিমারা সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে? মজার ব্যাপার হলো, এই মাইকেল এক সময় সিআইএ’তে বাইশ বছর কাজ করেছেন। আর ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি বিন লাদেনকে খোঁজার ট্রাকিং ইউনিটের দায়িত্বে ছিলেন!
যারা অপরাধ করে ফায়দা লুটতে চায় অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। প্রখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ ডেভিড রে গ্রিফিন এমনটাই মনে করেন। তার লেখা নিউ পার্ল হারবার: ডিসটার্বিং কোয়েশ্চেনস এবাউট দা বুশ এডমিনসট্রেশন এন্ড ৯/১১ বইতে নাইন ইলেভেনের আক্রমণ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে ব্যাখ্যা করেছেন যে, টুইন টাওয়ারে হামলা সম্পর্কে মার্কিন সরকারের দেয়া বিবৃতি নিয়ে গভীর সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। লাদেন নিজেও একই কথা বলতেন। আর তার কাছে পাওয়া গেল ডেভিড রে গ্রিফিনের এই বইটি। উল্লেখ্য, মার্কিন প্রশাসন এখন পর্যন্ত নাইন ইলেভেন ঘটনার অনুঘটক হিসেবে লাদেনকে অভিযুক্ত করছে।
অন্যদিকে, ২০০৩ সালে কলিন ম্যাসনের লেখা দা ২০৩০ স্পাইক বইয়ের মাধ্যমে লাদেন হয়তো বা ভবিষ্যত পৃথিবী সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছিলেন। এ রকম ধারণা করার কারণ, বইটিতে পৃথিবীর আকস্মিক বিপর্যয় শুরুর ক্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে। ২০৩০ সালের পৃথিবীর মানুষ ছয়টি ‘চালিকা শক্তি’র জন্য হাহাকার করবে বলে ম্যাসন বলেছেন, তা হলো: জ্বালানীর অভাব, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দারিদ্র, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্ভিক্ষ, ক্রমবর্ধমান পানি সংকট এবং আন্তর্জাাতিক অনাচার। আর এ সকল সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য ম্যাসন একশোটিরও বেশী পদক্ষেপ নেবার কথা উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি, তিনি একটি বিশ্ব-সরকার গঠনেরও প্রস্তাব করেন।
পর্দার অন্তরালে থেকে বিশ্বের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে কে? ফ্রিটজ স্প্রিংমাইয়ার তার ব্লাডলাইনস অব দা ইলুমিনাতি বইতে সে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করে লেখক বিশ্লেষণ করেছেন পৃথিবীর মূল চালকের আসনে কোন কোন ব্যক্তি বা পরিবার রয়েছে আর কিভাবেই বা তারা রাজনীতির আসরে তাদের ভূমিকা পালন করছেন। রাজনীতির একজন একনিষ্ঠ ছাত্র হিসেবে বিন লাদেনের সংগ্রহে এই বইটিও ছিল।
লাদেন তার আল কায়েদা বাহিনীকে বিভিন্ন দেশে আক্রমন পরিচালনার জন্য প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কৌশলের আশ্রয় নেবার কথা বলেছেন। অস্ত্র, যুদ্ধ ও প্রযুক্তি কোনটাতেই তিনি পিছিয়ে ছিলেন না বলে মিডিয়াতে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। লাদেনের বাড়িতে গোয়েন্দা বাহিনী হানা দিয়ে যে সকল বইয়ের তথ্য তারা প্রকাশ করেছিল, তার মধ্যে একটি ছিল দা অক্সফোর্ড হিস্টোরি অব মডার্ণ ওয়ার বইটি। বইটিতে যুদ্ধ কিভাবে আধুনিক সমাজ গড়ে আবার ধ্বংস করে, আধুনিক অস্ত্র ও পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের ফলেই বা সমাজে কি পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, যুদ্ধ কেমনভাবে চলছে, আধুনিক টেকনোলজি, কৌশল ইত্যাদি যুদ্ধ ক্ষেত্রে কি ধরণের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে লেখক চার্লস তারই ধারাবাহিক বিবরণ দিয়েছেন।
অতীত থেকে অভিজ্ঞতা বা চলকই অনেক সময় ভবিষ্যৎ প্রবণতা সম্পর্কে ইঙ্গিত করে। একজন নেতা হিসেবে, তা কোন সন্ত্রাসী গ্রুপ বা স্বাধীনতাকামী বা কোন দেশের সামরিক বাহিনী হোক না কেন, তার অবশ্যই বর্তমান ঝোঁক সম্পর্কে আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। লাদেন হতে পারে একজন কুখ্যাত নেতা, তাতে কি? তার কাছে পাওয়া গেছে পল কেনেডির দারুণ বিশ্লেষণধর্মী এক বই দা রাইজ এন্ড ফল অব দা গ্রেট পাওয়ারস। বইটিতে ১৫০০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিশ্ব শক্তির উত্থান ও পতন সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে মূলত অর্থনৈতিক ও সামরিক বিরোধ নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে।
লাদেন সব সময়ই মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক অভিযান সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন অডিও ও ভিডিও মাধ্যমে তীব্র নিন্দা করেছিলেন। সিআইএর অনুসন্ধানে লাদেনের কাছে থেকে এ ধরণের একটি বইয়ের সন্ধান মেলে। সেটি হলো ওবামা’স ওয়ারস। বইটি লিখেছেন পুলিৎজার পুরষ্কারপ্রাপ্ত অনুসন্ধানী সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড। বইটিতে ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা নিয়ে ওবামা প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিভাজন নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
আবার, যুক্তরাষ্টের পপুলার সাইন্স ম্যাগাজিনের একটি সংখ্যায় লাদেনকে নিয়ে একটি ফিচার লেখা হয়েছিল। সেখানে লাদেনের অস্তিত্ব খুঁজে পারার ক্ষেত্রে জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম ও রিমোট সেন্সিং স্যাটালাইট প্রযুক্তির কার্যকারিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সংখ্যাটি লাদেন সংগ্রহ করেছিলেন।
মার্কিন কর্তৃপক্ষ অবশ্য এখনো বিস্তারিত কিছু জানায় নি যে, লাদেনের বাসস্থানের কোথায় এই বইয়ের সন্ধান মিলেছে অথবা তার টেবিলে পড়ার জন্য আর কি কি বই ছিল। তাছাড়া, লাদেনের বাড়িতে আরেকটি বইয়ের তালিকা পাওয়া গেছে। তবে সেটি লাদেনের নিজের সংগ্রহের কি-না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, ঐ বাড়িতে অন্য কেউ সে বইগুলির সংগ্রহাক।