বুলবন ওসমানের সাক্ষাৎকার: কলকাতায় একবার বাঙালি মুসলিমরা হামলা করেছিল বাবাকে
বুলবন ওসমানের জন্ম ১৮ মার্চ ১৯৪০ সালে মামাবাড়ি হাওড়া জেলার ঝামাটিয়া গ্রামে। মা সালেহা ওসমান ও বাবা শওকত ওসমানের প্রথম সন্তান। পৈতৃক নিবাস সবলসিংহপুর, হুগলি। ১৯৪৭-এ দেশভাগে পর শওকত ওসমান চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে যোগ দেন। ১৯৫০ সালে দুই বাংলায় বড় ধরনের দাঙ্গা বাধলে পুরো পরিবার চটগ্রামে চলে আসেন। চট্টগ্রামে স্কুল ও কলেজ পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বুলবন ওসমান পড়াশোনার পাঠ শেষ করেন সমাজতত্ত্বে। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত প্রথম বই – কিশোর উপন্যাস কানামামা। ১৯৬৬ সালে চারুকলা মহাবিদ্যালয়ে শিল্প সম্পর্কিত সমাজতত্ত্বের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত স্বরচিত কথিকা পাঠ করতেন। ১৯৭৩ সালে শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত চারুকলা ইনিস্টিউটে অধ্যাপনা করেন। অনুবাদ সাহিত্যেও কাজ করেছেন। একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী হিসেবে ঢাকা ও কলকাতায় করেছেন জলরঙ, তেলরঙ, প্যাস্টেল ও ড্রাইপেইন্টের প্রদর্শনী। বর্তমানে আঁকা ও লেখালেখিতে পরিপূর্ণভাবে নিয়োজিত। বুলবন ওসমানের এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি গৃহীত হয়েছিল ২০১৬ সালে শওকত ওসমানের জন্মশত বর্ষে। এ বছর তার জন্মশত বর্ষ উপলক্ষে প্রাবন্ধিক বিপাশা চক্রবর্তীর নেয়া বুলবন ওসমানের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো। বি. স
বিপাশা চক্রবর্তী: আগামী বছর শওকত ওসমানের জন্মশত বর্ষ। এ উপলক্ষে আপনাদের পারিবারিক আয়োজন আছে কিনা জানতে চাই।
বুলবন ওসমান: পারিবারিক ব্যাপারে তো আমাদের এখনো বসা হয়নি, সোজা কথা। কারণ সবারই বয়স হয়ে গেছে। একজনই মাত্র ৬০/৬২ হবে বাকী সবাই ওভার সেভেনটি। ও তো চিটাগঙে আছে। ও মনে হয় ওখানে কিছু করবে। ওকে এখনো আমরা পাইনি। আর ও আসলে তখন একসাথে বসা হবে। তখনই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে পারিবারিকভাবে কোন আয়োজন নেয়া হবে কি হবে না।
বিপাশা চক্রবর্তী: ইনি আপনাদের সবার ছোট ভাই?
বুলবন ওসমান: হ্যাঁ, জাঁনেসার ওসমান। তুমি আমাদের সব ভাই বোনের নাম জান কি জান না… বুলবন ওসমান,আশফাক ওসমান, ইয়াফেস ওসমান, জাঁনেসার ওসমান। বোন মারা গেছে,আরেক ভাই মারা গেছে। বোনের নামছিল আনফিসা… ও ২০১৪ সালে মারা গেছে। আরেক ভাই যে মারা গেছে ও আনফিসার বড়জন ছিল, তুরহান ওসমান।
বিপাশা চক্রবর্তী: আপনি তো বড় সন্তান। জন্মশতবর্ষে বড় সন্তান হিসেবে বাবা শওকত ওসমান আর লেখক শওকত ওসমান, কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বুলবন ওসমান: এর মধ্যে ধর কাগজে প্রত্যেক বছরই লিখতে হয়। এবারো লিখেছি ‘কালি ও কলমে’ জৈষ্ঠ্য সংখ্যায় লিখেছি, ১৩ মে সমকালের ‘কালের খেয়া’য় লিখেছি। এখন ব্যাপার হচ্ছে একজন হচ্ছে সাহিত্যিক আরেকজন হলো পিতা। সাহিত্যিক হিসেবে অসম্ভব পরিশ্রমী ছিলেন। দিন-রাত্রি লিখতেন। লেখার কোন একটা সময় ছিল না। আমি যেমন দিনে ছাড়া রাতে লিখি না। ঈদ সংখ্যা টংখ্যা বা এমন কোন কোন বিশেষ কারণ থাকলে বাধ্য হয়ে লিখি। উনার কিন্তু তেমন ছিল না। উনার দিন ছিল রাত ছিল সন্ধ্যাও ছিল। এমনকি শেষ বয়সে যখন ‘রাহানামা’ লিখতেন, তখন গভীর রাতে উঠেও লিখতেন। যেমন রাত তিনটা চারটাতেও লিখতেন। ঐটার একটা সুবিধা হয়েছিল কি, আমরা তখন রাজারবাগে ছিলাম। ওখানে রাতে অনেক চোর টোর আসত। তো,উনি লেখাতে সুবিধা হতো আমাদের চোর তাড়াতে হতো না… হা হা হা। পাঁচ বছর লিখেছেন ‘রাহনামা’ ঐ পাঁচ বছর আমাদের চোর তাড়াতে হতো না, নাহলে প্রায়ই চোর তাড়াতে হতো। এতো গেল লেখক,আবার উনি প্রচন্ড পাঁড়পাঠক ছিলেন। যারা লিখে না শুধু পড়ে তাদের চেয়েও বেশি পড়তেন। ইভেন কলকাতায় যখন কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন তখনো বাসে যাবার সময় হাতে বই থাকত। এটা উনার বন্ধুরা আমাকে বলেছেন, উনি নিজেও বলছেন আমাকে। আমাদের তো এই দেশে এই চলটা এখনো হয়নি। এটা ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডে আছে, ওরা পড়ে । আগে তো ধরো, হাতে বই থাকত এখন সে জায়গায় চলে এসেছে যন্ত্র। তখন যন্ত্র ছিল না বই ছিল। উনি অসম্ভব পাঠক ছিলেন, পাঠের মধ্যে সবই পড়তেন। বিশেষভাবে উনার আকর্ষণ ছিল সোশ্যাল সায়েন্স। সোশ্যাল সায়েন্সে উনি ইকোনোমিকস নিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন, কিন্তু পড়া চালাতে পারেননি, পরে বাংলায় এম এ করেছেন। হিস্ট্রি, সোশ্যালজি, এনথ্রপোলজি এসবে উনার আগ্রহ ছিল। এমনকি এনথ্রপোলজির একটি বইও উনি অনুবাদ করেছিলেন বাংলা একাডেমী থেকে। এইচ জি ওয়েলেসের টাইম মেশিন অনুবাদ করেছিলেন। তারপরে তোমার মলিয়ারের পাঁচটা নাটক অনুবাদ করেছিলেন। এরকম আরো অনেক কিছু আছে, তারপরে রাশিয়ান এক রাইটার তার বইয়ের নাম হলো নিশো; নায়িকার নাম নিশো, নায়িকাপ্রধান একটি বইটি চিটাগংয়ে থাকতে এটি অনুবাদ করেছিলেন, তখন এত লিখতেন যে তার হাতে একটি নার্ভে অসুবিধা হয়ে গেছিল, প্রায়ই ‘তড়কা’ পড়ত হাতে, বোঝ তো টান পড়ত…
বিপাশা চক্রবর্তী: ক্যালসিয়ামের অভাব বা দীর্ঘসময় ধরে বসা বা লেখার কারণে এ সমস্যা হয় হাতে বা পায়ের শিরায় টান পড়ে, আমারও এটা প্রায়ই হয় …
বুলবন ওসমান: হ্যাঁ, তখন অনেক লেখার জন্য এমন হয়েছিল। পরে তো এমন হয়েছিল যে ডান হাত দিয়ে সব কাজ বন্ধ। রেস্টে থাকতে হয়েছিল বেশ কিছুদিন। প্রচুর কাজ করতে হতো তাঁকে, চট্টগ্রামে আমরা যখন ছিলাম, বড় সংসার ছিল, প্রায় ১২ থেকে ১৪ জনের খাওয়াদাওয়া উনার ঐ বেতনে। তাই উনি অনেক সময় সরকারের বা কোনো কর্পোরেশনের ইয়ারলি রিপোর্ট অনেক সময় অনুবাদ করে দিয়েছিলেন ফর মানি। সামান্য কিছু পয়সার জন্য করে দিতেন। আর তখন আমরা তো সব দুবছর দুবছর করে ছোট, সবাই বড় হচ্ছে একসাথে, যখন এসএসসি’র গন্ডি পার হচ্ছে সবগুলো একসঙ্গে একের পর এক পার হচ্ছে, ঐ সময় খরচটা খুব বেশি হয় আর কি। যাই হোক,আমি যতদিন না রোজগার শুরু করেছি ততদিন উনি চাপে ছিলেন তারপর কিছুটা উনার সহায়তা হয়েছে।… আর একটা কি বলেছিলে?
বিপাশা চক্রবর্তী: আর বাবা হিসেবে কেমন ছিলেন তা তো এখন বোঝাই যাচ্ছে…
বুলবন ওসমান: এখন বলি, অসম্ভব, অসম্ভব স্নেহপ্রবণ ছিলেন। খুব বেশি মাত্রায়। মাঝে মাঝে আমরা বিরক্ত হতাম সোজাকথা! আমার ছোটভাই তখন পুনেতে ফ্লিম ইন্সটিটুটে পড়ে,আমরা তখন কলকাতায়, ও এসচে কলকাতায়, ঢাকা যাবে। ওর বয়স তখন পঁচিশ এর কাছাকাছি হবে। বাবা ওকে হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে দিচ্ছেন। আর ও হাত ছাড়িয়ে নেয়ায় বাবার সেকি রাগ! কথাই বলেননি। পঁচিশ বছরের যুবকের হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছেন না, পার করে দিচ্ছেন। এই হলো শওকত ওসমান। এগুলো মনে রাখবে। এমন ছিলেন তিনি।
বিপাশা চক্রবর্তী: আচ্ছা, আপনার যে ভাইটি মারা গেল। আত্মহত্যা করেছিলেন। এই দুঃখটা নাকি শওকত ওসমান কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আমি একটি লেখায় পড়েছিলাম…
বুলবন ওসমান: হ্যাঁ, ওটা সারা জীবনই ছিল… ওটা ওভারকাম করতে পারেননি। কি বলব, দ্যাট ওয়াজ আ…একটা শেলের মতো বিঁধেই ছিল। এটা অন্যরা বুঝতে পারতো না,আমি বুঝতে পারতাম। কারণ, যার যতই বেদনা থাকুক দৈনন্দিন কাজতো করতেই হয়, বেঁচে থাকলেও করতে হয় মরে গেলেও করতে হয়, মরে গেলে মানে নিজের কেউ মরে গেলেও করতে হয়। তার দাফন করা থেকে শুরু করে দাহ করা যত রকম রিচুয়াল আছে সবকিছু করার পরও… উনি এভাবে ব্যাখা করতেন, আমার এক নানী ছিল, তাঁকে বলতেন-“দেখেন মা, আমি কাকের মতো একটা একটা কাঁঠি এনে বাসা বাঁধছি, সেই বাসা হঠাৎ বজ্রপাতে জ্বলে গেল, এটা আমি কি করে সয়ে যাব”। তখন আমি এম এ পাশ করেছি মাত্র। চাকরী পাইনি। আর ও তখন মেট্রিক দেবে।
বিপাশা চক্রবর্তী: কিশোর বয়স…
বুলবন ওসমান: এই ধর ষোল সতের বয়েস হবে। আর ও একটু সুন্দর ছিল আমাদের মধ্যে,মার মতো ফর্সা ছিল। একটু শর্ট ছিল আমাদের তুলনায় তবে গায়ের গঠন ভাল ছিল। ব্যায়াম করত, খেলাধূলা করত।
বিপাশা চক্রবর্তী: তখন রাজারবাগে ছিলেন সবাই।
বুলবন ওসমান: তখন তো ধর আমরা তিন চার ভাই এক রুমে থাকতাম। রুমতো কম ছিল। আমরা তিনটে রুমে সবাই থাকতাম। পড়ে বাবা আলাদা একটি রুম করেছিলেন, উনার এককভাবে। আমাদের সেই বাড়ির ছবিটি দিয়ে দিয়েছি ছোটভাইকে, নাহলে তোমাকে দেখাতে পারতাম। যাই হোক, এই সংসারের মাঝে থেকেও কিছুটা সংসার বিবাগীও ছিলেন। অনেক সময় তাস টাস খেলতেন। রাত হয়ে যেত তাস খেলতে। আমরা এগুলো গায়ে মাখতাম না। রেয়রলি হতো। আমি যখন ইউনিভার্সিটির টিচার হয়েছি তখন আমিও খেলেছি, ওসব নিয়ে আমাদের পরিবারে তেমন বাঁধা ছিল না। মা চিন্তা করতেন রাত হয়ে গেলে।
বিপাশা চক্রবর্তী: আপনার মা মারা গেছেন…
বুলবন ওসমান: মা, মারা গেছেন ২০১১ তে। আর বাবা তো জানোই ৯৮’তে । বাবার বয়স তখন ছিল বিরাশি। আশি পার করার পর পর প্রায়ই বলতেন “আই হ্যাভ ক্রস ট্যাগোর—হা হা! আমি তো ফকির আর ও তো রাজার ব্যাটা রাজা। তোমাদের ঠাকুর তো আগে মরে গেল, আমি তো ওকে ক্রস করে গেছি”। প্রায়ই বলতেন।
বিপাশা চক্রবর্তী: শওকত ওসমানের উপন্যাস, গল্প, নাটক, প্রবন্ধের কথা জানি। কিছুদিন আগে তাঁর সঙ্গীতভাবনা নিয়ে আপনার একটি লেখা পড়েছি একটি সাহিত্য সাময়ীকিতে। শওকত ওসমান রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অত্যন্ত ভক্ত ছিলেন। তাঁর সঙ্গীত ও কাব্যচর্চা নিয়ে কিছু বলুন।
বুলবন ওসমান: আমার একটি বই আছে তাঁকে নিয়ে ‘কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান’ সময় থেকে বেরিয়েছে। ওটার মধ্যে সব পেয়ে যাবে। তবে কাব্যচর্চা নিয়ে লেখা হয়নি…
বিপাশা চক্রবর্তী: উনি শেষ বয়সে ছোট ছোট ছড়া/কবিতা লিখতেন-এসবের কি কোনো সংকলন…
বুলবন ওসমান: ওটা গত বছরই বেরুবার কথা ছিল। যারা করছিল ওদের কিছু ট্যাকনিকাল সমস্যার কারণে দেরি হচ্ছে। তবে কয়েকমাসের মধ্যে বেরিয়ে যাবে। কবিতার বই দুটো ছিল শেখের সম্বরা আরেকটা ছিল নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত বাংলা একাডেমী করেছিল। এটা ছিল এরকম–”মারা গেছে শওকত ওসমান”, তারপর উনি নিজেই নিজের কথা বলছেন, লোকটা কেমন ছিল? লোকটা বেশি কথা বলত। হাসাহাসি করত। ধর্ম কর্ম করতো না। এই মরবার পরে লোকে যা যা বলবে তাই নিজে বলে গেছেন। তাঁর কাব্যে নিজের সম্বন্ধে নিজেই বলছেন- তাই ‘নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত’।
বিপাশা চক্রবর্তী: আপনি একবার বলেছিলেন উনার একটি ডায়েরী হারিয়ে গেছে ৭১-এ?
বুলবন ওসমান: হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটা খুব… কি বলব ‘ইউ হ্যাভ লস্ট আ গ্রেট থিং’। এইটা থাকলে আমি উনার সংগীতের ব্যাপারটা নিয়ে নিবিড়ভাবে একটা বই-ই করতে পারতাম…যদি ঐ খাতাটা থাকত।
বিপাশা চক্রবর্তী: লেখালেখির ব্যাপারে শওকত ওসমানের বিশেষ কোনে শখ বা নিজস্ব কোন স্টাইল বা ব্যাপার ছিল?
বুলবন ওসমান: হ্যাঁ, উনি লিখতেন খুব দামী কলমে লিখতেন। তীক্ষ্ণ চঞ্চুবিশিষ্ট কলম হতে হতো। দামী শেফার পার্কার কলম–এসবে। যদিও অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ কিন্তু মনের মধ্যে শৌখিনতা ছিল। প্রথম দিকে এতটাই শৌখিন ছিলেন যে লোকে ভাবত যে জমিদারের ছেলে…
বিপাশা চক্রবর্তী: আচ্ছা, দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন শওকত ওসমান। অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছিল সেই সময়। তখনকার তুলনায় এখন জীবন অনেক বেশি সহজ ও স্বাছন্দ্যময়। তবুও কেন শওকত ওসমান বা তাঁর ঐসময়ের মতো অন্যান্য গুণী ব্যক্তিত্ব বা চিন্তাবিদ আমরা পাচ্ছি না। ঐ সময় এত স্ট্রাগল করে এত কষ্ট করে উনারা যে চর্চা চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন এখন কেন আমরা তা পারছি না?
বুলবন ওসমান: উনার জীবনে দুটো পার্ট ধরতেই হবে। একটা হচ্ছে পার্টিশন অব ইন্ডিয়া আরেকটা হলো পার্টিশন অব বেঙ্গল। ঐ সময় জয়নুল আবেদীনের সাথে উনার সম্পর্ক হয়। জয়নুল আবেদীনের উত্থানও তখন। যখন সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার হয় তখন জয়নুল আবেদীন তো অলমোস্ট সারা পৃথিবীতে পরিচিত হয়ে গেছেন। এই যে, তাঁরা যে উঠছে, এদের উঠার একটা বড় ব্যাপার হলো এঁরা জীবনের একেবারে নগ্ন অবস্থা থেকে উঠেছেন, বুঝেছো … এই নগ্ন অবস্থা থেকে উঠে আসার কারণে হিউমেন বন্ডেজ এন্ড ক্রাইসিস এই সম্পর্কে তারা সেন্ট পার্সেন্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে তারা এসবের মধ্য দিয়েই গেছেন… না খেতে পেয়ে, খালি পায়। কলকাতায় আমার বাবা খালি পায় মাদ্রাসায় গেছেন। ক্যান ইউ ইম্যাজিন! ইন দি সিটি অব কলকাতা, ইউ আর জাস্ট গোয়িং টু ইউর মাদ্রাসা উইদআউট এনি স্যান্ডেল অর ফুটওয়্যার! তখন তো ঘোড়ার গাড়ি চলত কোলকাতার রাস্তায়। বোঝ! না খেয়েও থেকেছেন। বাবা বলতেন, এক পয়সা পেতাম বড় চাচার কাছ থেকে। আমার বড়দাদা ছিলেন কলকাতায় উনার মূল অভিভাবক। আসল দাদা যিনি ছিলেন শেখ মোঃ এহিয়া… হি ওয়াজ অলমোস্ট ইলিটারেট। জীবনে দু’চারবার সুযোগ পেয়েছেন দোকান টোকান করার। কাঠের গোলা টোলা করার। যদিও প্রায় প্রতিবারই ফেল হয়েছেন, কখনো সাকসেস হতে পারেননি।
বিপাশা চক্রবর্তী:শওকত ওসমানের শিক্ষা জীবন মাদ্রাসা থেকে শুরু। ঐ সময় থেকেই তিনি বেশ বিল্পবী চিন্তার অধিকারী ছিলেন। বিভিন্ন লেখা থেকে জানতে পারি ঐ সময় থেকেই তিনি সমাজের নানা কুসংস্কার ইত্যাদির বিরুদ্ধে কথা বলতেন। এ সাহস তিনি কিভাবে পেলেন?
বুলবন ওসমান: বিপ্লবী চিন্তা মানে… উনি তখন ক্লাস সিক্সে পড়েন জুনিয়র মাদ্রাসায়, বাড়ির পাশে মাদ্রাসায়। সেখানে একদিন ক্লাসে শিক্ষক বলছিলেন… সব কিছুরই তো স্রষ্টা আছে, মানুষও একটি জীব তারও স্রষ্টা আছে। তখন তিনি ঐ শিক্ষকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আচ্ছা মৌলভী সাহেব, আমাদের সেই স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করেছেন? ইট ওয়াজ হিট আটারেন্স। মৌলভি সাহেব তখন নাকি তাঁকে মারতেও এসেছিলেন। তবে সামনে এসেও মারেননি, কেন জানি, ক্লাসে সবচেয়ে ভাল স্টুডেন্ট ছিল বলেই হোক বা যে কারণেই হোক, তখন তাঁর চেতনা হয়েছে, মারেননি।
বিপাশা চক্রবর্তী: যতদূর জানি শওকত ওসমান নিয়মিত দিনলিপি লিখতেন? সেটি কি কখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল?
বুলবন ওসমান: উনি মারা যাবার পরপর পুরো একবছরের ডায়েরী মানে ৯৭ সালেরটা আরকি, একটি পত্রিকা নিয়মিত ছাপিয়েছিল। সম্ভবত ‘সাপ্তাহিক’ ছিল পত্রিকাটির নাম। বেশ কয়েকটি ডায়েরী ছিল উনার। সব মিলিয়ে প্রায় তিন চারশো পৃষ্ঠা হবে। সেগুলো আমার ছোট ভাই নিয়ে গেছিল। কয়েকবার প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েও আর হয়ে ওঠেনি। এখন ওগুলো কি অবস্থায় আছে ছোটভাইটি ভাল বলতে পারবে।
বিপাশা চক্রবর্তী: শওকত ওসমানের বিশেষ কোনো কথা বা বৈশিষ্ট্য যা এই মুহূর্তে আপনার মনে পড়ছে?
বুলবন ওসমান: উনার বিশেষ একটি গুণ ছিল, সেটি হলো অসম্ভব স্মৃতি শক্তি। যেটা আমার খুব কম। কিন্তু উনার প্রচন্ড ছিল, একেবারে কম্পিটারের মতো। খুব মনে রাখতে পারতেন। এইজন্য উনার যে রাহানামা বই দুখন্ড বেরুল ৮০০ পৃষ্ঠার। এই দুখন্ডে তিনি কলকাতা ছেড়ে এদিকে আসতেই পারেননি। মানে উনার তিরিশ বছর বয়স পর্যন্তই ঐ দুখন্ড। তাও কমপ্লিট হয়নি, কোলকাতাও কমপ্লিট হয়নি। এদিকে আসলে আরো কত খন্ড হতো চিন্তা করে দেখ। বায়ান্ন বছর কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। এত বেশি ডিটেল লিখেছেন যে এদিকে আর আসতে পারেননি। এই ব্যাপারে মোস্তফা উল ইসলাম বলতেন, শওকত ভাই, শওকত ভাই,তাড়াতাড়ি করেন, তাড়াতাড়ি করেন, এত ডিটেল লিখলে এদিকে আর আসতে পারবেন না’। এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর কথাটাই খাটল। যিনি লিখছেন তিনি তো মনের আনন্দে লিখছেন, তিনি তো আর জানেন না তাঁর মাথাটা হঠাৎ স্ট্রোক করবে। তাঁর তো আদার কোন অসুখ বিসুখ ছিল না। ডায়াবেটিস একটু হয়েছিল শেষের দিকে। বয়সজনিত কারণে যেটা হয় আর কি। তাও নিয়ন্ত্রনেই ছিল। কিন্তু ব্রেন সেলগুলো মরে গেল। ব্রেন সেলগুলো মরে গেলে কিন্তু আর জন্মায় না, শরীরের অন্য মাসলের মতো না। আমরা যখন স্ক্যান করালাম দেখি সিক্সটি পার্সেন্ট ডেড। আফটার ফোর্টি আমাদের প্রতিদিনই কিন্তু ব্রেন সেলগুলো মরে যাচ্ছে। যেহেতু অনেক বেশি তাই আমার বুঝিনা। তবে আজকাল আমি বুঝতে পারি যখন কারো নাম ভুলে যাই। সত্যিকার অর্থে উনার এই অবস্থা কখনোই ভাল হয়নি। কিছুটা বলতে পার, আমার ওই ভাই মারা যাবার পর থেকেই স্নায়ুর যে চাপটা উনার তৈরি হয়েছিল তা আর কখনো ভাল হয়নি। ওটা রিকভার করতে পারেননি বলে পরবর্তীতে প্রায়ই এলোমেলো হয়ে যেত কথা। কিন্তু লেখার সময় ঠিক ছিলেন,অদ্ভুত! আমি খেয়াল করেছি, লেখার সময় পুরো মনোযোগটা লেখাতে এমনভাবে দিতেন যে লেখায় কোন অসুবিধা দেখা দিত না।
বিপাশা চক্রবর্তী: জননী উপন্যাসটি ইংরেজীতে অনুবাদ করেছিলেন ওসমান জামাল, সেটি ইংল্যান্ডের হেইনেম্যান প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। সে বইটির পরে কি তার আর কোন বই ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল বিদেশি প্রকাশনী থেকে?
বুলবন ওসমান: ইংরেজীতে অনুবাদ হয়েছে জননী ও রাজসাক্ষী উপন্যাস, ক্রিতদাসের হাসি- (লাফটার অব স্লেভ) কবীর চৌধরীর অনুবাদে। আর একটি ছোটগল্পের সংকলন গড এডভারসাররি এন্ড আদার স্টোরি। দুটো চিঠিও আছে বাবার। একটির কথা মনে আছে একাত্তর সনে চায়না যাতে বাংলাদেশের পক্ষ নেয়, তার জন্য ‘ওপেন লেটার টু চৌ এন লাই’। কিন্তু চায়না তো তখন আমাদের সাহায্য দেয়নি, ওরা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। কারণ পাকিস্তানের সাথে তখন ওদের ব্যবসায়িক সম্পর্কের দরজা কেবল খুলছে…
বিপাশা চক্রবর্তী: শুনেছি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একসময় চেয়েছিলেন শওকত ওসমানকে জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা করা হোক। কিন্তু সেটা উপেক্ষিত হয়েছে কেন? ……
বুলবন ওসমান: আমাদের দেশে যা হয় আরকি, জানোইতো। অনেক সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে জুনিয়রদেরকে প্রমোশন দেয়া। তখন উনাকে অপছন্দ করতো এমন লোকজনও তো ছিলেন। তাদের পছন্দের ব্যক্তি ছিল। তাদেরকে দেয়া হলো। পরে আমার বাবার সময় আসতে আসতে ততদিনে তিনি মারা গেছেন।
বিপাশা চক্রবর্তী: বাংলাদেশ তাঁকে কতটুকু মূল্যায়ন করতে পেরেছে বলে মনে করেন?
বুলবন ওসমান: বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে উনি অনেক ভালবাসা পেয়েছেন, মূল্যায়নও করেছে যথেষ্ট। শুধু কিছু গোঁরা সংস্কারবাদীরা তাঁকে দেখতে পারতেন না।
বিপাশা চক্রবর্তী: শওকত ওসমান সারাজীবন অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেছেন। এতবছর আগে থেকেই তিনি তাঁর মুক্তচিন্তাগুলো আমাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু এত বছরপর যখন দেশ আরও এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তখনই আমরা বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। এসময়টার আশাংকা কি তিনি কখনও করেছিলেন?
বুলবন ওসমান: না না, এমন চিন্তা করেননি। এখন তো কেটে ফেলছে, তখন এমন ছিল না। তবে একবার আহমদ শরীফকে মারতে চেয়েছিল নাইনটির শেষের দিকে মনে হয়, আর শামসুর রহমানকে একবার মারতে গিয়েছিল, এটা আটানব্বইয়ের পরে। মারতে গিয়েছিল ওই পর্যন্তই। আমার বাবাকে এসব ফেস করতে হয়নি। কলকাতায় একবার বাঙ্গালী মুসলিমরা হামলা করেছিল বাবাকে … এই। এখন তো বেশিরভাগ সাধারণ বাঙালি মুসলমান, সরকার, অপজিশন সবার চিন্তাধারা একই রকম হয়ে গেছে। এখন কে কাকে মারছে বলা মুশকিল।
বিপাশা চক্রবর্তী: শওকত ওসমান তো সব সময় মুসলমানদের শিক্ষার ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতেন…
বুলবন ওসমান: হ্যাঁ, একারণেই তো মুসলমানদের পিছিয়ে পড়া। বাবা এটা সবসময় বলতেন। মানুষ শিক্ষিত হলে প্রাচীন সংস্কার আর গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হলে তো আর চুরি করা যাবে না, ওদের ঠকানো যাবে না। এটা নিয়ে বাবার একটা বইও আছে মুসলিম মানসের রূপান্তর, নামটি বোধহয় এমন ছিল। তুমি যদি বাবার প্রবন্ধ সংকলন বইটি যোগাড় কর, দেখবে।
বিপাশা চক্রবর্তী: শওকত ওসমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপন নিয়ে সরকার বা বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে কি কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে? এ ব্যাপারে তাদের তরফ থেকে কোনো যোগাযোগ করা হয়েছে আপনার সাথে বা আপনাদের পরিবারের সাথে?
বুলবন ওসমান: হ্যাঁ, বাংলা একাডেমীর সাথে কিছুটা আলাপ হয়েছে। আরো কথা হবে সামনে। ওরা করবে উদযাপন। কিছু বইপত্র, স্বারক প্রকাশ করা হবে। আসলে এটাই তো সময় কিছু করার। একশোতম জন্মবার্ষিকী তো বার বার হবে না।
বিপাশা চক্রবর্তী:শওকত ওসমানের সঙ্গে তো সেই সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের বন্ধুত্ব ছিল যাদের সাথে উনার নিয়মিত যোগাযোগ বা সাক্ষাৎ হতো। এমন কার কার কথা মনে আছে আপনার?
বুলবন ওসমান: নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, সিকান্দর আবু জাফর, তারপর আবু জাফর শামসুদ্দিন,আবুল হোসেন এরা। এদের সাথে উঠাবসা ছিল। আরো ছিলেন উদয়ন চৌধরী নামে একজন সিনেমার ডিরেক্টর ছিলেন যিনি ওই সময় ‘সমকাল’ পত্রিকার সাথে ছিলেন, আসল নাম ছিল ঈসমাইল মোহাম্মদ। এদের সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আরো ছিলেন আবু রুশদ মতিনুদ্দীন, সৈয়দ আলী আহসান, আহসান হাবীব, দৈনিক বাংলার এডিটর ছিলেন আহসান আহমদ, সরদার জয়নুদ্দীন, শিল্পী জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, শফিউদ্দিন আহমেদ এই তিন জনের সাথে। তারপর শিল্পী আমিনুল ইসলাম, দেবদাস চক্রবর্তী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, এখনো বেঁচে আছেন, এদের সাথেও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মর্তুজা বশীর, যদিও ঠিক বন্ধু ছিলেন না কারণ উনার অনেক ছোট ছিলেন তারপরেও সখ্যতা ছিল। যেমন আবার ড.শহীদুল্লাহ আমার বাবার চেয়েও বড় ছিলেন তারপরেও বন্ধুর মতোই। এছাড়া খুব নামকড়া একজন ইকবাল বাহার চৌধুরীর বাবা হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী, উনিও বাবার বড় ছিলেন, কলকাতা থেকে বের করতেন ‘বুলবুল’ পত্রিকা। সেই পত্রিকায় লেখার সময় থেকে উনার সাথেও বাবার ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, এমনকি উনার স্ত্রীর সাথেও ভাল পরিচয়। কবি সুফিয়া কামাল, সওগাত-এর নাসিরুদ্দিন এবং উনার স্ত্রী–এদের সাথেও বাবার ভাল পরিচয় ছিল। তারপর মর্নিং নিউজ-এর একজন এডিটর ছিলেন খতীব সাহেব, সমবয়সী ছিলেন তিনিও আসতেন আমাদের বাসায়। এমনকি ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন করুণা বন্ধোপাধ্যায় তিনি এবং তার হাজব্যান্ড মাঝে মাঝে আসতেন আমাদের বাসায়, উনার স্বামী যখন ঢাকায় ফার্স্ট সেক্রেটারী ছিলেন, তখন।
বিপাশা চক্রবর্তী:শওকত ওসমান, তাঁর লেখনী, আর ভাবনাকে এ প্রজন্মের কাছে কিভাবে আরো ভালভাবে পৌঁছে দেয়া যায়? আপনার কোনো পরামর্শ ও পরিকল্পনা?
বুলবন ওসমান: উনিতো বাচ্চাদের জন্যও লিখেছেন, ‘ওটেন সাহেবের বাংলো’। ‘আব্বাস’ গল্পটা ছিল একসময় ক্লাস নাইনে। এরকম করে যদি ছেলেমেয়েদের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির বইতে পাঠ্য করা যায় উনার লেখা তাহলে … তোমরা দেখ কি করা যায়, তোমরা তো এ প্রজন্মের…।
বিপাশা চক্রবর্তী:অনেক ধন্যবাদ বুলবন ওসমান আপনাকে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সময় দেবার জন্য। আশা করি আবার আপনার সাথে কথা হবে খুব শিঘ্রই। ভাল থাকুন শুভকামনা।