পৃথিবীর বহুল প্রচলিত প্রাচীন একটি ধারণা বা বিশ্বাস হচ্ছে সৃষ্টির শুরুতে প্রথম আবির্ভাব হয়েছিল পুরুষের, আর তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে পুরুষের পরে যখন নারী সৃষ্টি হলো, তখন প্রথমবারের ভুলগুলো যথাসাধ্য শুধরেই হয়েছিল। তা না হলে, নারীর ভেতর বেঁচে থাকার তাগিদ বা ক্ষমতা এতো প্রবল কেন? চারিত্রিক বা শারীরিক উভয় দিক দিয়েই। যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘সারভাইবাল ইনস্টিংক্ট’।
অবশ্য জন্ম মুহূর্তে নারী ভ্রুণের উৎপত্তি হারের চেয়ে পুরুষ ভ্রুণের উৎপত্তি হার একটু বেশি হলেও নারী ভ্রুণের বড় হবার এবং জন্ম নেবার প্রবণতা বেশি। অন্যদিকে পুরুষের ভ্রুণের প্রাকৃতিক গর্ভপাত হবার সম্ভাবনা বেশি। শৈশব, যৌবন ও মধ্য বয়সে নারীর চেয়ে পুরুষের মৃত্যু হারও বেশি।
বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশগুলোতে যেখানে মেয়েশিশুর তুলনায় ছেলে শিশুকে বেশি যত্ন নেয়া হয়, ভাল খাওয়া দেয়া হয়, সেখানে সামান্য হেরফের হতে পারে। কিন্তু এতো অনাদর, অবহেলা, ও অপুষ্টির পরও দেখা গেছে যে, এসব দেশেও মেয়েশিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও বেঁচে থাকার ক্ষমতা ছেলে শিশুর চেয়ে ঢের বেশি। আর উন্নত দেশগুলোতে যেখানে গর্ভকালীন বিশেষ যত্ন নেয়া বা প্রসবকালে ভালো ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং জীবনযাত্রা আধুনিক, সেখানে নারীর লাইফ এক্সপেকটেন্সি বা আয়ুষ্কাল পুরুষের চেয়ে বেশি।
শুধু তাই নয়, শুক্রাণু দান ব্যতীত সন্তান জন্মদান, লালন পালন রক্ষণাবেক্ষণ, সর্বোপরি মানুষসহ অন্য সকল প্রজাতিগুলোর টিকে থাকায় নারী লিঙ্গের ভূমিকাই বেশি। নারী আর পুরুষ কে আগে তৈরি হয়েছে এ সম্পর্কে বিশ্বাস বা প্রচলিত ধারণা যাই হোক না কেন, প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে নারী জিনের গঠন বা জেনেটিক প্যাটার্ন মানবজাতির জিনগত গঠনের মূল। পুরষত্ব এর উপর আরোপিত হয় কেবল। (নারী এক্স এক্স অর্থাৎ পরিপূর্ণ, আর পুরুষ এক্স ওয়াই, এক্সটা নারীর কাছ থেকে পাওয়া)।
প্রকৃতির এই নিয়মের ফলে পুরুষের মধ্যে বংশানুক্রমিক রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। সাধারণভাবে একটি ভ্রুণ যখন সৃষ্টি হয়, তখন সেটি ২৩টি ক্রোমোজোম মায়ের কাছ থেকে এবং ২৩টি বাবার কাছ থেকে পায়। এই ক্রোমোজোমের ২৩ নম্বর জোড়ার উপর নির্ভর করে ভ্রুণের লিঙ্গ। মায়ের কাছ থেকে পায় কেবল এক্স, আর বাবার কাছ থেকে পায় এক্স অথবা ওয়াই। এই ওয়াই ক্রোমোজোম ভ্রুণের ছ’সপ্তাহ বয়স থেকে তার উপর পুরুষত্ব আরোপ করতে থাকে, আর ভ্রুণ তার মূল নারীত্ব বর্জন করে পুরুষ শিশুতে পরিণত হয়। তবে ভ্রুণটি যদি তার বাবার কাছ থেকেও এক্স ক্রোমোজোম পেয়ে থাকে, তবে সেটি তার নারীসত্ত্বা বজায় রাখবে। সেক্ষেত্রে বাবার এক্স ক্রোমোজোম মায়ের এক্স ক্রোমোজোমের বহু তথ্যের সাথে মিলে যায়।
সুতরাং নারীর কোন একটি এক্স ক্রোমোজোমে কোনো অশনি সংকেত বা জেনেটিক দুর্বলতা লুকিয়ে থাকলে তা পুরুষের এক্স ক্রোমোজোমের প্রভাবে নিহত হতে পারে। অর্থাৎ এটা নারী শিশুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু পুরুষ শিশুর ক্ষেত্রে ওয়াই ক্রোমোজোম নারীর এক্স ক্রমোজোমের এই আসন্ন বিপদকে দূর করতে সক্ষম হয় না। সেক্ষেত্রে এক্স ক্রোমোজোমের দুর্বলতা পুরুষ শিশুর মধ্যে দেখা দিতেই পারে। ফলে বংশগত রোগ পুরুষ শিশুর মধ্যেই বেশি দেখা দেয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লু্কিয়ে আছে নারীর দেহের ভিতরে। সেটা হলো নারীর মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ। যা কিনা নারী দেহ কোষের মাধ্যমে অবিকৃত অবস্থায় রয়ে গেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। যার দ্বারা সমগ্র মানব জাতির পূর্বপুরুষ বা মাতৃসূত্রে সকল মানুষের আদিমাতাকে নির্ণয় সম্ভব হয়েছে। যিনি কিনা বেঁচে ছিলেন এখন থেকে দুই লক্ষ বছর আগে। যাকে ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ’ বলা হয়। অর্থাৎ এই নারী থেকেই পৃথিবীর সকল নারী এসেছে। সেই মানব-মাতার মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ একই রূপে বর্তমান নারীদের মাঝে আছে।
কোষের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে মাইটোকন্ড্রিয়া। একটি ডিম্বাণুতেও মাইটোকন্ড্রিয়া আছে। মাইটোকন্ড্রিয়াতে আছে মাইটোকড্রিয়াল ডিএনএ। এই ডিএনএ বংশগতির ধারায় কোন ভূমিকা না রাখলেও অবিকৃত অবস্থায় থেকে যায়। বংশগতির ধারায় ভূমিকা রাখে ক্রোমজনাল ডিএনএ, যা নারী-পুরুষ উভয়ের কাছ থেকেই আসে। অথচ আজকে যুগেও সমাজে বংশগতি বলতে পিতার বংশের বৈশিষ্ট্য আর বংশের বাতি বলতে শুধুমাত্র পুত্র সন্তানকেই বোঝায়। আর এটা যে সম্পত্তির উত্তরাধিকার ব্যবস্থার জন্য আরোপিত একটি ধারণা, তা বলাই বাহুল্য।
আর একই রকম গবেষণায় পুরুষের ওয়াই ক্রমোজমোনাল এডামের ক্ষেত্রে দেখা যায় তা নারীর ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ’ এর চেয়ে পিছিয়ে আছে পঞ্চাশ থেকে আশি হাজার বছর। অর্থাৎ তখনও পুরুষরা আমাদের পূর্বপুরুষ এপ এনসেস্টরদের মতোই লোমশ ছিল, আর নারীরা অনেকটাই এখনকার নারীদের মতোই হয়ে গিয়েছিল। এটা প্রমাণ করে বিবর্তনের দিক দিয়েও নারীই এগিয়ে।
আর হরমোনের কথা যদি বলা হয়, তাহলে নারী হরমোন ইস্ট্রোজেন প্রজনন ছাড়াও রক্ত সঞ্চালন, মানসিক চাপ মোকাবিলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরোনের চেয়ে অধিক কার্যকর। প্রাথমিক পর্যায়ে আদিম পুরুষের গড় জীবন কাল ছিল তেইশ বছর। সেই সময়কার জীবন যাত্রায় অত্যধিক পরিশ্রম আর বন্য প্রাণীর তাৎক্ষণিক মোকাবিলায় যে পরিমাণ স্ট্রেস বা চাপজনিত হরমোন উৎপাদিত হতো, এখনো তাই হয়। সে সময়ের জন্য তা আদর্শ হলেও এখনকার আধুনিক জীবনযাত্রায় ,কংক্রিটের জঙ্গলে ব্যবসায়ী কূটনীতির লড়াইয়ে সেই একই রকম স্ট্রেস হরমোন পুরুষের স্বাস্থ্যহানিই ঘটাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, নারী ইস্ট্রোজেন, ‘কাডল হরমোন’ অক্সিটকিন নিঃসরণ ঘটায়, যার কারণে নারী শুধু সন্তানবাৎসল্যই হয় না, বরং পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ, এবং রাগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও বেশি হয়। অন্যদিকে রাগ, আগ্রাসন যেন পুরুষের ভূষণ। মানব সভ্যতার পরতে পরতে যতো যুদ্ধ, হত্যা, হানাহানি, রক্তক্ষয়ী ও নৃশংস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ইতিহাস পাওয়া যায়, তা অনেকাংশেই পুরুষের সৃষ্টি।
তখনকার সমাজে টিকে থাকার লড়াইয়ে পুরুষের এই মনোভাব তাদের জন্য যতটা অনুকূল ছিল, এখনও কি তাই আছে? এখনকার সমাজের পুরুষরা তাদের এই আগ্রাসী মনোভাবের অভিযোগ থেকে কতখানি নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছে?
গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষের তুলনায় নারী দ্রুত সভ্য হয়েছে এবং তাদের অভিযোজন ক্ষমতাও বেশি। এ নিয়ে গবেষণাও হয়েছে বিস্তর। পাওয়া গেছে সেই একই কারণ, পুরুষের জেনেটিক দুর্বলতা। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের প্রিন্স হেনরি ইন্সটিটিউট এর গবেষকরা পুরুষের আগ্রাসী মনোভাবের জন্য দায়ী ‘এস আর ওয়াই’ নামক জিন সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। যা কিনা ওয়াই ক্রোমোজোমেই পাওয়া গেছে।
সামাজিক জীবনের কথা বলতে গেলেও দেখা যায়, সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল কৃষির মাধ্যমে। এর গোড়া পত্তনও করেছিল নারী। প্রাচীন সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে মাতৃতান্ত্রিকতা এবং মাতৃবংশানুক্রমিকতার ইতিহাস সবার জানা। যদিও নারী-পুরুষের যৌথ সভ্যতার ইতিহাস অধিক শারীরিক বলের অধিকারী পুরুষের দাপটেই ছেয়ে আছে। কিন্তু আজকের আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের নানা অবদানের ফলে যেখানে শারীরিক বলের প্রয়োজনীয়তা কম, সেখানে পুরুষের ভূমিকা আসলে কেমন? শুধুই কি প্রজননের জন্য শুক্রাণু দান করে যাবে পুরুষ? বর্তমান পৃথিবীর লাখ লাখ পুরুষ অস্বাভাবিক শুক্রাণু উৎপাদনজনিত সমস্যায় ভূগছে। যার ফলে ক্রমাগত তারা প্রজননে অক্ষম হয়ে পড়ছে। এই সমস্যা সমাধানে কৃত্রিম শুক্রাণু উৎপাদন ও তার ব্যবহার নিয়ে গবেষণা চলছে বহুদিন ধরে।
সম্প্রতি ফ্রান্সের একদল বিজ্ঞানী পরীক্ষাগারে প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ মানব শুক্রাণু তৈরি করেছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও তার প্রয়োগ বিস্তর বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনার মাধ্যমে স্বত:সিদ্ধ হবার দাবি রাখে। এই অবস্থায় অনেক বিশেষজ্ঞ ভাবছেন, নারী জেনেটিকভাবে পরিপূর্ণ হওয়ায় অ-যৌন পদ্ধতিতে কেবল কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে যেখানে সভ্যতার বিকাশ চলমান রাখতে পারে, সেখানে তাহলে কেন পুরুষ? কেন নারী ছেলে সন্তান জন্ম দিয়ে নিজেদের প্রচেষ্টার অপচয় করছে?
বিবর্তনের গতিপথে পুরুষের অস্তিত্ব কি আজ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চলেছে? অনেকদিন আগে প্রকৃতি বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন দেখিয়েছিলেন, প্রাণীজগতে বিভিন্ন প্রজাতিতে পুরুষরা নারীর চেয়ে অধিক সুন্দর ও উজ্জ্বল রঙবর্ণ গাত্র ও লোম বিশিষ্ট হয়, এবং প্রজননের জন্য নারীকে আকর্ষণ করতে তারা নানা রকম ক্রিয়া কলাপ, অঙ্গভঙ্গি, ও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এদের থেকে নারী মিলনের জন্য তার যোগ্যতম পুরুষ সঙ্গী নির্বাচন করে নেয়। ডারউইন এ প্রক্রিয়াকে ‘যৌন বাছাই’ বলেছেন।
ফলে এর মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত সুস্থ ও টিকে থাকার লড়াইয়ে তুলনামূলক শক্তিশালি সন্তান জন্ম লাভের সম্ভাবনা তৈরি হয়। প্রজননের ক্ষেত্রে পুরুষের এ ভূমিকাকে অনেকদিন পরে হলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
যুক্তরাজ্যের একদল বিজ্ঞানী গবেষণার মাধ্যমে দেখেছেন যে, যৌন বাছাই বা প্রতিযোগিতার ফলে প্রজাতির জিনগত বৈচিত্র্য তৈরি হয়, যা তাদের সুস্বাস্থ্য, রোগমুক্তি, ও বিলুপ্তি রোধে খুব জরুরি। একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে, ধরুন একটি গোষ্ঠী যারা শুধু কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে বংশ বিস্তার করে যাচ্ছে। অকস্মাৎ যদি তাদের মাঝে নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, তাহলে তারা একসাথে সবাই মারা যেতে পারে। কারণ এখানে যৌন বাছাইয়ের মাধ্যমে জন্ম নেয়া বিভিন্ন জেনেটিক গুণ বা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন সন্তান নেই। যদি থাকতো তাহলে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালীরা বেঁচে যেত। আর একারণেই নারী একা সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে পারবে না।
এ পর্যায়ে অতিমাত্রায় নারীবাদীরা হয়তো বলবে ভিন্ন কথা, যদি একসময় ল্যাবরেটরিতেই তৈরি হয় উন্নত থেকে উন্নততর জেনেটিক গুণসম্পন্ন সন্তান? যদি নারীর স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে অথবা ভিন্ন কোন উপায়ে কৃত্রিম যৌনতায় সুখী হয়? তারা হয়তো আরও বলবে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভাষায় এতোদিন পর্যন্ত যা ছিল অন্য প্রাণীর সাথে মানুষের টিকে থাকার লড়াই, তা এখন একই প্রজাতির দুই লিঙ্গের মাঝেও এসে গেছে। যে বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ সেই-ই হয়তো শাসন করবে ভবিষ্যৎ পৃথিবী। এসব ‘হয়তো’ আর ‘যদি’ ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমরা বর্তমানের কথা চিন্তা করি। নারী আর পুরুষ দুইজন দুই মেরুর বাসিন্দা কখনও হতে পারে না। তারা একে অন্যের জন্যই সৃষ্ট। থাকুক না তারা আদর ভালবাসায় কাছাকাছি পাশাপাশি একে অন্যে লীন হয়ে।
তথ্য সূত্র:
নেচার, বিবিসি, মেইল অনলাইন সায়েন্স,
সায়েন্স ডেইলি।