সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: নতুন হ্যারি পটার, পাঠের নতুন ধরন এবং ধনী লেখককুল
হ্যারি পটার এন্ড দ্য কার্সড চাইল্ড
অবশেষে গত ৩১ জুলাই মধ্যরাতে প্রকাশিত হলো ২০১৬ সালের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত বইটি, হ্যারি পটার এন্ড দ্য কার্সড চাইল্ড। গভীর রাতেও হ্যারি পটার ভক্তরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল বইটি কিনতে। সবারই একটি কপি চাই। অধিকাংশ পাঠকই বয়সে তরুণ। জে কে রাউলিংয়ের জাদুকরী রচনায় হ্যারি পটার সিরিজের এর আগের সাতটি বইয়ের বেলাতেও একই দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। তবে এবার ব্যতিক্রম। হ্যারি পটার এন্ড দ্য কার্সড চাইল্ড আসলে একটি নাটকের বই। এই বইয়ের লেখক হিসেবে রাউলিংয়ের সাথে যুক্ত হয়েছেন আরো দুইজন। জে কে রাউলিং, জ্যাক থ্রোন এবং জন টিফানি রচিত মূল গল্পের উপর ভিত্তি করে এই নাটকের বই। দুই খন্ডে বিভক্ত এই নাটকের চিত্রনাট্য লিখেছেন জ্যাক থ্রোন। নাটকটির পরিচালক নির্মাতা টিফানি। প্রথম সংস্করণে প্রকাশিত হলো ৪.৫ মিলিয়ন কপি। বাজারে আসার প্রথম আটচল্লিশ ঘন্টায় নিঃশেষ হয়ে যায় ২ মিলিয়নেরও বেশী কপি।
২০০৭ সালে সর্বশেষ প্রকাশিত হয় ঔপন্যাসিক জে কে রাউলিংয়ের হ্যারি পটার সিরিজের সপ্তম বই হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ডেডলি হ্যালোজ। বর্তমান নাটকের বইয়ের গল্প শুরু হয় সেখান থেকেই যেখানে শেষ হয়েছিল হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ডেডলি হ্যালোজ-এর গল্প। বলা যায় এর পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ নিয়ে এগিয়েছে হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য কার্সড চাইল্ড। গল্পে দেখা যায় হ্যারি পটারের উনিশ বছর পরের জীবনকে। হ্যারির সাথে ডার্ক লর্ড ভল্ডেমর্টের মুখোমুখি হবার ১৯ বছর পর শুরু হয় নতুন গল্পটি। মধ্যবয়সী হ্যারি পটার এখন লন্ডন শহরের একজন ব্যস্ত সরকারী কর্মকর্তা। মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিক বা জাদু মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্বরত অবস্থায় কর্মব্যস্ত হ্যারি পটার মুখোমুখি হয় অতীত থেকে আসা অনাকাঙ্ক্ষিত এক সত্যের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এখানে হ্যারিকে পাওয়া যায় একজন পিতার ভূমিকায়। হ্যারি পটারের তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় পুত্র অ্যালবাস পটার। খ্যাতিমান পিতা আর পারিবারিক যশের ভার সামাল দেয়ার চেষ্টায় দেখা যায় অ্যালবাসকে।
তবে অনেক ক্ষুদে পাঠক বইটি হাতে পাওয়ার পর খানিকটা হতাশ হয়েছে। কেননা, এটি জে কে রাউলিং রচিত হ্যারি পটার সিরিজের অন্য বইগুলোর মত পূর্ণাঙ্গ গল্পের বই না। কোন কোন সমালোচকের মতে, এটি স্রেফ একটি নাটকের বই। কিভাবে রিহার্সাল করতে হবে, সংলাপ কি হবে, কিভাবে সেগুলো বলতে হবে, মঞ্চের সজ্জা কেমন হবে শুধু এসবই আছে বইটিতে।
রাউলিংয়ের লেখা হ্যারি পটার সিরিজের সাতটি বই পৃথিবীজুড়ে বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি কপি, অনূদিত হয়েছে মোট ৭৮টি ভাষায়। আর হ্যারি পটার সিরিজের আটটি সিনেমা বক্স-অফিসে আয় করেছে প্রায় ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার। সম্ভবত রাউলিং এবং তাঁর সৃষ্ট চরিত্র হ্যারি পটারের বিপুল জনপ্রিয়তাকেই এখানে ব্যবসায়িক উদ্দেশে কাজে লাগানো হয়েছে, এমনটি ভাবছেন অনেকে।
বই যখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম
“একটি বই নিন। যেকোন বই। বইটি পড়া যখন শেষ হবে এই শিল্পীকে একটি ইমেল করে জানান”।
এভাবেই সবাইকে বই পড়ায় উৎসাহ দিচ্ছেন শিল্পী শাহরিয়ার মালিক। বাস করেন নিউইয়র্ক শহরে। পেশায় একজন শিল্পী ও শিল্পনির্দেশক। কর্মরত আছেন একটি এড এজেন্সিতে। এই বছরের শুরুর দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন ব্রুকলিন ব্রিজের ওপর দিয়ে। অন্য অনেকের মত নিজের একটি সেলফি তুলেছিলেন ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা পোস্ট করতেও যাচ্ছিলেন আর সবার মতোই কিন্তু পোস্ট করার ঠিক আগ মুহূর্তে মালিকের মাথায় দ্বিতীয় একটি চিন্তা আসে। শাহরিয়ার মালিকের ভাষায়, ‘আমি সারা পৃথিবীর কাছে ভিন্ন কিছু শেয়ার করতে চাইছিলাম। এমন কিছু যা আরেকটু বেশী অর্থ বহন করে’। সোশাল মিডিয়া এখন আর ব্যক্তিগত কিছু নয়। এখানে আমরা সারা পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রাখতে পারি ও শেয়ার করতে পারি অনেক কিছু। কিন্তু বেশিরভাগ সময় সেলফি বা কোন ছবি, অথবা অন্য অনেক কিছু আমরা পোস্ট করি যার আসলে কোন অর্থ নেই। এমনকি আবেগও প্রকাশ করি এখানে আমরা। এভাবে আমাদের অনেককিছু অবস্তুগত হয়ে গেছে এবং প্রতিনিয়ত শেয়ার করা গুরুত্বহীন পোস্টে বোঝাই হয়ে গেছে আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। শিল্পী শাহরিয়ার মালিক বলেন,”আমি দেখতে চাচ্ছিলাম মানুষ কি এখনো বস্তুগত কিছু শেয়ার করতে চায়? সেই ইচ্ছেটা কি তাদের আছে”? এই ভাবনা থেকেই মালিকের ‘দ্য রিডিং প্রজেক্ট’ বা ‘বই পড়া প্রকল্প’-এর জন্ম। বেশ অভিনব কায়দায় তিনি মানুষকে বইয়ের প্রতি প্রলুব্ধ করছেন। প্রথমে শুরু করলেন নিজ শহর আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে। টাইমস স্কোয়ার, সাবওয়ে, দি হাইলাইন, সেণ্ট্রাল পার্ক–এরকম বিভিন্ন জনবহুল দর্শনীয় স্থান যেখানে সাধারণ জনগণ ও পর্যটকের আনাগোনা বেশী সেসব জায়গায় তিনি বেশ কিছু করে বই রেখে আসতে লাগলেন। কখনো লিফটে, কখনো প্লাটফর্মে কিংবা ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে, ব্রীজে, মাঝ রাস্তায় একগাদা করে বই রাখলেন। এরপর আমেরিকার অন্যান্য শহরগুলোতে একই কান্ড করতে লাগলেন।
এখন করছেন আমেরিকার বাইরেও। এমনকি কিছুদিন তাঁকে দেখা গেছে লন্ডন শহরে। বিবিসি কালচার বিভাগ শাহরিয়ার মালিকের অভিনব এই বইপড়া প্রকল্প নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মালিক কোথাও একবার বই রেখে আসার পর সেখানে আবার ফেরত গিয়ে দেখেন না বইগুলোর কি হলো। মালিক বলেন, ” আমি দেখতে চাই পৃথিবী এদের (বই) নিয়ে কী করে’? এজন্য তিনি প্রতিটি বইয়ের ভেতর একটি করে বুকমার্ক দিয়ে দেন। সেখানে তাঁর ইমেল ঠিকানা দেয়া থাকে। এবং আশা করতে থাকেন, যে মানুষটি তাঁর রেখে আসা বইগুলোর যেকোন একটি তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই মানুষটির পাঠানো একটি ইমেইল বার্তার। এখন পর্যন্ত তিরিশটিরও বেশি দেশের মানুষের কাছ থেকে ইমেল বার্তা পেয়েছেন শাহরিয়ার মালিক। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, বেলজিয়াম থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত। মালিক যে বইগুলো এখন পর্যন্ত রেখেছেন তাঁর সবগুলোই ছিল তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা বই। শিল্পী মালিক মনে করেন, বইগুলো তখনই মূল্যহীন আর প্রাণহীন হয়ে পড়ে যখন সেগুলো দিনের পর দিন অলসভাবে বুক শেলফে পরে থাকে, তাদের গায়ের ওপর ধূলো জমতে থাকে এবং যখন কেউ তাদের পাঠ করে না। বই পড়া প্রকল্পের জন্য তিনি খুব শীঘ্রই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে যাওয়া স্থির করেছেন। ব্রাজিল থেকে শুরু করার ইচ্ছে তাঁর। মালিক চান, বই যারা নিবেন তারা যেন অন্তত একবার বইটি পড়ে দেখবেন। না পড়ে যেন ইমেইল না করেন। সবচেয়ে বড় কথা, শাহরিয়ার মালিক বইয়ের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর অচেনা অজানা অনেক মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন। আর এর মাধ্যমে এমন কিছু অর্জন করতে পারছেন যা ইন্সটাগ্রামে একটি ছবি পোস্ট করার মাধ্যমে কখনোই সম্ভব হতো না। এরপর যদি আপনি আপনার শহরে কোথাও একগাদা বই পড়ে থাকতে দেখেন নিশ্চয়ই অবাক হবেন না।
পৃথিবীর উদ্দেশে মালিকের বার্তাটি পরিষ্কার: “share books, not selfies”.
বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী লেখক যারা
অতিসম্প্রতি আমেরিকার বিজনেস ম্যাগাজিন `ফোর্বস’ বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বেশী আয় করা লেখকদের তালিকা প্রকাশ করেছে। যারা তাদের লেখার পারিশ্রমিক বাবদ সবচেয়ে বেশি আয় করেন ক্রমানুসারে তাদের নাম স্থান পেয়েছে তালিকায়। সবার শীর্ষে আছেন থ্রিলার লেখক জেমস প্যাটারসন। গত ১২ মাসে তিনি তাঁর লেখনী থেকে আয় করেছেন ৯৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বিশাল পরিমাণ অংক তাঁকে খুব সহজেই স্থান করে দিয়েছে তালিকার শীর্ষে। শুধু তাই নয় চলতি বছরসহ টানা তিনবছর ধরে তিনি এই অবস্থান ধরে রেখেছেন। অন্যদিকে, আয়ের দিক থেকে প্যাটারসনের চাইতে বেশ কিছুটা পিছিয়ে থেকেও দ্বিতীয় স্থানটি পেয়েছেন শিশুসাহিত্যিক জেফ কেনি। ১৯.৫ মিলিয়ন ডলার আয় করে একধাপ এগিয়ে আছে কেনি, হ্যারি পটার খ্যাত রাউলিংয়ের চেয়ে। তৃতীয় স্থানে থাকা জে কে রাউলিংয়ের আয় ১৯ মিলিয়ন ডলার।
সবচেয়ে পারিশ্রমিক পাওয়া মোট পনের জন লেখকের নাম প্রকাশ করেছে ম্যাগাজিনটি। একই অংকের আয় হওয়ার কারণে একই অবস্থানে আছে একাধিক লেখক। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আয় করা এই লেখকদের মাঝে ছয়জনই নারী। জে কে রাউলিং ছাড়া অন্য নারী লেখকরা হচ্ছেন, প্রেম ও রোমান্সের রচিয়তা হিসেবে খ্যাত ড্যানিয়েল স্টিল, অপরাধ ও রোমান্স লেখক নোরা রবার্টস। দুজনেই ১৫ মিলিয়ন করে আয় করে লেখক স্টিফেন কিংয়ের সাথে আছেন তালিকার পাঁচ নম্বরে । অন্যদিকে ফিফটি শেডস অব গ্রে উপন্যাসের রচয়িতা যিনি সাহিত্যজগতে যৌনতাকে দিয়েছেন নতুন মাত্রা, ই এল জেমস ১৪ মিলিয়ন আয় করে একাই আছেন আট নম্বরে। ভেরোনিকা রোথ ১০ মিলিয়ন আয় করে আছেন তালিকার নবম স্থানে। ১৯৮৮ সালে জন্ম নেয়া ভেরোনিকা তালিকার সবচেয়ে কমবয়সী সাহিত্যিক। অন্যদিকে অর্থনীতি বিষয়ক সাবেক একজন সাংবাদিক যিনি বর্তমানে জনপ্রিয় ও বেশি আয় করা লেখক হিসেবে তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন পলা হকিংস। তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস গার্ল অন দ্য ট্রেন সাহিত্যক্ষেত্রে নতুন বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। পলা হকিংস বিশ্বের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত লেখকদের তালিকায় নিজের নামটি যোগ করার সামর্থ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে এই ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য অনেকটা দূর করতে পেরেছেন।
২০১৬ সালের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া (মার্কিন ডলার) ফোর্বসের দেয়া তালিকাটি এখানে দেয়া হলো:
১। জেমস প্যাটারসন, ৯৫ মিলিয়ন ডলার
২। জেফ কেনি, ১৯.৫মি
৩। জে কে রাউলিং ১৯ মি
৪। জন গ্রিসাম ১৮মি
৫। স্টিফেন কিং ১৫মি
৬। ড্যানিয়েল স্টিল ১৫মি
৭। নোরা রবার্টস ১৫মি
৮। ইল এল জেমস ১৪মি
৯। ভেরোনিকা রোথ ১০ মি
১০। জন গ্রীন ১৪মি
১১। পলা হকিংস ১০মি
১২। ড্যান ব্রাউন ৯মি
১৩। জর্জ আর আর মার্টিন ৯.৫মি
১৪। রিক রিওদান ৯.৫ মি