সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতি: বিদায় আব্বাস, বিদায় বনফয়

সমসাময়িক চলচ্চিত্রের ইতিহাস যদি আপনি লিখতে বসেন তাহলে চাইলেও কিছুতেই যার নামটি আপনি বাদ দিতে পারবেন না তিনি হলেন-আব্বাস কিয়ারোস্তামি। হলিউডের রুক্ষ সংস্করণের বিপরীতে চলচ্চিত্রে তিনি নিয়ে এসেছিলেন কাব্যময়তা। যা ছিল অত্যন্ত পরিশালীত ও স্ব-অর্জিত, একই সাথে আধুনিক অতিন্দ্রিয়তার প্রতিফলন। তাঁর চলচ্চিত্রেরর প্রতিটি অংশেই তাঁর নিজস্বতা ছিল। তিনি নিজেও ছিলেন কবি। তিনি এ যুগের চলচ্চিত্রের কবি। নিজের মাতৃভূমি ইরানকে তিনি উপস্থাপন করেছেন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে। ইরানের সংস্কৃতি, ইতিহাস, সামাজিক জীবনধারাকে সারা পৃথিবীর কাছে পরিচিত করিয়েছেন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এমনকি দেশটিতে ইসলামিক বিপ্লবের পরেও তিনি দেশ ত্যাগ করেননি। বরং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তাঁর কাব্যিক ঝঙ্কার অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্র মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের নিবিড় অথচ সুক্ষ্ম বর্ণনা। বর্ণনা এমন রহস্যময় পরাবাস্তব আবহ সৃষ্টি করে যে আপনার মনে হবে যেন আপনি এই জগতে থেকেও নেই। কোথাও হারিয়ে গেছেন। এভাবেই একজন আব্বাস কিয়ারোস্তামী হয়ে ওঠেন রুপালী রূপকথাকার, কখনো কবি। আব্বাস ছিলেন বর্তমান পৃথিবীর একজন প্রধানতম ‘ওটার’। মানে হল যিনি একই সাথে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা, পরিচালনা, প্রযোজনা, শব্দ ও সুর সংযোজন, চিত্রগ্রহণ এবং সম্পাদনা করতে পারতেন। বলা যায় চলচ্চিত্র নির্মানে তিনি সর্বময় গুণের অধিকারী ছিলেন। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রতিটি অংশে ছিল স্বকীয়তার ছাপ। নিজ গুনেই সুপ্রসিদ্ধ এই নির্মাতা হয়ে ওঠেন পৃথিবীর রুপালী জগতের কিংবদন্তী। জীবনের বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। ১৯৪০ সালে ইরানের তেহরান শহরের জন্ম নেন আব্বাস। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রকলা নিয়ে পড়াশোনা করেন। কর্মজীবনের শুরু গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে ইরানিয়ান টেলিভিশনের জন্য বেশকিছু বিজ্ঞাপন নির্মানের মাধ্যমে। ১৯৬৯ সালে –’কানুন’ নামে একটি সংগঠনে যারা শিশু কিশোরদের মানবীয় বৃদ্ধিবিকাশ নিয়ে কাজ করে। এখানকার ফিল্ম ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব নিয়ে প্রায় এক যুগ কাজ করার সময় শিশুদের নানান সমস্যা নিয়ে বেশ কটি চলচ্চিত্র তৈরি করেন। পরবর্তীতে নিজেই স্বনির্ভর চলচ্চিত্রকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এ সম্পর্কে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে আব্বাস বলেন, “শুরতে যা ছিল শুধুই চাকরী পরে তা ক্রমশ আমাকে একজন শিল্পী হয়ে উঠতে সাহায্য করে”। ১৯৯৭ সালে নির্মিত’টেস্ট অফ চেরি’ চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক কান চলচ্চিত্র উৎসবে সর্ব্বোচ্চ ‘পাম দোর’ পুরস্কার অর্জন করে। ১৯৭০ সাল থেকে নিয়মিত ভিন্ন ধারার ডকুমেন্টরি, স্বল্প ও পূর্ণ-দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মান করে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন এই চলচ্চিত্রকার। আজ যে সারা পৃথিবীতে ইরানী চলচ্চিত্রের জয়জয়কার তা মূলত আব্বাসের বদৌলতে। কেননা, তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে চলচ্চিত্র নির্মানে তাঁর বৈশিষ্ট্য ও ভাবধারা সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন তাঁর উত্তরসূরি ইরানী চলচ্চিত্রকারদের মাঝে। তিনি নিজে প্রভাবিত ছিলেন সত্যজিৎ রায়, ভিত্তোরিও দে সিকা ও জাক তাতি’র কাজ দ্বারা।

খোমেনী বিপ্লব সংগঠিত হবার পরেও তিনি ইরানে থেকেই যান। এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও চলচ্চিত্র নির্মান অক্ষুণ্ন রাখেন। কখনো শান্ত ধ্যানমগ্ন প্রশান্তি, বিষণ্ণতা, আবার কখনো কৌতুকপূর্ণ রসবোধের মাধ্যমে তির্যকভাবে ভিন্নমতের উপস্থাপন ঘটান তাঁর চলচ্চিত্রে। তাই তাঁর চলচ্চিত্রগুলো হয়ে ওঠে মানুষের আবেগীয় ভাববিনিময়, জীবনের দর-কষাকষির এক মানসিক মুক্তির জায়গা। এ প্রসঙ্গে আব্বাস বলতেন-“একটি গাছ যে মাটিতে তার শিকড় ছড়িয়েছে, তার জায়গা পরিবর্তন করে যদি তুমি আরেক স্থানে নিয়ে গিয়ে বসাও তাহলে তার কাছ থেকে তুমি আর ফলন আশা করতে পার না- আমিও অনেকটা এই গাছের মতোই।”

২০১৬ সালের মার্চে আব্বাস কিয়ারোস্তামীর শরীরে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ক্যান্সার শনাক্ত হয়। চিকিৎসা ও ধারাবাহিক কয়েকটি অস্ত্রোপচারের জন্য তিনি ফ্রান্সের প্যারিসে আসেন গত জুন মাসে। এখানেই গত ৪ জুলাই ৭৬ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহান পরিচালক। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁরই স্বদেশী অস্কার জয়ী চিত্রপরিচালক আসগর ফারহাদি বলেন-” এই মৃত্যুর ফলে পৃথিবীর চলচ্চিত্র জগত একজন মহান পরিচালককেই শুধু হারালো না বরং বিশ্ব হারিয়েছে একজন মহান মানুষকেও- তিনি শুধু একজন পরিচালক ছিলেন না, তিনি এমন একজন ছিলেন যিনি ব্যক্তিজীবন ও সিনেমা উভয় ক্ষেত্রেই এক অত্যাধুনিক অতিইন্দ্রিয়তার সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। তাঁর দেখানো পথে ও তাঁর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে নতুন প্রজন্মের অনেক ইরানী চলচ্চিত্রে সক্রিয় হয়েছে”।

আব্বাস কিয়ারোস্তামী নির্মিত উল্লেখযোগ্য দশটি চলচ্চিত্রের নাম দেয়া হলো। এখানে একটি একটি ঐতিহাসিক পটভূমি ও ক্রমধারাবাহিকতা নজরে রেখেই এই নামগুলো দিলাম। যেকোন চলচ্চিত্রপ্রেমী এই সিনেমাগুলো দেখলে পরিচালক হিসেবে আব্বাসের বিবর্তন ও উন্নয়ন বুঝতে সক্ষম হবেন। একই সাথে পরাবাস্তব অবিশ্বাস্য এক অনুভূতি লাভ করবেন।

১। দি ট্রাভেলার (১৯৭০)।

২। দি রিপোর্ট (১৯৭৭)।

৩। হয়ার ইজ দি ফ্রেন্ড’স হোম (১৯৮৭)।

৪। ক্লোজআপ (১৯৯০)।

৫। লাইভ এন্ড নাথিং মোর (১৯৯১)।

৬। থ্রো দি অলিভ ট্রি’স (১৯৯৪)।

৭। টেস্ট অব চেরি (১৯৯৭)।

৮। দি উইন্ড উইল ক্যারি আস (১৯৯৯)।

৯। টেন (২০০২)।

১০। সার্টিফায়েড কপি (২০১০)।

মারা গেলেন ফরাসী কবি ইভ বনফয়

ফ্রান্সের আধুনিক কবিদের মধ্য অন্যতম ইভ বনফয় মারা গেলেন গত ১ জুলাই। বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। ইভ বনফয়-এর শতাধিক বই পৃথিবী জুড়ে অনূদিত হয়েছে প্রায় ৩০টি ভাষায়। তিনি নিজেও সুপরিচিত একজন অনুবাদক ছিলেন, লিখতেন গদ্যও। ছিলেন শিল্প সমালোচক। ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করেছেন উইলিয়াম শেক্সপিয়রের নাট্যসমগ্র। আরো অনুবাদ করেছেন কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস, জন ডান, পেত্রার্ক-এর কবিতাও।

কিন্তু তিনি তাঁর সুররিয়েলস্টিক কবিতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ১৯২৩ সালে ফ্রান্সে টুরস’এ জন্ম নেয়া ইভ বনফয়ের প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে।

বনফয় তাঁর কবিতাকে বলতেন “ভাষার সত্য” যার মাধ্যমে তিনি জীবনের তাৎক্ষণিক উপলব্ধি অনুসন্ধান করতেন।

ফ্রান্সের অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘কলেজ দ ফ্রান্স’ এর কবিতার উপরে পড়িয়েছেন ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। একই বিষয়ে আমেরিকায় পড়িয়েছেন বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের ফ্রান্সের কবিদের মধ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে কবি ইভ বনফয়কে ধরা হয়ে থাকে।

আবারো ইতিহাস গড়লো পাবালো পিকাসো

কিউবিজম চিত্রকলার ইতিহাসে এবার রেকর্ড দামে বিক্রি হয়ে ইতিহাস গড়ল পাবালো পিকাসো’র Femme Assise’ চিত্রকর্মটি। এক নিলামে চিত্রকর্মটি বিক্রি হলো ৬৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারে। এ জাতীয় চিত্রকলা বিক্রির ক্ষেত্রে যা রেকর্ড। ধারণা করা হয় ১৯০৯ সালের গ্রীষ্মে চিত্রকর্মটি এঁকেছিলেন পাবালো পিকাসো। যখন তিনি প্রত্যন্ত স্প্যানিশ গ্রাম ওরতা দে এবরো ভ্রমণ করছিলেন ( Horta de Ebro)। জুনের ২২ তারিখ লন্ডন শহরের সোথেবে’স নিলাম ঘরে এই কান্ড ঘটে। ধারণা করা হচ্ছে কিউবিস্ট ঘরানার চিত্রকর্ম নিলামের ইতিহাসে এটিই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।


তথ্যসুত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান, দি নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসি।

Shopping Cart