গরীবদের জন্য ভিক্টর হুগোর আবেদন
” দয়া করে আপনার দেশের দরিদ্র মানুষের জন্য ১০০ ফ্রাঁ দান করুন” । – সম্প্রতি ভিক্টর হুগোর এমন একটি আবেদন সম্বলিত লেখনি নিলামে তোলা হলো। দারিদ্র্যের প্রতি সংবেদনশীল, দরিদ্র মানুষের রক্ষক হিসেবে তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত। ভিক্টর হুগো রচিত বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ লা মিজারেবল উপন্যাস যেখানে তিনি নির্যাতিত শোষিত বারবণিতা ফাতিনে ও তার কন্যা সন্তান কসেত্তের মাধ্যমে তৎকালীন ফ্রান্সের নিঃস্ব অভাবগ্রস্ত মানুষের চিত্র তুলে ধরেছেন। জা ভলজা এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র যিনি তার বোনের সাতটি ক্ষুধার্ত সন্তানের জন্য এক টুকরো রুটি চুরি করতে গিয়ে ১৯ বছর জেল খাটেন। তার বহুলআলোচিত বাক্য ‘১০০ ফ্রাঁ দিন’ এই কথায় মানুষের প্রতি উদার হবার আহ্বান ছিল। ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে দরিদ্রের জন্য যা রীতিমতো প্রবাদবাক্য আর স্লোগান হয়ে উঠেছিল। হুগো তাঁর মৃত্যুর আগে যে উইল করে গেছেন, সেখানে উল্লেখ আছে , ” আমি ৫০০০০ ফ্রাঁ গরীবদের জন্য রেখে গেলাম। আমার সৎকার যেন তাদের মতোই করা হয়। আমি চার্চের মরণোত্তর অন্তেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান প্রত্যাখ্যান করছি। সকল আত্মার শান্তি কামনা করছি। আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি”।
পেনসিলভিয়ানার ঐতিহাসিক-অটোগ্রাফ-সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান ‘দি রাব কালেকশন’ হুগোর তারিখবিহীন উক্ত নোটটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী থেকে সংগ্রহ করে। তারা জানান, যদিও হুগো তাঁর এধরনের অনুভূতির কথা আগেও প্রকাশ করে থাকবেন কিন্তু গবেষকরা এর আগে মাত্র একবারই তাঁর লেখা নোট প্রকাশ করে এরকম উদাহরণ দিতে পেরেছিলেন’। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে হুগোর নিজের লেখা এই দুর্লভ নোটটি কতখানি ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। প্রতিষ্ঠানটির মতে, ‘হুগো হৃদয়ের অন্তস্থল থেকেই ছিলেন নৈতিকতার পথনির্দেশক’। তাঁর বার্তাটি পরিষ্কার: দরিদ্রকে সাহায্য করা আপনার কর্তব্য। আর এটিই তাঁর অন্তিম ইচ্ছা ছিল। দীর্ঘ আঠার বছর ধরে লেখা লা মিজারেবল প্রকাশিত হয় ১৮৬২ সালে। হুগো মারা যান ১৮৮৫ সালে প্যারিসে। তাঁকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দাফন করা হয়। তবে তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী কোনো গরীব ব্যক্তির মৃত্যু হলে, কফিন বহন করার জন্য যে গাড়ি বা শবযানটি ব্যবহার করা হতো সেটি ব্যবহার করেই তাঁর মৃতদেহ বহন করা হয়েছিল ।
প্রকাশক লে ফিগারো, হুগোর মৃত্যু সংবাদ প্রচার করবার জন্য সে সময় তাঁর পত্রিকার প্রথম পাতাটি উৎসর্গ করেছিলেন।
‘গাড়ির নাম বাসনাপুর’-এর দ্বিতীয় যাত্রা
বাংলাদেশের সমালোচনা সাহিত্যকে যারা নিখুঁত শিল্পজ্ঞান ও উচ্চতর রুচির সমন্বয়ে গড়ে তুলেছিলেন তাদের মধ্যে উজ্জ্বলতম শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধরী। সামাজিক ও শৈল্পিক দায়বদ্ধতা থেকে যিনি বিশ্বসাহিত্যের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। শেক্সপিয়র, বার্নাড শ, স্ট্রিন্ডবার্গ –এদের কাজগুলোর মূল ভাব বজায় রেখে কিভাবে দেশীয় ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করা যায় তিনিই আমাদের তা শিখিয়েছিলেন। রূপান্তরের কাজ শুরু করেছিলেন বিশ্বসাহিত্যের আরেক পুরোধা নাট্যকার টেনেসি উইলিয়ামের এ স্ট্রিট কার নেমড ডিজায়ার নাটকের। বাংলায় যে নাটক আমাদের কাছে গাড়ির নাম বাসনাপুর হিসেবে পরিচিত। অসাধারণ মেধা আর শিল্পসৃষ্টির ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষটি হিংস্রতার শিকার হয়েছিলেন ১৯৭১-এ আমাদের চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র দুদিন আগে। পাক হানাদার ও তাদের সহযোগীরা তাকে অপহরণ ও হত্যা করে। এই মৃত্যু তাকে শেষ করতে দেয়নি তার বহু অস্পূর্ণ কাজকে। গাড়ির নাম বাসনাপুর ছিল তার সেই অসম্পূর্ণ কাজগুলোর একটি। পরে এটিকে সম্পূর্ণতা দেন তাঁরই সহধর্মিণী নাট্যপ্রাজ্ঞ লিলি চৌধুরী।
এর মাধ্যমে আমরা পরিচিত হই আমেরিকান নাট্যকার টেনেসি উইলিয়ামের সাথে, যিনি নাটক লিখে দু দুবার পুলিৎজার পুরষ্কার জয় করেন । ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত এ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার সেবার আমেরিকার বর্ষসেরা নাটক হিসেবে পুলিৎজার লাভ করে । আর দ্বিতীয় পুরস্কারটি পান দ্য ক্যাট অন হট টিন রুফ (১৯৫৫) নাটকটির জন্য। এছাড়া টেনেসি উইলিয়াম রচিত দ্য গ্লাস অফ মিনাজিরি (১৯৪৫) , দ্য রোজ ট্যাটু (১৯৫১) সুইট বার্ড অফ ইউথ (১৯৫৯) দ্য নাইট অফ ইগোয়ানা (১৯৬১) নাটকগুলো আজও দর্শকদের মন জয় করে রেখেছে। সম্প্রতি এই নাট্যকারের জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে হলিউডের ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানি ব্রড গ্রীন পিকচারস। ১৯৪৫ সালে নিউইয়র্কের ব্রডওয়েতে প্রথম পাওয়া মঞ্চ সাফল্য থেকে ১৯৮৩ সালে সেই একই শহরের এক হোটেলের নির্জন কক্ষে তাঁর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু– সবই তুলে ধরা হবে এই চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্রটি যাতে যথার্থ একটি বায়োপিক হয় তার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে আমেরিকান এই প্রতিষ্ঠানটি। আর এ জন্য বেছে নেয়া হয়েছে ‘দ্য নিউইয়র্কার’ পত্রিকার সাবেক লেখক ও মঞ্চ সমালোচক জন লাহর রচিত Tennesse Williams: Mad Pilgrimage of the Flesh বইটি। ২০১৪ সালে প্রকাশিত এই বইটি এরই মধ্যে ন্যাশনাল ক্রিটিক এওয়ার্ড, শেরিডান মরলে প্রাইজ ফর থিয়েটার বায়োগ্রাফি’সহ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। এখন বইটির কাহিনীকে চলচ্চিত্রের উপযোগী করে তোলার জন্য একজন চিত্রনাট্যকার খোঁজা হচ্ছে। এ বছর জুনে ‘ইডেন’ এবং সেপ্টেম্বরে ‘নাইটিনাইন হোমস’ চলচ্চিত্র দুটি দারুনভাবে ব্যবসা সফল হবার পর ব্রড গ্রীন পিকচারসের এই নতুন প্রজেক্ট। অনেকেই হয়তো ভাববেন, মার্কিন মুলুকে আর্থার মিলার অথবা ইউজিন ও’নীল-এর মতো বাঘা বাঘা সব নাট্যকার থাকতে টেনেসি উইলিয়াম কেন? তাহলে জন লাহর ভাষায় বলতে হয়, আমেরিকান নাট্যকারদের মধ্যে জীবনীগ্রন্থ বা চলচ্চিত্রের জন্য টেনেসি উইলিয়াম এক কথায় অনবদ্য এবং অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের যন্ত্রণা, বৈচিত্র্য, নাটকীয়তা, রহস্য ও গোপনীয়তা যেকোন রোমাঞ্চ গল্পকেও হার মানায় যেগুলোর ছাপ পাওয়া যায় তাঁর লেখা প্রতিটি নাটকে। নাট্যকার টেনেসি উইলিয়ামের পুঙ্খানুপুঙ্খ ও দীর্ঘ জীবনী রচনা করেছেন জন লাহর। উইলিয়াম সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য উপাত্ত, জার্নাল, সাক্ষাৎকার সব কিছু বিশ্লেষণে এনে রীতিমতো গবেষণা করেছেন এই লেখক। উইলিয়ামের শৈশব, প্রথম সাফল্য, জীবনের উত্থান পতন, ব্যর্থতা থেকে শুরু করে তাঁর যৌনতা, সমকামিতা ও স্নায়ুবিকার, নাটকীয় সাফল্য, নিঃসঙ্গতা, চূড়ান্ত পতন, অবশেষে একাকী মৃত্যু–সবই তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। কাহিনীর দীর্ঘতা সত্ত্বেও জন লাহর স্বতঃস্ফূর্ত লেখনীর ফলে কখনো তা আকর্ষণ হারায়নি। চমৎকার এই বইটির গভীরতা বিচার করলে আজকের যুগের এটি একটি মহান জীবনীগ্রন্থ রূপেরই বিবেচিত হয়। এখন দেখার বিষয়, এই বই অবলম্বনে তৈরি হতে যাওয়া চলচ্চিত্রটি উইলিয়ামের জীবনকে বড় পর্দায় কতখানি মেলে ধরতে পারে।
তথ্যসূত্র : দি গার্ডিয়ান।
আর্টস বিভাগে প্রকাশিত বিপাশা চক্রবর্তীর আরও লেখা: