সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: যাদুবাস্তবতার শাহেনশাহ মার্কেসের মানসিক গ্রন্থাগার

গার্সিয়া মার্কেসের মানসিক গ্রন্থাগার

সম্ভবত প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্কের একটি অংশে তাঁর প্রিয় বইগুলোর নাম সংরক্ষিত থাকে। অনেকটা অনলাইন পোর্টালের মতই বইগুলোর নাম লেখক ঘটনা সংলাপ চরিত্র বই পঠনের ফলে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি সংরক্ষিত থাকে মানুষের মনোজগতে। আর এই অদৃশ্য অংশকে আমরা বলতে পারি মানসিক গ্রন্থাগার যার ভূমিকা সেই মানুষটির জীবনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রিয় বইগুলি একজন মানুষের জীবনের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা কাঠামোর মূল ভিত্তি। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও মূল্যবোধের সহায়ক অবিচ্ছেদ্য শক্তি। আর সেই মানুষটি যদি হন বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন কথাসাহিত্যিক, তাহলে পাঠকমাত্রই আকুল হবেন তাঁর প্রিয় বইগুলোর নাম জানবার জন্য। বলছি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের কথা। নিঃসঙ্গতার একশ বছর উপন্যাসের জন্য যিনি আমাদের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত। অসাধারণ রচনাশৈলী ও গদ্যভঙ্গির জন্য কেবল দক্ষিণ আমেরিকা আর স্প্যানিশ ভাষাভাষীদের কাছেই নয়, বরং সমগ্র পৃথিবীতে তিনি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।

২০১৪ সালে ১৭ এপ্রিল দূরারোগ্য লিম্ফেটিক ক্যান্সারে মারা যাবার আগে যিনি আমাদের বলে গিয়েছেন লিভিং টু টেল দ্য টেইল এর মতো এক উজ্জ্বলতার গল্প যেখানে তিনি জানিয়েছেন, “জীবন তো কেবল বেঁচে থাকা নয়। জীবন হচ্ছে সেটাই যা আপনি মনে রাখছেন । জীবনের ঘটে যাওয়া সেইসব স্মৃতি যা আপনি স্মরণ করেন, বর্ণনা করেন, আর যেভাবে যে প্রক্রিয়ায় করেন সেটাই আসলে কারো জীবন”।

১৯২৭ সালে কলাম্বিয়ার উপকূলীয় শহর আরাকাতাকায় জন্ম নেন মার্কেস আর এখান থেকেই শুরু লিভিং টু টেল দ্য টেইল-এর গল্প। মার্কেসের শৈশব কৈশোর বোর্ডিং স্কুলে পড়ার দিনগুলো সাংবাদিকতা ও কর্মজীবন, ১৯৫০-এ দীর্ঘদিনের প্রেমিকা মের্সেদেস বারচাকে প্রিয়তমা স্ত্রীরূপে পাবার জন্য পাণি-প্রার্থনা–এসব কিছু বর্ণিত হয়েছে এই আত্মজীবনীতে। কিন্তু একজন পাঠক হিসেবে আপনার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে মার্কেসের লেখক হয়ে ওঠার গল্পটি। নিশ্চয়ই আপনার জানতে ইচ্ছে করছে মার্কেসের প্রিয় সেইসব বইগুলোর নাম, যা এই মহান লেখকের জীবন ও শিল্পীসত্তার মূল ভিত্তি ছিল। যে বইগুলো তাকে শিহরিত করেছিল, জাগিয়ে রেখেছিল রাতের পর রাত, উত্তেজিত করেছিল, আলোড়িত করেছিল তাঁর মনোজগৎ, সর্বোপরি প্রলুব্ধ করেছিল তাকে লেখক হবার জন্য। সেই বইগুলোর কথা তিনি নিজেই জানিয়ে গেছেন আমাদের।

চলুন, জেনে নিই সেই অমূল্য রত্নের নামগুলো।

১। ম্যাজিক মাউন্টেন, টমাস মান।

২। দ্য ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক, আলেকজান্ডার ডুমা।

৩। ইউলিসিস, জেমস জয়েস।

৫। এজ আই লে ডাইয়িং, উইলিয়াম ফকনার।

৬। দ্য ওয়াইল্ড পাম, উইলিয়াম ফকনার।

৭। ওউদিপাস রেক্স, সফোক্লেস।

৮। দ্য হাউজ অব দ্য সেভেন গেবলস, নাথানিয়েল হথর্ন।

৯। আংকল টমস কেবিন, হেরিয়েট বিচার স্টো।

১০। মবিডিক, হারমান মেলভিল।

১১। সনস এন্ড লাভারস, ডি এইচ লরেন্স।

১২। দ্য এরাবিয়ান নাইটস

১৩। দ্য মেটামরফসিস, ফ্রানজ কাফকা।

১৪। দ্য আলেফ এন্ড আদার স্টোরিজ, হোর্হে লুইস বোর্হেস।

১৫। দ্য কালেক্টড স্টোরিজ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে।

১৬। পয়েন্ট কাউন্টার পয়েন্ট, অলডাস হাক্সলি।

১৭। অফ মাইস এন্ড ম্যান, জন স্টেইনব্যাক।

১৮। দ্য গ্রেপস অব র‌্যাথ, জন স্টেইনব্যাক।

১৯। টোব্যাকো রোড, আরস্কিন কডওয়েল।

২০। স্টোরিজ, ক্যাথরিন ম্যানন্সফিল্ড।

২১। ম্যানহাটন ট্রান্সফার, জন ডস প্যাসোস।

২২। প্রোর্ট্রেট অফ জেনি, রবার্ট নাথান।

২৩। অরল্যান্ডো, ভার্জিনিয়া উলফ।

২৪। মিসেস ডালওয়ে, ভার্জিনিয়া উলফ।

ম্যাজিক মাউন্টেন কিংবা আয়রন মাস্ক, কৈশোরে বন্ধুদের সাথে দার্শনিক ঝগড়া আর রোমান্সের শুরু এই বইগুলো পাঠের মাধ্যমে। জেমস জয়েসের ইউলিসিস ছিল যেন আরেকটা বাইবেল! প্রিয় লেখক উইলিয়াম ফকনারের কাছ থেকে শিখেছিলেন কিভাবে লেখনীর সরলতা আর সাবলীলতার সৌন্দর্যও তীক্ষ্ণ ও অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে। ওউদিপাস রেক্স, সফোক্লেস-এর পরিপূর্ণ এই সৃষ্টিকর্ম পাঠ করার মাধ্যমে মার্কেস অনুভব করেছিলেন ভাল ভাল বই পড়া ভাল লেখক হবার জন্য সাহায্য করতে পারে কিন্তু খুব ভাল লেখক হতে গেলে গ্রিক ক্লাসিকস অবশ্যই পাঠ করতে হয়। দ্য হাউজ অব দ্য সেভেন গেবলস-এর মতো বই মার্কেসকে কল্পনা, একাকিত্ব বা স্মৃতিকাতরতা নয় বরং জীবন ও বাস্তবতা সম্পর্কে অনুভব করতে শিখিয়েছিল। অন্যদিকে, সহস্র এক আরব্য রজনীর গল্পগুলো পড়তে গিয়ে মার্কেসের মনে হয়েছে, একটি কার্পেটে চড়ে শহরের পর শহর,পাহাড় পর্বত মরুভূমির উপর দিয়ে উড়ে বেড়ানো কিংবা একটি দৈত্যকে শাস্তিস্বরূপ একটি বোতলে দু’শ বছরের জন্য বন্দী করে ফেলা আজকের যুগের পাঠকের জন্য বিশ্বাসযোগ্য মনে না হলেও যখন কেউ এসব কল্পকথা পাঠ করেন তখন তার পাঠক হৃদয় সেইসব কল্পনাকে বিশ্বাস করেই পাঠ করেন। কারণ লেখক এখানে পাঠককে তা বিশ্বাস করিয়ে ছাড়েন আর এখানেই একজন লেখকের সার্থকতা।

কলেজের দিনগুলোতে বন্ধুদের কাছে বই ধার নেয়া, বিনিময় করে পড়া ব্যাপারটি ছিল। একদিন এক বন্ধু ভার্জিনিয়া উলফের কিছু বই মার্কেসের হাতে ধরিয়ে দেয়। এর মধ্যে বিশেষ করে মিসেস ডালওয়ে আর অরল্যান্ডো পাঠের মাধ্যমে অন্যরকম আনন্দ পান, সেই থেকে ভার্জিনিয়া উলফ মার্কেসের প্রিয় হয়ে ওঠেন। এভাবেই একরাতে এক বন্ধুর কাছে থেকে ধার নিয়ে মার্কেস যে বইটি পড়া শুরু করেছিলেন, সেই বইটিই মার্কেসের লেখক হয়ে ওঠার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিল। ফ্রানজ কাফকার মেটামরফসিস। হ্যাঁ এই বইটি পড়ার পর থেকে মার্কেস আর আগের মতো নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেননি। মনে আছে, বিশ্বসাহিত্যের সেই অবিস্বরণীয় চরিত্র গ্রেগর সামসা’র কথা? দুঃস্বপ্নে কাটানো এক রাত শেষে ভোর বেলায় যিনি বিছানায় নিজেকে দেখতে পান প্রকান্ড এক পোকায় রূপান্তরিত হয়েছেন। মেটামরফসিস-এর প্রথম লাইনের কথাগুলো পড়ার সাথে সাথেই যেন পাল্টে গেল মার্কেসের জীবন। মার্কেসের নিজের ভাষ্য অনুযায়ী, ” এখানে বিস্তারিত সত্য অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয় না, লেখকের বর্ণনাকৌশলের শক্তি ও সামর্থ্যই এই রচনাকে পাঠকের নিকট সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য যথেষ্ট”। এক সাক্ষাৎকারে মার্কেস বলেন “… এভাবে যে কেউ লিখতে পারে সেটাই তো আমার অজানা ছিল, এটা যদি জানা থাকতো তাহলে আমি আরো আগেই লেখালেখি শুরু করতাম। এরপর আর দেরী না করে, আমি ছোটগল্প লেখা শুরু করি”। আর এখান থেকেই একজন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের লেখক হয়ে ওঠার শুরু। সাহিত্যবিশারদদের মতে লুইস বোর্হেস এবং হুলিও কোর্তাসারের পাশাপাশি মার্কেস ছিলেন বিংশ শতকে দক্ষিণ আমেরিকার শ্রেষ্ঠ লেখক। বিশ্বব্যাপী অত্যধিক জনপ্রিয়তার কারণে এই মহান লেখকের নাম উচ্চারিত হয় লেভ তলস্তয়, চার্লস ডিকেন্স, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সঙ্গে একই উচ্চতায়। মার্কেসকে বলা যেতে পারে জাদুবাস্তবতার শাহেনশাহ। লেখার মূল উপজীব্য বিষয়কে বাস্তবে প্রোথিত রেখে কল্পনার ডালপালা ছড়িয়ে দিতেন মার্কেস। তাঁর গদ্যভঙ্গিমার জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন বর্ণনাকে, সংলাপ ছিল কম। চরিত্রগুলোর আচার আচরণ ইত্যাদির নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে পাঠককে বুঝিয়ে দিতেন চরিত্রগুলো সম্পর্কে। কল্পনার আশ্রয়ে রচিত লেখার মাঝে রাজনৈতিক দিগদর্শনমূলক বক্তব্যের জন্য মার্কেসের লেখা পাঠকের কাছে আরো বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, যার প্রতিটি রচনার প্রতিটি অক্ষর মানবতার আলো ছড়িয়ে দিয়েছে সারা পৃথিবী জুড়ে, ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া এই মহান লেখকের ঊননব্বইতম জন্মবার্ষিকী ছিল গত ৬ মার্চ, তাঁকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা আর অপার ভালবাসা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart