ইউক্রেনের যুদ্ধ সম্পর্কে ঔপন্যাসিক কেন ফলেট: সহিংসতার মাত্রা কমিয়ে আনাই আমাদের এক মাত্র আশা

রাশিয়া এবং ইউক্রেন-এর সাথে যুদ্ধের আগে রচিত বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক কেন ফলেটের নেভার উপন্যাসটির বিষয় আমেরিকা ও চিনের মধ্যেকার এক পারমানবকি যুদ্ধের কল্পনা। এই কাহিনির সাথে সাম্প্রতিক রাশিয়া ও ইউক্রেন-এর যুদ্ধাবস্থার মিল খুঁজে পাওয়ায় জার্মান সংবাদ সাময়িকী ডয়চে ভেলে এই জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। এটি প্রকাশিত হয়েছিল এ মাসের শুরুতে। প্রাবন্ধিক বিপাশা চক্রবর্তীর অনুবাদে বিডিআর্টস-এর পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো। বি.স.

তার বর্তমান উপন্যাস নেভার চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি পারমাণবিক যুদ্ধের কল্পনা করে রচিত। ডয়চে ভেলে’কে দেয়া একটি সাক্ষাত্কারে, ফলেট বলেছেন যে ‘এই বইটি রাশিয়া এবং ইউক্রেন সম্পর্কেও হতে পারতো’।

বেস্টসেলিং ব্রিটিশ লেখক কেন ফলেট সম্প্রতি তার নতুন উপন্যাস নেভার প্রকাশ করেছেন। এটি চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি ক্রমবর্ধমান সংঘাতের কাহিনি।

৮০ টিরও বেশি দেশে ৪০ টি ভাষায় এই লেখকের ৩৭ টি বই প্রকাশিত হয়েছে। তার সবচেয়ে বিখ্যাত কাজের মধ্যে রয়েছে দ্য পিলারস অফ দ্য আর্থ, দ্য থার্ড টুইন, দ্য নিডেল এবং এজ অফ ইটারনিটি।

ডয়চে ভেলে ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং তার সর্বশেষ বইয়ের পটভূমির মধ্যে অনুরূপ সম্পর্ক নিয়ে তার সাথে কথা বলেছে।

ডয়চে ভেলে: আপনার বর্তমান উপন্যাস নেভার-এ আপনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে একটি পারমাণবিক সংঘাত বৃদ্ধির গল্প বলেছেন। বইয়ের শুরুতে আপনি একটি চীনা প্রবাদ উদ্ধৃত করেছেন: “দুটি বাঘ একই পাহাড়ে থাকতে পারে না।” আমেরিকা ও চীন যদি এক পাহাড়ের দুই বাঘ হয়, রাশিয়া এখন কোথায়?

কেন ফলেট: আমি এই বইটি লেখা শুরু করার আগে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসির প্রাক্তন হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্যাথরিন অ্যাশটনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিটি কোথায়? সে বলেছিল, রাশিয়া। এবং আমি তাকে বিশ্বাস করিনি, ভাবছিলাম যে রাশিয়া আর যুদ্ধপ্রিয় জাতি হয়ে বিশ্বকে পরাভূত করার চেষ্টা করছে না, তাই আমি চীনের সাথে সংঘর্ষের গল্প লিখেছিলাম। তবে এখন দেখা যাচ্ছে যে রাশিয়ার সাথে একটি খুব বিপজ্জনক সংঘাত শুরু হয়েছে, তবুও গল্পটি মূলত একই: দ্বন্দ্ব এবং বৈরিতা বৃদ্ধির গল্প।

আমরা দেখেছি রাশিয়ানরা কিভাবে ক্রিমিয়া তারপর পূর্ব ইউক্রেনের কিছু অংশ দখল করে নিয়েছিল এবং তারা তা করার সাথে সাথে পশ্চিম থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এটি এই সংঘাত বৃদ্ধির প্রক্রিয়া। এখন, যদিও পশ্চিমারা ইউক্রেনে সৈন্য পাঠায়নি, তবুও, পুতিন যেটাকে হুমকির সংকেত হিসেবে দেখছেন ইতিমধ্যে সেটার জবাব দিয়েছেন — তার পারমাণবিক বাহিনীকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এটি সেই ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়া যা আমি নেভারএ বর্ণনা করেছি।

ডয়চে ভেলে: পূর্ববর্তী সাক্ষাত্কারে উল্লেখ করেছেন যে আপনি পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি ১৯৯০ এর দশকের তুলনায় আজ অনেক বেশি বলে মনে করছেন।

কেন ফলেট: আমি সারা জীবন পারমাণবিক হুমকির সাথে বসবাস করেছি, কারণ আমি ১৯৪৯ সালে জন্মগ্রহণ করেছি, সোভিয়েত ইউনিয়ন তার প্রথম পারমাণবিক ডিভাইস বিস্ফোরণ ঘটানোর কাছাকাছি সময় ছিল তখন।

কিন্তু ১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশকে একটা সময় এমন মনে হয়েছিল যে সবকিছু ঠিক্ঠাক হয়ে আরও ভালোর দিকে যাচ্ছে। আপনার যদি মনে থাকে, তাহলে দেখবেন যে আমরা আসলে ইউরোপে পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাস করে এনেছিলাম, সোভিয়েতরাও তাদেরটা শিথিল করেছিল। এখন মনে হচ্ছে ওই ধারণাটা ভুল ছিল। আমরা সবাই এখন আরও বেশি করে অস্ত্র তৈরি করছি।

ডয়চে ভেলে: এমন পরিস্থিতিতে লেখক ও শিল্পীরা কী করতে পারেন?

কেন ফলেট: আমি নেভার লিখেছিলাম কারণ আমি ভেবেছিলাম এটি একটি দুর্দান্ত গল্প হবে। এটাই সবসময় আমার লেখার প্রধান কারণ। আমি আমার পাঠকদের চেয়ে বুদ্ধিমান নই – যারা বই পড়েন তারা বুদ্ধিমান মানুষ – এবং আমার পাঠকরা চান না যে আমি তাদের আঙুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখিয়ে বলে দেব তাদের কী ভাবতে হবে ৷

কিন্তু আমি যা করতে পারি তা হল কোন কিছু কল্পনা করা। আমি প্রধানত ভেবেছিলাম যদি আমি এই সংঘাত বৃদ্ধির গল্পটি কল্পনা করি তাহলে একটি আকর্ষণীয় গল্প হবে, তবে আমি এটাও ভেবেছিলাম যে লোকেরা আরও বেশি আগ্রহী হবে যদি আমি এমনভাবে লিখতে পারি যাতে মনে হয় এটি বাস্তবে ঘটতে পারে।

এক অর্থে, উপন্যাসগুলি এই কাজটাই করে: আমাদের এমন একটি পরিস্থিতি দেখায় যা আমরা নিজেরা কল্পনা করতে পারি না অথচ এটিকে বাস্তব বলে মনে হয়। এটাই হচ্ছে সাহিত্যের আশ্চর্য ব্যাপার। মানুষ যখন একটি বই পড়ে, তাদের আবেগময় প্রতিক্রিয়া এমন হয় যেন এটি সত্যিই বাস্তবে ঘটছে।

ডয়চে ভেলে: নেভার-এ আপনার কল্পনার একটি ফলাফল হল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একজন মহিলা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছে। আপনি কি মনে করেন যে আরও বেশি নারী রাজনীতির দায়িত্বে থাকলে আজ বিশ্বের পরিস্থিতি অন্যরকম হত?

কেন ফলেট: আমার মা নিশ্চিতভাবেই এরকমটা ভাবতেন। তিনি সবসময় বলতেন নারীরা দায়িত্বে থাকলে যুদ্ধ হতো না। তার একথা পুরোপুরি ঠিক ছিল না; মার্গারেট থ্যাচার যুদ্ধ শুরু করেন।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি এটা বিশ্বাস করি, এবং নেভার-এ মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে কিনা একজন নারী, আমি দেখাতে চেয়েছিলাম বইয়ের সমস্ত রাজনৈতিক নেতারা কীভাবে যুদ্ধ প্রতিরোধ করার জন্য সত্যিই কঠোর চেষ্টা করছেন, যেমনটি তারা ১৯১৪ সালে করেছিলেন। আমি ভেবেছি একজন নারী মার্কিন প্রেসিডেন্টের যুদ্ধ ঠেকানোর চেষ্টা করাটা আরও যুক্তিযুক্ত হবে।

ডয়চে ভেলে: উপন্যাসের যবনিকা টানার সিদ্ধান্তটা আপনি কি প্রক্রিয়ায় নির্ধারণ করেছেন যেভাবে আপনি করে থাকেন?

কেন ফলেট: নেভার-এর ঘটনাগুলি ধীরে ধীরে তৈরি হয়, তবে সংঘাত বৃদ্ধির একটি ভয়ঙ্কর অনিবার্য পর্যায় রয়েছে। আপনি যখন শেষের দিকে শ’দুয়েক পৃষ্ঠায় পৌঁছাবেন, তখন আপনি ঘটনাগুলির গতির একটি ধারণা পাবেন এবং আপনি শুধু জানেন যে এটি পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে কম কিছু হলে আমি যে গল্পটি বলতে শুরু করেছি তা ঐ কাহিনীর জন্য অসত্য হবে।

যদিও বইটি শুরু করার সময় আমি ভেবেছিলাম এটি কীভাবে শেষ হবে সে সম্পর্কে আমার একটি পছন্দ আছে, শেষ অধ্যায়টি পাওয়ার সময় আমি বুঝতে পারি যে আমি সেভাবে করিনি।

ডয়চে ভেলে: যখন আমরা পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়াতে চাই না তখন বাস্তব জগতে আমাদের কী আশা দিতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

কেন ফলেট: আমাদের যা আশা করা উচিত তা হল এসব কিছু যেন আস্তে আস্তে হয়।

রাশিয়ানরা কোথাও পৌঁছাচ্ছে না, তাদের জন্য ব্যাপারটা যত খারাপই হোক না কেন, তারা ইউক্রেন ছেড়ে যাবে না। ভিয়েতনামে আমেরিকানদের মতো হবে, আমার মনে হয় একটি বিপর্যয় হবে তবে তারা এটা থেকে সরে যেতে পারবে না।

আমরা আশা করতে পারি যে এটি হ্রাস পাবে এবং লড়াইটি প্রতিবেশী দেশগুলি পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, মলদোভাতে ছড়িয়ে পড়বে না।

ডয়চে ভেলে: আপনার উপন্যাসে, বিরোধটি রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের মধ্যে। আপনার অনেক বই চীনা ভাষায়ও প্রকাশিত হয়েছে। এটি কি চীনেও প্রকাশিত হবে?

কেন ফলেট: আমার বইগুলি ম্যান্ডারিনে খুব ভাল চলে এবং সেগুলি খুব জনপ্রিয়। আমি প্রায়ই আমার চীনা প্রকাশকদের সাথে দেখা করি কারণ তারা লকডাউনের আগে লন্ডন বই মেলায় আসতেন।

নেভার শেষ করবার পর আমি তাদের পাঠিয়েছিলাম, তারপর দীর্ঘ বিরতি ছিল। এবং তারপরে তারা আমাকে লিখেছে, “দুর্ভাগ্যবশত আমরা মনে করি না যে এই বইটি চীনে সহজে প্রকাশিত হতে পারে। “সহজ” শব্দটি ব্যবহার করা অস্বাভাবিক ছিল, আমার ধারণা তারা আসলে বলতে চায়নি, “কমিউনিস্ট পার্টি আমাদের এই বইটি প্রকাশ করতে দেবে না,” তারা বিচক্ষণ।

যাইহোক, উত্তরটি হলো, না – এটি এখনও চীনে প্রকাশিত হয়নি। ভবিষ্যতে কী হতে পারে কে জানে।

ডয়চে ভেলে: ভূ-রাজনৈতিক প্রশ্নের বাইরে একটি প্রশ্ন: যুক্তরাজ্যে, আপনি যেখানে বাস করেন, সম্প্রতি করোনাভাইরাসজনিত সব বিধিব্যবস্থা তুলে নেওয়া হয়েছে। আপনার নতুন উপন্যাস প্রকাশের পর থেকে আপনি কি আবার পাঠকদের সাথে দেখা করছেন?

কেন ফলেট: না, করছি না। যদিও এই দেশে আমাদের সরকার মনে করে যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া ঠিক আছে, আমি তা করি না এবং আসলে আমরা অনেকেই তা করি না, তাই, আমি যখন আমার নিকটবর্তী পরিবার ছাড়া অন্য কারো সাথে দেখা করি, তখনও আমি মাস্ক পরে থাকি এবং আমি ভীড় এড়িয়ে চলি। যাদের সাথে আমি নিয়মিত দেখা করি তারা সব সময় পরীক্ষা করে। আমরা এখনও সতর্ক আছি। আমি মনে করি না যে এই সতর্কতাগুলি ছেড়ে দেওয়ার সময় এসেছে। বরিস জনসন মনে করেন এখন সেই সময় হয়েছে, এবং আমি মনে করি তিনি ভুল, তাই আমি পুরোনো সতর্কতা অবলম্বন করছি। পাঠকদের সাথে কি আবার দেখা সম্ভব হবে? শুধু সময়ই বলতে পারবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart