গার্সিয়া মার্কেসকে নিয়ে তৈরি নতুন ডিজিটাল তথ্যনিকেতনে উন্মুক্ত হলো ২৭ হাজারেরও বেশি চিঠিপত্র, পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠা, আলোকচিত্র ও আরও বহু কিছু।
২০১৪ সালের এপ্রিলে যখন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস মারা গেলেন, তখন বলা হয়েছিল, স্প্যানিশ ভাষায় কলাম্বিয়ান এই লেখকের সৃষ্টি কর্মের তুলনায় শুধুমাত্র বাইবেলই বেশি বিক্রি হয়েছে। ১৯৬৭ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস রিভিউতে এক পর্যালোচনা লিখতে গিয়ে বিখ্যাত আমেরিকান লেখক উইলিয়াম কেনেডি উল্লেখ করেন, “সাহিত্যের প্রথম পাঠ্যবই হিসেবে আদিপুস্তক জেনেসিসের পর সমগ্র মানব জাতিকে যদি কোন বই পড়তে হয়, তাহলে নিঃসঙ্গতার একশো বছর (One Hundred Years of Solitude ) পড়া উচিত”।
গার্সিয়া মার্কেস এ ধরনের অতি প্রশংসাকে অপছন্দ করতে শুরু করেছিলেন। কেননা, এসব প্রশংসা, স্তুতি প্রত্যাশার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছিল। বিশেষ করে নিঃসঙ্গতার একশো বছর-এর অবিশ্বাস্য সফলতা অর্জনের পর মার্কেসের মনে হচ্ছিল, তিনি তার পরবর্তী লেখায় ঐরকমভাবে আর পুরোপুরি সফল হতে পারছেন না। বইটি সেসময় দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় প্রত্যেকেই পড়েছিল। বিপুল জনপ্রিয়তার চাপে ক্লান্ত মার্কেস ভীড় এড়ানোর জন্য স্পেন পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্ত তাতেও কি মুক্তি মেলে! সেখানে আরেক শক্তিমান লেখক মারিও বার্গাস য়োসা তাকে নিয়ে রীতিমত ডক্টরাল গবেষণা প্রবন্ধ লেখা আরম্ভ করলেন।
আলোকচিত্র: ১৯৮০ সালে গার্সিয়া মার্কেস রচিত Chronicle of a Death Foretold উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপির একটি পৃষ্ঠা
এরপরে গার্সিয়া মার্কেসের সবগুলি লেখাই সর্বজনীন প্রশংসা পেয়েছিল। তার পূর্বের লেখা যেমন: No One Writes to the Colonel, Leaf Storm, ছোটো গল্পের সংগ্রহ যেমন: A Very Old Man with Enormous Wings এবং কয়েক যুগ ধরে সাংবাদিক হিসেবে পত্রিকার লেখাগুলো ও তার নন ফিকশনগুলির উপর বিশাল সংখ্যক পাঠক হামলে পড়ে। এসময় গাবো এত পাঠক পেয়েছিলেন যা আগে কখনোও পাননি।
১৯৭০ সালে গ্রেগরি রাবাসা গার্সিয়া মার্কেসের One Hundred Years of Solitude বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ইংরেজী ভাষাভাষী মানুষ তখন লাতিন আমেরিকার অনন্য এই সাহিত্যিকের লেখার স্বাদ গ্রহণ করার সুযোগ লাভ করে। একই সাথে জাদুবাস্তবতার ঢেউ ও লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের রস আস্বাদনের সুযোগ পায় ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষ। রাবাসা মার্কেসের বইটি এতো ভালো অনুবাদ করেছিলেন যে, স্বয়ং মার্কেস তার মূল উপন্যাসের চেয়েও ইংরেজী সংস্করণটি ভালো বলে ঘোষণা দিলেন। বিমোহিত মার্কেস রাবাসাকে লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের ইংরেজি ভাষায় সবচেয়ে ভালো লেখক হিসেবে অভিহিত করলেন। বিশ্বের পঞ্চাশ মিলিয়ন মানুষ আজ উপন্যাসের বুয়েন্দিয়া পরিবারের গল্প জানে। ‘দি অ্যাটলান্টিক নোটস’-্এর তথ্য অনুযায়ী One Hundred Years of Solitude উপন্যাসটি চুয়াল্লশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। Don Quixote এর পর এটি হলো দ্বিতীয় কোন সর্বাধিক অনূদিত উপন্যাস। ঐ সময় এক সমীক্ষায় সারা পৃথিবীর আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন লেখকরা উপন্যাসটিকে গত তিন দশকের মধ্যে বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে সুগঠিত উপন্যাস হিসেবে রায় দেন।
বইটির পান্ডুলিপি রচনার সময়কার ঘটনা আরও বেশি চিত্তাকর্ষক। মার্কেস-ভক্ত পাঠকরা নিশ্চয়ই আনন্দিত হবেন, কারণ তথ্য স্বাধীনতার এই যুগে আপনি এখন মার্কেসের নিজের মুখেই শুনে ও দেখে নিতে পারবেন সেই ঘটনার বিবরণ নিচের এই ভিডিওতে।
টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যারি রেনসাম সেন্টারের ওয়েবসাইটে মার্কেসকে নিয়ে তৈরি ডিজিটাল তথ্যনিকেতনে(Archive) আমরা দেখতে পাবো এমন অনেক আর্টিফেক্ট। যেখানে দেখা যাবে, ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে লেখকের নিজভূমি কলোম্বিয়ার আরাকাতাকায় নিঃসঙ্গতার একশো বছর-এর পান্ডুলিপি রচনার সময়কালের ছবি, লেখকের টাইপরাইটারে Chronicle of a Death Foretold-এর পাণ্ডুলিপির স্ক্যান করা মুদ্রিত পৃষ্ঠার ছবিসহ আরো অনেক জিনিসপত্র।
আলোকচিত্র: গার্সিয়া মার্কেসের সাথে কুবার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল কাস্ত্রো
সর্বোপরি, পুরো তথ্যনিকেতন জুড়ে রয়েছে মার্কেসের “প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত কাজ, গবেষণামূলক উপাদান, ফটোগ্রাফ, স্ক্র্যাপবুক, চিঠিপত্র, ক্লিপিং, নোটবুক, স্ক্রিনপ্লে, মুদ্রিত সামগ্রী, ভ্রমণের সময়কার ছবি এবং ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার গ্রহণের সময়কার বক্তৃতার অডিও রেকর্ডিং, পাণ্ডুলিপির খসড়া। গার্সিয়া মার্কেস সম্পর্কিত প্রায় সাতাশ হাজার পাঁচশটি আইটেম।
এই দস্তাবেজের কোন ছবিতে দেখা যাবে, তরুণ সাংবাদিক গার্সিয়া মার্কেসকে এম্মা ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে। ঠিক তার আগের ছবিতে পরিণত বয়সে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক হিসেবে গল্প করছেন এম্মার ভাই ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে। যেখানে তিনি ফিদেলকে শোনাচ্ছেন লাতিন আমেরিকার রাজনীতি ও ইতিহাসের মাঝে জড়িয়ে বেঁচে থাকা এক লেখকের জীবনের গল্প এবং যে কিনা বাকি বিশ্বজগতের জন্য সে গল্পগুলি ভীষণ বিশ্বস্তভাবে প্রকাশ করেছেন।
আলোকচিত্র: ১৯৫৭ সালে গার্সিয়া মার্কেসের সাথে কুবার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল কাস্ত্রোর বোন এম্মা কাস্ত্রো
অর্ন্তজালের জন্য বিশেষভাবে গড়ে তোলা এই আশ্চর্যজনক সম্পদ প্রথমে সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত ছিলো না। শুধুমাত্র স্কলারশিপ পাওয়া ছাত্র,গবেষক আর গ্রন্থাগারিকদের ব্যবহার করার অনুমতি ছিলো। ইংরেজি ও স্প্যানিশ দুই ভাষাতে অনুসন্ধানযোগ্য প্রকল্পটি নির্মাণ করতে একযোগে কাজ করেছেন গ্রন্থাগারিক, সংরক্ষণ বিশারদ, ছাত্র, প্রযুক্তিকর্মী, এবং শিল্প সংরক্ষকদের একটি দল। আর্কাইভ নির্মাণের কাজটি শেষ করতে দলটির সময় লেগেছিল ১৮ মাস। কাকতালীয়ভাবে, হয়তো এই কারণেই যে গার্সিয়া মার্কেস তাঁর উজ্জ্বলতম উপন্যাস নিঃসঙ্গতার একশো বছর-এর পান্ডুলিপি শেষ করতেও সময় নিয়েছিলেন ১৮ মাস। যখন তিনি চাকরীতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন, প্রচন্ড অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছে্ন ঠিক সেসময় কোন এক অলঙ্ঘনীয় শক্তির টানে লিখেছেন নিঃসঙ্গতার একশো বছর। “বইটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত, টানা আঠারো মাসে আমি একদিনের জন্যও লেখা বন্ধ করিনি”। এই কথা তিনি আমাদের বলেছেন। অন্য সব কিছুর মতোই তাঁর এই কথাটিও আমরা বিশ্বাস করেছি।