সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রনায়ক নির্বাচিত হবার আগে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতি বিষয়ক একটি বই পড়েছিলেন। সেই বইটিই তার পড়া সেরা বই বলে সম্প্রতি মত দিয়েছেন।
সেই বইটির নাম Thinking, Fast and Slow, লিখেছেন ড্যানিয়েল কাহানেমেন। বইটিতে মানুষের বিচারশক্তির দুর্বলতা বা ভুল কিভাবে আপনার বুদ্ধিমত্তাকে প্রভাবিত বা পরিবর্তন করে সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন।
এ ছাড়াও ওবামা আরও নয়টি উল্লেখযোগ্য বইয়ের কথা বলেছেন। তবে এই নয়টির মধ্যে যে-দুটিকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিযেছেন তাদের একটি হলো রবার্ট এ. কারোর The Power Broker: Robert Moses and the Fall of New York এবং অন্যটি হলো ক্যাথেরিন বো-এর Behind the Beautiful Forevers: Life, Death, and Hope in a Mumbai Undercity বইটি।
নোবেলজয়ী মনোবিজ্ঞানী ও আচরণগত অর্থনীতির উদ্ভাবক কাহানেমেন তার Thinking, Fast and Slow বইতে চিন্তা-ভাবনার দু’টি পদ্ধতির বিশ্লেষণ করেছেন। এ গুলোকে তিনি দু’টি ভাগে ভাগ করেছেন, তাহলো সিস্টেম-১ ও সিস্টেম-২।
সিস্টেম-১ চিন্তাধারা হলো অন্তর্নিহিত, অর্থাৎ, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সিস্টেম-২ হলো চিন্তাশীল বা বিবেচনাপ্রসূত, অর্থাৎ মানুষের ধীর চিন্তার প্রতিফলন। কাহানেমেন বলেন, মানুষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সিস্টেম-১’র পাঁকে আটকে থাকে। এ ক্ষেত্রে সমস্যাটি সমাধানের জন্য তার হাতে থাকে মাত্র কয়েক সেকেন্ড।
ওবামা এই বইটি পড়ে ফেলার পর সিএনএন-এর ক্রিশ্চিয়ান আমানপৌর কাহানেমেনের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেদিন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমাদের প্রেসিডেন্ট কোন ধরণের চিন্তাবিদ–সিস্টেম ১ না সিস্টেম ২ ?
উত্তরে কাহানেমেন ওবামা সম্পর্কে বলেছিলেন, “তিনি ধীরগতির চিন্তাবিদ। তিনি চটজলদি ভিতর থেকে সাড়া দেন না। তিনি সবকিছু বিবেচনা করেন। বেশ চিন্তাশীল একজন মানুষ।”
বিচার-বিবেচনা একজন প্রেসিডেন্টের বৈশিষ্ট্য মনে হতে পারে, কিন্তু একজন কমান্ডার-ইন-চিফ-এর সিস্টেম ২ ক্যাটাগরির চিন্তাবিদ হবার সম্ভাবনা আছে কি-না এ রকম ধারণা কাহানেমেন সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দেন। জর্জ বুশ একজন বিশুদ্ধ সিস্টেম-১ ধরণের চিন্তাবিদ। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ” প্রেসিডেন্ট বুশের স্বজ্ঞা বা ভিতরের অনুভূতি নিয়ে গর্ব ছিল, তিনি ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করতেন।”
আপনি নিজে কোন ধরনের চিন্তাবিদ তা জানতে যদি কৌতুহলী হন, তাহলে নিজেই পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। ছোট একটি ধাঁধার মাধ্যমে আপনি নিজের সম্পর্কে ধারণা করতে পারবেন: যদি পাঁচটি মেশিন পাঁচ মিনিটে পাঁচটি শার্ট তৈরী করতে পারে, তাহলে একশোটি মেশিনের একশোটি শার্ট তৈরী করতে কত মিনিট সময় লাগবে?
সিস্টেম ১ ধরণের চিন্তাবিদরা চটজলদি উত্তর দিতে পছন্দ করবেন। এ ক্ষেত্রে তারা বলবেন “একশো মিনিট”। কিন্তু উত্তরটি হবে “পাঁচ মিনিট”। এখানে কতগুলি মেশিন আছে সেটি কোন ব্যাপার না। মূল ব্যাপারটি হলো প্রত্যেকটি মেশিনের এক একটি শার্ট তৈরী করতে সময় লাগে পাঁচ মিনিট। তাই একশোটি মেশিনেরও একশো শার্ট তৈরী করতে পাঁচ মিনিটই লাগবে।
আপনি যদি এই সমস্যার ভিতর থাকেন, তাহলে বিভ্রান্ত হবার কিছু নাই। সিস্টেম ১ ধরণের চিন্তাবিদদের এ থেকে উত্তরণের পথ আছে। আপনি পাঁচ সেকেন্ড অতি দ্রুত ভাবুন। আপনি স্বাভাবিকভাবে সমাধানের সাথে নিজেকে সংযোগ করতে পারবেন। একমাত্র ধীরস্থিরতাই সুচিন্তার জন্ম দিতে পারে। এটাই হলো সিস্টেম ২ যা আপনাকে কাঙ্খিত সমাধান এনে দিতে পারে।
Thinking, Fast and Slow বইটি পড়ার পর ওবামার ধারণা হয়েছে ওভাল অফিসের যারা সতর্কভাবে চিন্তা-ভাবনা করেন না তাদের জন্য সিস্টেম ২ পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত।
পাঠকদের জন্য ড্যানিয়েল কাহানেমেনের Thinking, Fast and Slow বইয়ের চিন্তা-ভাবনার দু’টি পদ্ধতির কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলো:
সিস্টেম ১ঃ দ্রুত, স্বয়ংক্রিয়, ঘন ঘন, আবেগী, কল্পনা শক্তিহীন, অসচেতন। যেমনঃ
* কোন জিনিস অন্যদের তুলনায় দূর থেকে দেখা
* নির্দিষ্ট শব্দের উৎস স্থানীয়করণ করা
* “যুদ্ধ এবং …” বাগধারাটি সম্পূর্ণ করা
* বিভৎস কোন ছবি দেখলে বিরাগ প্রদর্শন করা
* ২ যোগ ২ এর সমাধান করা
* বিলবোর্ডের লেখা পড়া
* ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালানো
* দাবার একটি ভালো চাল দেয়া (আপনি যদি ভালো দাবারু হন)
* সহজ বাক্য বুঝতে পারা
সিস্টেম ২: ধীর গতিসম্পন্ন, বিরল, যুক্তিসঙ্গত, হিসাবী, সচেতন। যেমন:
* দৌড় শুরু করার আগে নিজেকে দৃঢ় করুন/চাঙ্গা করুন
* সার্কাসের জোকারের দিকে আপনার মনোযোগ স্থির করা
* কোলাহলপূর্ণ পার্টিতে কারো প্রতি আপনার মনসংযোগ দেওয়া
* ধূসর চুলের নারীটির দিকে তাকানো
* স্মৃতি হাতরে চেনা একটি শব্দ বের করা
* স্বাভাবিক হাঁটার চেয়ে বেশীক্ষণ হাঁটা
* সঠিক সামাজিক আচরণ কি হবে তা ভাবা
* নির্দিষ্ট বাক্যে কতগুলি ‘এ’ বর্ণ আছে, তা বাছাই করুন
* কাউকে আপনার ফোন নম্বর দিন
* সংকীর্ণ পাকির্ং লটে আপনার গাড়িটি পার্ক করতে পারা
* দু’টি ওয়াশিং মেশিনের মধ্যে দাম ও মানের পার্থক্য করা
* জটিল ধরনের যুক্তির প্রয়োজনীয়তা আছে কি-না তা ভাবা
* ১৭ গুণ ১৪ এর সমাধান করা।
* শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পাওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪তম প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেইন ওবামা তার ক্ষমতায় থাকা কালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। চলুন প্রিয় পাঠক একনজরে সেগুলো একটু দেখে নেই।
* সাশ্রয়ী মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা বা ওবামা কেয়ার এক্টকে বলা হয় আমেরিকার ভেতরে ওবামার সবচেয়ে সেরা সাফল্য। এই সেবার লক্ষ্য ছিল কোন প্রকার কভারেজ ছাড়াই লক্ষ লক্ষ মানুষকে সাশ্রয়ী মূল্যের স্বাস্থ্য বীমা প্রদান করা।
* ওসামা বিন লাদেনের গোপন আবাসস্থলে হামলা ও তাকে হত্য করার অনুমোদন দিয়েছিলেন ওবামা। তিনিই প্রথম জনসমক্ষে সরাসরি জানান যে, গত সপ্তাহে তিনি লাদেনকে ধরা ও তাকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার জন্য পর্যাপ্ত গোয়েন্দা বাহিনী নিয়োগ দিয়েছেন ও তাতে তারা সফল হয়েছেন।
* কিউবা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ৬০ বছরেরও অধিক সময় ধরে বন্ধ থাকা কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনস্থাপনের জন্য ওবামা ও রাউল কাস্ত্রো একমত হয়েছেন।
* ২০১৩ সালে ওবামা তার দেশের ন্যূনতম মজুরী হার ঘন্টা প্রতি ১০.১০ ডলারে উন্নীত করার আহবান জানান। তার সেই আহবানে সারা দিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিসহ ১৮টি রাজ্য তাতে সাড়া দেয়।
* তিনি গাড়ি শিল্পের আর্থিক সংকট দূর করার জন্য নগদ সহায়তার ঘোষণা দেন। তারপর থেকে ক্রিসলার ও জি.এম কোম্পানীতে ২৫০০০০ হাজার চাকুরীর সুযোগ সৃষ্টি হয়।
* ওবামাই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি প্যারিস চুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। তার সেই উদ্যোগের ফলেই বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তহবিল গঠন করা হয়েছে।
* যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্টের সমকামীদের বিয়ের অনুমোদন দেয়া রায়কে ওবামা সমর্থন করেন।
* ওবামা সশস্ত্র বাহিনীর “ডোন্ট আস্ক, ডোন্ট টেল” এই নিয়মের বিরুদ্ধে আইন পাশ করেন।
* বিশ্ব অর্থনীতির মহামন্দা সময়ে ক্ষমতায় আসার পর ওবামা তার দেশকে অর্থনৈতিকভাবে চাঙা করার জন্য আরো বেশী কর আদায় করা ও চাকুরী থেকে ছাটাই না করার জন্য রিকভারি এ্যাক্ট স্বাক্ষর করেছিলেন।
* ওবামার চিন্তা করার প্রক্রিয়া ও তার ফলাফলের উপর যতটুকু আর যেধরণেরই প্রভাব রাখুক না কেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নেয়া প্রতিটি সিদ্ধান্তই পৃথিবীবাসীর কাছে গুরুত্ববহন করে।