আন্তঃনাক্ষত্রিক সভ্যতার স্বপ্ন ও স্টিফেন হকিং-এর সেরা বইগুলো
গত ১৪ মার্চ ২০১৮ তারিখে চলে গেলেন বর্তমান বিশ্বের জনপ্রিয় এক মানুষ। স্টিফেন হকিং, যাকে আইনস্টাইনের পর সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী বলা হয়। তবে এক দিক থেকে তিনি হয়তো আইনস্টাইনকেও ছাড়িয়ে গেছেন, তাহলো সাধারণ মানুষের কাছে তার বিপুল জনপ্রিয়তা। আইনস্টাইন যে জনপ্রিয় ছিলেন না, তা কিন্তু না। তবে তার জনপ্রিয়তা বেড়েছিল তার মৃত্যুর পর। সেদিক থেকে স্টিফেন হকিং দারুন ভাগ্যবান এক মানুষ। আর সেই ভাগ্যবান মানুষটিই মানবজাতিকে দিয়ে গেলেন ভবিষ্যৎ পথ চলার এক আশ্চর্য পাথেয়।
বেশি দিন আগে নয়, সম্প্রতিই বলা যায়, বিখ্যাত এই পদার্থবিজ্ঞানী বারবার মানবজাতিকে হুঁশিয়ার করে বলেছিলেনঃ “মানুষই মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। মানুষের প্রযুক্তি জ্ঞানের অপব্যবহার মানুষের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। একদিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, অন্যদিকে পারমানবিক যুদ্ধ আর কৃত্রিম ভাইরাসের মতো মানবসৃষ্ট সমস্যার কারণে গোটা মানবজাতি আজ ভয়ানক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পৃথিবী ক্রমশ বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। তবে মহাদুর্যোগ নেমে আসতে এক হাজার বা দশ হাজার বছর লাগতে পারে। এরই মধ্যে মানুষকে মহাকাশে অন্য নক্ষত্রপুঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে হবে, যাতে মানব জাতি নিশ্চিহ্ন না হয়ে যায়”।
বহু বছর যাবৎ জটিল মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত অধ্যাপক হকিংয়ের প্রায় পুরো শরীর অসাড় হয়ে যাওয়ায় তিনি স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারতেন না। থুতনির সাথে যুক্ত সূক্ষ্ম সেন্সরের সাহায্যে বিশেষভাবে তৈরি কম্পিউটারের কীবোর্ড চালিয়ে তিনি ভাববিনিময় করতেন। খ্যাতিমান এ বিজ্ঞানী মনে করতেন, মহাকাশে পাড়ি জমাতে পারলেও সেখানে স্বনির্ভর আবাসস্থল গড়ে তুলতে মানুষের অন্তত কয়েক’শ বছর সময় লেগে যাবে। কাজেই, সে পর্যন্ত মানুষকে সতর্কভাবে থাকতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গবেষকদের তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ক্ষেত্রে অনেক বেশি সাবধান হতে হবে।
হকিংয়ের তত্ত্বাবধানে পৃথিবীর বাইরে বুদ্ধিমান প্রাণী রয়েছে কি-না, তার জন্য একটি প্রকল্প চালু হয়েছিল। প্রকল্পটির নাম ‘ব্রেক থ্রু লিসন’। তিনি মনে করতেন ‘এ ধরণের সৃষ্টি’ বা ‘এলিয়েনরা’ মানবতাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। ২০১০ সাল থেকে এই বিশ্বনন্দিত পদার্থবিজ্ঞনী জনসম্মুখে তার এই আশঙ্কার কথা জানিয়ে আসছিলেন, “যে অগ্রগামী এলিয়েন সভ্যতা মানবজাতির আগ্রযাত্রাকে উপড়ে ফেলতে পারে। যেভাবে মানুষ একটি পিঁপড়ার কলোনিকে ধ্বংস করতে পারে। মানব সভ্যতার অনেক খারাপ ইতিহাস আছে। পৃথিবীতে মানুষ তাদের সাথেই বেশী ধ্বংসাত্মক ও অমানবিক আচরণ করেছে যারা প্রযুক্তিতে পিছিয়ে ছিল। তাহলে, এলিয়েনরা কেন মানবজাতি থেকে আলাদা হবে?” এ কারণেই হকিং ভীতি থাকার পরেও পৃথিবী ছাড়া মহাবিশ্বের অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে কিনা, তা জানতে আগ্রহী ছিলেন। ‘ব্রেক থ্রু লিসন’ প্রকল্পের উদ্যোক্তারা জানান, মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজার এটাই হলো এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ। হকিং এ প্রকল্পের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন ‘ব্রেক থ্রু’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। কারণ, এখনই সময় মহাবিশ্বের কোথাও প্রাণী জগতের অস্তিত্ব আছে কি-না জানার। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে এই প্রকল্পের আয়োজিত এক মিডিয়া ইভেন্টে হকিং তাঁর অনুভূতি জানিয়ে বলেছিলেন “যেহেতু আমরা জীবিত আছি, আমাদের বুদ্ধি আছে, সেহেতু আমাদের জানার অধিকার আছে, মহাবিশ্বে কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি-না”।
হকিং বলেছিলেন, “আমরা এলিয়েন সম্পর্কে জানি না, কিন্তু মানুষ সম্পর্কে জানি। যদি ইতিহাসের দিকে তাকাও, তাহলে দেখতে পাবে, মানুষের তুলনায় কম বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে মানুষের সম্পর্কটা সংঘাতপূর্ণ ছিল। অগ্রসরমান সভ্যতার সাথে পিছিয়ে পড়া সভ্যতার সংঘর্ষ ছিল। হতে পারে আমাদের থেকে এলিয়েনদের সভ্যতা বিলিয়ন বছর এগিয়ে আছে। তাহলে তারা হবে অতীব শক্তিমান এবং আমাদের তারা ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে বেশী মূল্যবান মনে নাও করতে পারে।”
সময় ও কাল নিয়ে গবেষণার মাধ্যমেই স্টিফেন হকিং বিজ্ঞানীসহ সাধারণ জনগণের পর্যন্ত নজর কাড়েন। এই গবেষণায় অসাধারণ সাফল্যের পর তিনি একে অগ্রগতির চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে যাবার জন্য ‘ব্রেক থ্রু লিসন’সহ একাধিক গবেষণায় যুক্ত হয়ে যান। তার প্রতিটি গবেষণাকে তিনি ভবিষ্যত পৃথিবীর কাছে গুছিয়ে রেখে যাবার চেষ্টা করেছেন। তিনি তার মৃত্যু সম্পর্কে সজাগ ছিলেন বিধায় অতি যত্নে প্রতিটি গবেষণাকে ছাপার অক্ষরে রূপদান করেন। এর ফলে পৃথিবী শুধুমাত্র একজন বিজ্ঞানীকেই পেল না, এর সাথে একজন পরিষ্কার ভাবনার লেখকও পেলেন।
পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তার কর্ম জীবনে সাধারণ ও বৈজ্ঞানিক উভয় শ্রেণীর মানুষদের জন্য জনপ্রিয় অসংখ্য লেখা লিখে গেছেন। এর মধ্যে যেমন রয়েছে প্রকাশিত গ্রন্থ, গবেষণাপ্ত্র, লেকচার নোট তেমনি তার অপ্রকাশিত বহু লেখাও আছে।
তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী এরকম জনপ্রিয় ও আলোচিত ১৫টি বইয়ের তালিকা আছে, যার কোনটিতে তিনি একা আবার কোনটিতে সহলেখক ছিলেন। পাঠকদের জন্য সে বইগুলোরই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো।
“The Large Scale Structure of Space-Time” হলো হকিংয়ের প্রথম বই। এটি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে তাঁর সহলেখক ছিলেন জর্জ এলিস। বইটি অবশ্য সাধারণের জন্য নয়-এটি পদার্থবিদ্যার একটি পাঠ্য বই। বইটিতে আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক সূত্র ধরে কিভাবে বৃহদায়তন নক্ষত্রগুলি বা কৃষ্ণ গহ্বর বা ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয় এবং কিভাবেই বা সময় ও কাল অসীম হয় তারই ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।
১৯৮৮ সালে ব্যান্টাম প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় হকিংয়ের “A Brief History of Time” বইটি। প্রকাশের পর পরই বইটি আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর মাধ্যমে বিজ্ঞান জানা নেই এমন মানুষেরাও মহাকাশের মূল তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা পায়। হকিং এখানে খুব সহজ ভাষায় পৃথিবীর উৎপত্তি আর কিভাবে তা ধ্বংস হতে পারে তার বর্ণনা দিয়েছেন। বইটিতে একে একে মধ্যাকর্ষণ শক্তি, কৃষ্ণ গহ্বর, বিগ ব্যাং, সময়ের প্রকৃতি এবং একটি পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত তত্ত্বের অনুসন্ধানের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
স্টিফেন হকিংয়ের বেশ কিছু প্রবন্ধ সংকলন করে ১৯৯৩ সালে ব্যান্টাম প্রেস প্রকাশ করে “Black Holes and Baby Universes” বইটি। এখানে কৃষ্ণ গহ্বরের বিন্যাসের মতো বৈজ্ঞানিক তথ্য যেমন স্থান পেয়েছে আবার তার ব্যক্তিগত কিছু ঘটনা যেমন: নিউরোডেজেনারেটিভ ডিসর্ডার অসুখের সাথে বেড়ে ওঠার জীবন অভিজ্ঞতার কথাও প্রকাশ পেয়েছে।
একই প্রকাশনী থেকে ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় “The Universe in a Nutshell” বইটি। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার উপর অত্যাধুনিক গবেষণা নিয়ে বইটি রচিত হয়েছে। এখানে তিনি সুপারগ্রাভিটি, সুপারসিমেট্রি, কোয়ান্টাম থিউরি, এম-থিউরি এবং এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ নয় এমন মানুষদের জন্যও কিছু কিছু বিষয়ের উপর ধারণা দিয়েছেন। “A Brief History of Time.”-এর পর থেকে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে সে সম্পর্কেও পাঠকদের উদ্দেশ্যে তা তুলে ধরেন।
“On the Shoulders of Giants” (Running Press Adult, 2002), বইটিতে হকিং কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন এবং আইনস্টাইনের কর্ম সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। এখানে তিনি পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাতটি ক্লাসিক পেপারের উপর আলোকপাত করেছেন। এছাড়া বইটিতে হকিং তার নিজেরসহ উপরের চার বিজ্ঞানীর জীবনী অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
২০১১ সালে হকিং একই রকম আরেকটি বই প্রকাশ করেন, যার নাম “The Dreams That Stuff Is Made Of” । বইটিতে তিনি কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে বিস্ময়কর কিছু পেপারসের কথা তুলে ধরেছেন।
২০০৫ সাল, এবার হকিং লিওনার্ড ম্লোডিনোভকে সাথে নিয়ে প্রকাশ করেন “A Brief History of Time” -এর দ্বিতীয় সংস্করণ। ১৯৮৮ সালের প্রথম সংস্করণ থেকে পরবর্তী ১৭ বছরে মহাকাশ গবেষণায় যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা এখানে যুক্ত করা হয়েছে।
“God Created the Integers” (Running Press Adult, 2005) বইতে গণিতের ২৫০০ বছরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, গুরুত্বপূর্ণ গণিতবিদদের জীবনী এবং তাদের কাজের পুনঃবর্ণনা করেন।
“George’s Secret Key to the Universe” and sequels (2007 – 2016) হলো শিশুদের নিয়ে লেখা সিরিজ। হকিং ও তার কন্যা লুসি এবং ক্রিস্টোফ গালফার্ড হলেন এটির রচয়িতা। এখানে মিডল স্কুল পড়ুয়া জর্জ এবং এ্যনি দু’জনে মিলে মহাকাশে যাত্রা করে। সেই যাত্রা পথে তারা কসমোলজি, গ্রহ, এমনকি কৃষ্ণ গহ্বর সম্পর্কে জানতে পারে। সিরিজের বইগুলি হলোঃ “George’s Cosmic Treasure Hunt,” “George and the Big Bang,” “George and the Unbreakable Code” এবং “George and the Blue Moon” ।
২০১০ সালে প্রকাশিত হয় হকিং ও লিওনার্ড ম্লোডিনোভের “The Grand Design” বইটি। এখানে মহাবিশ্বের উৎস ও বাস্তব প্রকৃতি সম্পর্কে প্রাণবন্ত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বইটিতে বহু বিশ্বের বা আলাদা পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। ধারণা করা হয়েছে, সেখানেও পৃথিবী সৃষ্টির মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এখানে মহাবিশ্ব কিভাবে কাজ করে এম-থিউরি তার একটি একক ব্যাখ্যা দিতে পারে কি-না, সে সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে।
“My Brief History” (Bantam Press, 2013) বইতে হকিং তার আত্মজীবনী ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি এখানে কিভাবে “A Brief History of Time” রচনা করেছেন এবং তার রোগ নির্ণয়ের পর কিভাবে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক সাফল্য পেয়েছেন, সে সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন।
“Black Holes: The Reith Lectures” (2016) মূলতঃ বিবিসিতে দেয়া স্টিফেন হকিংয়ের বক্তৃতার সংকলন। এখানে তিনি ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরের বৈজ্ঞানিক ইতিহাস সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তিনি যুক্তি দেন যে, যদি আমরা কেবলমাত্র ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরের বৈজ্ঞানিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারি আর তা কিভাবে সময় ও কাল সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে, তাহলেই আমরা মহাবিশ্বের রহস্যের জট মুক্ত করতে পারবো।
স্টিফেন হকিং তার সমগ্র জীবন, গবেষণা কর্ম ও লেখালেখি–সবকিছুর মাধ্যমে পৃথিবীবাসীকে যেন এক স্বপ্নের কথা বলে গেছেন, আন্তঃনাক্ষত্রিক সভ্যতার স্বপ্ন। এর জন্য আমরা হয়তো এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত নই।
বর্তমানে আমাদের একমাত্র আবাসস্থল পৃথিবী তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত পরিবর্তন সমস্যায় আক্রান্ত। যার জন্য অনেকাংশে আমরা মানুষেরাই দায়ী। এখনও আমরা একমত হয়ে এই সমস্যার কোনো সমাধান খুঁজে বের করতে পারিনি। তাহলে কি মানুষ থেমে যাবে? স্টিফেন হকিং-এর মতো এখনও অনেক মানুষ আছে যারা স্বপ্ন দেখে আন্তঃনাক্ষত্রিক সভ্যতার। এ স্বপ্ন কি কখনো বাস্তবের মুখ দেখবে, যেমনটি দেখেছিল মহাসাগর আর মহাশূন্য জয়ের স্বপ্ন? ততদিন কি আমরা টিকে থাকব? হয়তো থাকব যদি না আমরা মানুষরা একে অন্যকে ধ্বংসের পরিকল্পনা না করে একত্রে টিকে থাকার পরিকল্পনা করি।