প্রত্যাখ্যাত ৮টি গবেষণার নোবেলজয়
নোবেলবিজয়ী সব গবেষণা বা আইডিয়া প্রথমেই নিজ বলয়ে গৃহীত হয়নি। সংজ্ঞাগত দিক থেকেই হোক কিংবা দৃষ্টান্ত ও উদাহরণের দিক থেকে সেগুলো ছিল আসলেই বৈপ্লবিক। সে অনুযায়ী, অনেক আলোচিত গবেষণা, তত্ত্ব ও আবিষ্কার এমনকি পরবর্তীকালে টেক্সটবুকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এমন, অনেকগুলোই প্রাথমিক অবস্থায় বাতিল বলে ঘোষিত হয়েছিল। উপহাস যদিও বা না করে থাকেন তবুও প্রথম পর্যায়ে বিজ্ঞানী মহল ঐসব ঘোষণাকে বাতিল বলেই ঘোষণা করা হয়েছিল। মার্কিন জীনতত্ত্ববিদ হাওয়ার্ড মার্টিন টেমিন যখন “রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেস’ (RT) প্রস্তাব করলেন, যেখানে বলা হলো- ” আরএনএ অনেক সময় ডিএনএ তৈরি করতে সক্ষম”। এই তত্ত্বকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেয়া হল। সেটা ছিল ১৯৭০ সাল। অন্যসব বিজ্ঞানীদের মতে হাস্যকর এ প্রস্তাব নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হল ১৯৭৫ সালে। অনেক সমালোচনা অনেক বিতর্কের পরেও সে সময় অনেক বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী নেতারা মানতে নারাজ ছিলেন টেমিনের এই তত্ত্ব, যে কিছু ভাইরাস আরএন-এ আকারে থেকে তাদের জেনেটিক তথ্য বহন করে আক্রান্ত কোষের ডিএনএ’তে তার অনুলিপি তৈরি করে ফেলতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে ‘বিপরীত বা রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন’ বলে আখ্যায়িত করা হলো। কেননা, রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেস (RT) হচ্ছে এক ধরনের এনজাইম যা ব্যবহার করে আরএনএ টেমপ্লেট থেকে পরিপূরক ডিএনএ বা কমপ্লিমেন্টরি ডিএনএ উৎপাদন করা যায়। একই কান্ড ঘটেছিল সুইস মাইক্রোবায়োলজিস্ট ওয়ার্নার আর্বার-এর বেলাতেও। ১৯৭৮ সালে তিনিও নোবেল পান। ওয়ার্নার রেস্ট্রিকশন এনজাইমের কাজ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন।
এখানে নোবেল জয়ী ৮টি গবেষণাপত্রের রূপরেখা দেয়া হলো যেগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে সম্মিলিত পর্যালোচনায় বিভিন্ন বিজ্ঞান সাময়িকী, জার্নাল বা বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশের জন্য মনোনীত হয়নি এবং প্রকাশের অযোগ্য বলে বাতিল হয়েছিল।
১। রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার (১৯৯৭) বিজয়ীদের একজন মার্কিন প্রাণরসায়নবিদ পল বয়ার। এডিনসন ট্রাইফসফেট সংশ্লেষণের প্রক্রিয়া চিহ্নিত করার জন্য তিনি এ পুরস্কারের অংশীদার হন।
প্রত্যাখ্যান: বয়ারকে অবিশ্বাসের চোখে দেখা হয়েছিল, যখন তিনি এই তত্ত্ব প্রদান করেন যে, প্রাণী উদ্ভিদ এবং ব্যাক্টেরিয়ার ভেতর অসাধারণ আণবিক যন্ত্র কাজ করে (এটিপি সিন্থেস মেশিন) যার মাধ্যমে শক্তি উৎপাদিত হয় এবং সঞ্চিত হয়। এটিই জীবনকে সম্ভব করে তোলে। অর্থাৎ প্রাণী উদ্ভিদ বা ব্যাকটেরিয়ার দেহে আণবিক স্তরে কিভাবে এনজাইমগুলো কাজ করে সেই রহস্যময় প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দেন। এটি প্রাণ-রসায়নশাস্ত্রের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। কিন্তু এর ফলে প্রাণ-রসায়নশাস্ত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়। বয়ার, স্মৃতিচারণ করে বলেন, ঐসময় ‘দ্য জার্নাল অব বায়োলজিক্যাল কেমেস্ট্রি’ ছিল শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা। ওরা গবেষণাপত্রটি প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
২। উচ্চ ক্ষমতার পারমানবিক চৌম্বকীয় অনুরণন (এনএমআর) বর্ণালিবীক্ষণ যন্ত্রের উন্নয়ন সাধনের জন্য রসায়নশাস্ত্রে নোবেল (১৯৯১)-এ ভূষিত হন রিচার্ড আর্নেস্ট।
প্রত্যাখ্যান: এই গবেষণাপত্রে যে অর্জনের বর্ণনা ছিল তা দু’দুবার প্রত্যাখ্যাত হয় প্রকাশের জন্য। শেষ পর্যন্ত ‘জার্নাল অব ক্যামিকেল ফিজিক্স’-এ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির পর্যালোচনা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল।
৩। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল (১৯৬৯) পেলেন মারি গেল-মান। মার্কিন এই পদার্থবিদ পদার্থের মৌলিক কণাসমূহের শ্রেণী বিভাগ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন। কণাগুলোর মিথস্ক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেন।
প্রত্যাখ্যান: মারি-গেল-মান তাঁর গবষেণার প্রত্যাখ্যান সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ” ওটা আমার দেয়া শিরোনাম ছিল না, যেটা ছাপা হয়েছিল ‘ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস’ পত্রিকায়। আমার দেয়া শিরোনাম ছিল “আইসোটপিক স্পিন এবং আগ্রহী কণা”- ফিজিক্যাল রিভিউ প্রত্যাখ্যান করল। আমি আবার চেষ্টা করলাম ‘অদ্ভূত কণা’ এই শিরোনামে, এটিও বাতিল হলো। ওরা জোর দিল ‘নতুন অস্থির কণা’ এই শিরোনামে। এই শব্দগুচ্ছই কেবল বিধিসম্মত মনে হয়েছিল রিভিউ-এর সম্পাদকদের নিকট। এখন আমি বলতে পারি আমি সবসময়ই ‘ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস’কে ঘৃণা করেছি,এবং বিশ বছর আগেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঐ জার্নালে আমি পুনরায় আর কিছুই প্রকাশিত হতে দেব না। কিন্তু ১৯৫১ সালে আমার উল্লেখযোগ্য কোন অবস্থান ছিল না বলেই ওটি করতে হয়েছিল।”
৪। চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার (১৯৫৩) পান জার্মান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ চিকিৎসক ও প্রাণরসায়নবিদ হ্যান্স অ্যাডলফ ক্রেবস। তিনি ইউরিয়া চক্র এবং সাইট্রিক এসিড চক্র আবিষ্কার করেন। তাঁর নামে সাইট্রিক চক্রের নামকরণ করা হয় ‘ক্রেবস সার্কেল’।
প্রত্যাখ্যান: ক্রেবসকে এই গবেষণাপত্রটি প্রথমবার প্রকাশের ক্ষেত্রে অপারগতা জানিয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়কি ‘নেচার’ চিঠি পাঠিয়েছিল। এবং পরেরবারের জন্য চেষ্টা করতে বলেছিল।
৫। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার (২০০০) পেলেন হার্বার্ট ক্রোয়েম। উচ্চগতির আলোক-ইলেক্ট্রনিক্স ব্যবহৃত অর্ধপরিবাহী হেটারোস্ট্রাকচারের উন্নয়ন ঘটিয়ে এ পুরষ্কার লাভ করেন তিনি। ড্রিফট-ফিল্ড ট্রানজিস্টর এবং ডাবল-হেটারোস্ট্রাকচার লেজার’-এর জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত।
প্রত্যাখ্যান: ক্রোয়েম প্রথমে তাঁর আইডিয়াটি জমা দিয়েছিলেন ‘এপ্লাইড ফিজিক্স লেটারস’ পত্রিকায়। কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হন। পরে অবশ্য প্রকাশিত হয়েছিল ইনস্টিটিউট অফ ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার্স’ (আই ই ই ই) এই পত্রিকায়।
৬। রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পুরষ্কার (১৯৮৬) প্রদান করা হলো হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভূত রসায়নবিজ্ঞানী জন চার্লস পোলানিকে। রাসায়নিক গতিবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করে তিনি নোবেল জয় করেন।
প্রত্যাখ্যান: এই গবেষণাটিও ‘ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার’ প্রত্যাখ্যান করে। কারণ হিসেবে বলা হয় ওটা নাকি ঠিক বিজ্ঞানসম্মত নয়। এই ঘটনার কিছুকাল পরেই একই ক্ষেত্রে আরেকটি গবেষণা পত্র জমা দেন আরেকজন রসায়নবিদ। সেটিও প্রত্যাখ্যাত হয়। এই সময় জর্জিয়ান বে’র এক দ্বীপে ছুটি কাটাচ্ছিলেন পোলানি। কিন্তু এই খবর পেয়ে তিনি দ্রুত ছুটি থেকে ফেরত চলে আসেন টরন্টোতে। ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর গবেষণাপত্রটি তাড়াহুড়ো করে জমা দিলেন ‘জার্নাল অফ ক্যামিকেল ফিজিক্স’ পত্রিকায়। সেখানে এটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই প্রকাশিত হয়েছিল।
৭। পলিমারেজ শৃঙ্খল বিক্রিয়া (পিসিআর) পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য রসায়নশাস্ত্রে নোবেল (১৯৯৩) পেয়েছিলেন মার্কিন অণুজীববিদ ক্যারি মুলিস।
প্রত্যাখ্যান: ক্যারি মুলিসে পিসিআর আবিষ্কারের গবেষণাপত্রটি প্রকাশের জন্য জমা দিয়েছিলেন আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্স’-এ। কিন্তু সেবার প্রত্যাখ্যান করা হল মুলিসের কাগজপত্রগুলোকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ‘সায়েন্স’-এর সম্পাদক ছিলেন আরেক বিখ্যাত রসায়নবিদ ড্যানিয়েল এডওয়ার্ড কোসলান্ড। বছর তিনেক পর যখন মুলিসের গবেষণাটিকে বর্ষসেরা হিসেবে ঘোষণা করা হয় তখনও কোসলান্ডই ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক।
৮। চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল (১৯৭৭) পেয়েছিলেন রোজালিন ইয়োলো। শরীরবিজ্ঞান বা চিকিৎসাশাস্ত্রে রেডিওইমিউনোএসে কৌশল উন্নয়নের জন্য এই পুরষ্কার। রোজালিন হলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে আমেরিকার দ্বিতীয় নোবেলজয়ী নারী বিজ্ঞানী।
প্রত্যাখ্যান: নোবেল পুরষ্কার পাবার বছরখানেক পর রোজালিন বেশ গর্বভরে তাঁর কাছে আসা ড. ব্রেডলি স্ট্যানলী প্রেরিত প্রত্যাখ্যান পত্রটি দেখিয়েছিলেন সবাইকে।
এইসব বিজ্ঞানীদের কাজগুলো প্রথমে প্রত্যাখ্যাত হলেও তাঁরা দমে যাননি, নিজের উপর ও নিজের কাজের উপর আস্থা ও বিশ্বাস ছিল তাঁদের। ছিল বলেই পরে নোবেল পুরস্কার জয় করতে পেরেছিলেন।