সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সর্বশেষ উপন্যাস ‘দূর হ শয়তানের দল’
বিশ্বব্যাপী তিনি পরিচিত ছিলেন একজন শাসক, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে। তার শাসনামলে মিথ্যা অভিযোগে তার দেশে আক্রমণ চালিয়েছিল পশ্চিমা দেশগুলো। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তাকে খুন করা হয়েছিল। কিন্তু খুন হওয়ার অনেক আগে থেকেই তার মধ্যে জন্ম হচ্ছিল অন্য অারেকটি সত্ত্বা, এক সাহিত্যিক সত্ত্বা। যদিও সবাই জানেন, তিনি জীবদ্দশায় সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন না কারোর কাছেই। এমন একজন মানুষের যে বইটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে যাচ্ছি – সে বইটি জেতেনি কোন সাহিত্য পুরস্কার। এই বইটিকে বলা যায়, ‘স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া এক খন্ড কাগজের মন্ড।’–’নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকা এভাবেই আখ্যায়িত করেছে বইটিকে।
মানুষটির নাম সাদ্দাম হোসেন। ইরাকের সাবেক ও প্রয়াত প্রেসিডেন্ট। বিস্মৃত এই রাষ্ট্রনায়কের সবচেয়ে অনালোকিত দিক আমরা প্রায় কিছুই জানি না। যদিও আরবীভাষী জগতে তিনি এই পরিচয়ে এখন বেশ পরিচিত এবং জনপ্রিয়। আর এই পরিচয় ও জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে পশ্চিমা প্রকাশনা সংস্থাগুলো এখন উৎসুক হয়ে উঠেছে তার বইগুলোর ইংরেজি অনুবাদে। তার সর্বশেষ বইটিই এখন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। যে বইটির কথা বলছি তা সাদ্দাম হোসেনের চতুর্থ ও সর্বশেষ উপন্যাস। সাদ্দাম হোসেন লিখেছিলেন আরবীতে ‘উরখাজ মিন’হাইয়া,মাল’উন”। যা ইংরেজীতে Begone, Demons অর্থাৎ “দূর হ শয়তানের দল” নামে সর্বাধিক পরিচিত। এছাড়াও উপন্যাসটি Get Out You Damned অথবা Get Out of Here, Curse You! শিরোনামেও অভিহিত করা যেতে পারে, বাংলা করলে যার তর্জমা দাঁড়ায় ‘দূর হ, নরকের কীট’ অথবা ‘যা এখান থেকে, অভিশাপ তোকে!” এসব নামেও ডাকা যেতে পারে। বইটি তিনি শেষ করেছিলেন ইউএস আর্মি দ্বারা তাঁর পতনের ঠিক একদিন আগের সন্ধ্যায়। স্বাধীন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সাদ্দাম হোসেনের জীবনের অন্তিম মুহূর্তে শেষ করেছিলেন পান্ডুলিপিটি। তখন ২০০৩ সাল। মার্চের বিশ তারিখে পতন ঘটে সাদ্দাম হোসেনের। তারপরের ঘটনা সবার জানা। পালিয়ে বেড়ান সাদ্দাম হোসেন পরের নয়টি মাস। নিজ জন্ম শহর তিরকিত-এর কাছে পিঠে কোথাও আত্মগোপনে ছিলেন। কিন্তু ডিসেম্বরের তের তারিখ গ্রেফতার হন সেই ইউএস আর্মির কাছে। গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী কাজের জন্য যারা তাঁকে ২০০৬ সালের ত্রিশ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করে। মৃত্যু হয় একজন সাদ্দাম হোসেনের কিন্তু তাঁর লেখা সর্বশেষ বইয়ের পান্ডুলিপিটি সঙ্গে নিয়ে জর্ডানে নির্বাসিত হন তাঁর কন্যা রেগাদ সাদ্দাম হোসেন। অতিসম্প্রতি এই বইটি প্রথমবারের মতো ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশের ঘোষণা দিল ব্রিটিশ প্রকাশনা সংস্থা হাস্পার্স।
এই বছর ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুর দশ বছর পূর্ণ হবার প্রাক্কালে এই ঘোষণা আসে ব্রিটিশ প্রকাশনা সংস্থাটির পক্ষ থেকে। যদিও বইটির ইংরেজী অনুবাদের শিরোনাম কী হবে এবং এর অনুবাদক কে, এই বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু জানায়নি সংস্থাটি। হাস্পার্সের একজন মুখপাত্র ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকাকে বলেছেন, ‘উপন্যাসিকাটি গেম অব থ্রোন এবং ইউকে হাউজ অব কার্ডস স্টাইল ফিকশনের মিশ্রণ। এবং রাজনৈতিক গুপ্ত ষড়যন্ত্রের পরিপূরর্ণ উত্তেজনাময় আখ্যান। তবে সবকিছু জানার জন্য সবাইকে ক্রিসমাস অর্থাৎ বড়দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে”। এর আগ পর্যন্ত এসব গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। এর আগে ২০০৫ সালে ১৮৫ পৃষ্ঠার মূল বইটি প্রকাশনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাদ্দাম হোসেনের উত্তরাধিকার কন্যা রেগাদ সাদ্দাম হোসেন । কিন্তু বাধ সাধে জর্ডানের প্রেস ও প্রকাশনা সংস্থা অধিদপ্তর। তারা বইটিকে তাৎক্ষণিক বাজেয়াপ্ত করে। কিন্তু ততক্ষণে বইটির বেশকিছু নকল বা কপিকরা অনুলিপি বিক্রি হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, “জর্ডানের অনেক মানুষের হৃদয়ে সাদ্দামের অবস্থান অনেক উঁচুতে।। তাঁর জনপ্রিয়তা ঈর্ষনীয়”। সেখানকার বিক্রেতা হারুনী জানান, বইটি বাজেয়াপ্ত ঘোষণার কয়েক ঘন্টার মধ্যে ৫০ কপি বিক্রি হয়ে যায়। এখানে তাঁর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সাদ্দামের ত্রিশ বছরের শাসনের অবসান যে অবৈধ উপায়ে করা হয়েছিল তা এখন সবাই জানে। আমেরিকার ভুল পদক্ষেপ, বন্দি কেলেংকারী, প্রসারমান দুর্নীতি সাদ্দামের জনপ্রিয়তাকে তুঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষ বর্তমান অবস্থার সাথে সাদ্দামের শাসনামলের তুলনা করতে পারছে। কোনটা ভাল কোনটা মন্দ তার তুলনা করছে মানুষ- এমনটিই বলেছিলেন জর্ডানের এক সাংসদ বইটি প্রথম প্রকাশ নিষিদ্ধ হবার সময় নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকাকে। আর এখন এটা প্রমাণিত যে ইরাক যুদ্ধের অবতারণা আমেরিকান প্রোপ্যাগান্ডার নির্জলা মিথ্যার বেসাতী ছাড়া আর কিছুই নয়। আগেই উল্লেখ করেছি ২০০৩ সালে আমেরিকান আগ্রাসন শুরুর সময় বইটি লেখা শেষ হয়। এর আগে সাদ্দাম হোসেনের লেখা তিনটি বই প্রকাশিত হয়। জাবিহা এন্ড দি কিং, দি ফোর্টিফাইড ক্যাসল এবং ম্যান এন্ড দি সিটি। এছাড়া সাদ্দাম হোসেন কবিতাও লিখতেন ঐতিহ্যবাহী আরবীয় শৈলীতে। প্রচলিত আছে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ছিলেন সাদ্দাম হোসেনের প্রিয় লেখক। এবং সাদ্দাম হোসেনের লেখায় তাই হেমিংওয়ের ছাপ পাওয়া যায়।
দূর হ শয়তানের দল উপন্যাসের পটভূমি আবর্তিত হয়েছে ইউফ্রেতিস নদীর তীরে বসতি স্থাপনকারী স্থানীয় এক গোষ্ঠীকে নিয়ে যারা সেখানে ১৫০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে ছিল। একদিন তারা ভিন্ন এক গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হয়, যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধ শেষে জয়ও আসে। গল্পের কথক চরিত্রের নাম আব্রাহাম। তিনি তাঁর তিনজন নাতী ঈজিকিয়েল বা আইজ্যাক, জোসেফ এবং মোহাম্মদের গল্প বলেন। মূলত বাইবেলীয় রূপকের আশ্রয়ে লিখিত এই গল্পের মূল অংশের দৃষ্টি নিবদ্ধ এই তিন মানবের উপর। এখানে আসলে ঈজিকিয়েল ইহুদীদের, জোসেফ খ্রিস্টানদের এবং মোহাম্মদ হচ্ছেন মুসলিমদের প্রতিনিধি বা দলপতি। গল্পে আব্রাহাম ব্যবীলন সম্পর্কে সতর্কবানী দেন। গল্পে দেখা যায়, ঈজিকিয়েল একজন খল চরিত্র এবং বিশ্বাসঘাতক। যেখানে বাকী দুইজন সৎ, ভাল এবং পরিশ্রমী। একসময় ঈজিকিয়েল দেশ ত্যাগ করে পশ্চিমের মৃত সাগর ডেড সী’র দিকে যাত্রা করে। সেখানে সে এক লোভী রোমান রাজ্যপালের সাথে যোগদান করে। যারা ষড়যন্ত্র করে প্রচুর টাকা উপার্জন করে এবং তা স্থানীয় জনগণের আরাম আয়েশের জন্য খরচ করে। তাদের ধন সম্পদ ধরে রাখার জন্য অবশেষে দুটি সুউচ্চ অট্টালিকা বা টাওয়ার নির্মানের প্রয়োজন হয় এবং তারা দুটি টাওয়ার নির্মান করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক আরব আদিবাসী নেতার কন্যা আরব যোদ্ধাদের সহযোগিতায় ঐ টাওয়ার দুটি ধ্বংস করে। এমনকি তারা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহুতি দিতে কুন্ঠিত হয় না একজন মুসলিম শহীদ হিসেবে। এখানে এই সুউচ্চ অট্টালিকা দুটি আসলে নাইন ইলিভেনের রেফারেন্স বহন করে। গল্পে ইহুদি-খ্রীষ্টানদের প্লটটি রূপক হিসেবে আরব ও মুসলিমদের বিপরীতে দেখানো হয়েছে। যদিও আলী আবদেল আমির, সাদী হাদী’র মতো ইরাকী লেখক সাংবাদিক ও সমালোচকদের মতে এই গল্পে “সাদ্দাম হোসেন অনেক জায়গায় সত্য সংস্পর্শ হারিয়েছেন”। এদিকে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে চিলকোট রিপোর্টে উল্লেখ আছে, সাদ্দাম হোসেন এক হুমকি– জনসাধারণকে এই তথ্য দিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরাক যুদ্ধে যোগদান করাটা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। কেননা ‘সাদ্দাম হোসেন এক হুমকি’ এই তথ্যটিই ছিল ভুল। এর দায় স্বীকারও করেছেন টনি ব্লেয়ার। এই প্রেক্ষিতে সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুর দশ বছর পর তাঁর বইয়ের ইংরেজী অনুবাদ ইংল্যান্ড এবং আমেরিকা এই দুইদেশের ইংরেজ ভাষাভাষীদের কাছে তা আকর্ষণের তুঙ্গে থাকতে পারে এমন ধারণা করছেন কোন কোন বিশেষজ্ঞ। এবং এর মাধ্যমে বিস্মৃত এই রাষ্ট্রনায়ক বা পশ্চিমাদের মতে স্বৈরশাসক যাই বলুন না কেন, তিনি যে পুনরায় আলোচনার মধ্যমণি হয়ে কেন্দ্রে চলে এলেন এটা বলাই বাহুল্য।
২০০৪ সালে প্যানআরব দৈনিক ‘আল-শারাক আল আসাওয়াত’ পত্রিকায় গল্পটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে বৈরুতসহ বিভিন্ন স্থানেও বইটি প্রকাশিত হয়। ঐ ২০০৬ সালে জাপানী পাবলিশার্স তকুমা সতেন প্রকাশনা সংস্থা ডেভিল’স ড্যান্স বা শয়তানের নৃত্য শিরোনামে বইটি প্রকাশ করে জাপানী ভাষায়। এটি তুর্কী ভাষাতেও অনূদিত হয়। অনুবাদকের নাম হাম্মাম খালীলী আবু মুলাল আল-বালায়ি। ঐ সময় প্রকাশিত পাঁচ ডলার মূল্যের বইটির প্রচ্ছদে সাদ্দাম হোসেনের ছবি আছে। পরের পৃষ্ঠায় লেখা সারসংক্ষেপের নীচে তাঁর স্বাক্ষর, তারিখ ১৮ মার্চ ২০০৩।
রাজনীতি বা যুদ্ধের ময়দান নয় বরং বইটি ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশের ঘোষণার সাথে সাথে সাহিত্যের অঙ্গনে আবার যেন গর্জে উঠলেন বিস্মৃত এক সিংহের ন্যায় প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন।