সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: আরবমুখী ফরাসী লেখক ও মার্গারেটের গ্রাফিক-উপন্যাস

আরবমুখী ফরাসী লেখকগণ

জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসী আক্রমণ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করার সাথে সাথে শিল্পসাহিত্য ও মানুষের সৃষ্টিশীলতাকেও তা প্রভাবিত করেছে। উদাহরণ খুঁজতে আমাদের খুব বেশি ইতিহাস না ঘাটলেও চলে। কেবল ফ্রান্সের সাম্প্রতিক সাহিত্যের রূপরেখা পর্যবেক্ষণ করলেই সহজে বোধগম্য হয়। আমরা দেখতে পাই, গত নভেম্বরে প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পর ফ্রান্সের মুসলিম ও অমুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। মার্চ আট্যাকের পরবর্তী উত্তেজনার আগুনকে আরো বেশি উস্কে দেয় গত মাসের ঐ হামলা । জনমনে এই উত্তেজনা তৈরির আগে, ফরাসী সাহিত্যে ইসলামী বিকাশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ফরাসি জাতীয় সাংস্কৃতিক কল্পনায় মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার প্রভাব ছিল প্রবল।

সবাই জানেন, সুরুচি ও ভিন্ন সংস্কৃতিতে ঔৎসুক্যের জন্য ফরাসি জাতটার খ্যাতি বহুদিন থেকেই ভুবনব্যাপী। আরববিশ্বের প্রতি তাদের আজকের এই মনোযোগও মোটেই নতুন কিছু নয়। যদি পেছন ফিরে একটু তাকানোর ফুরসৎ পান তাহলে নিশ্চয়ই আপনার মনে পরবে যে ফ্রান্সই ছিল গোটা ইউরোপের প্রথম দেশ যেটি প্রাচ্যের প্রতি প্রথম কৌতূহল প্রকাশ করেছিল। পাঠকদের হয়তো মনে পরবে ১৭০৭ থেকে ১৭১৭ সালের মধ্যে ফরাসী অনুবাদক জাঁ অন্তোনিয় গালার কথা যিনি ছিলেন বিশ্বসাহিত্যের চিরায়ত গ্রন্থ সহস্র এক আরব্য রজনীর প্রথম ইউরোপীয় অনুবাদক আর সেটি তিনি অনুবাদ করেছিলেন এই ফরাসী ভাষায়। পরে এই ভাষা থেকে ইউরোপের অন্যান্য ভাষায় তা দ্রুত অনূদিত হতে থাকে। কোলরিজ, ডি-কুয়েন্সী, স্তাঁদাল, টেনিসন, অ্যাডগার অ্যালান পো, নিউম্যান— প্রথম সারির এইসব লেখকরা সবাই গালার হাত ধরেই ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’ পরিভ্রমণ করেছেন। সুতরাং প্রাচ্য বা আরববিশ্ব নিয়ে তাদের নেক নতুন কিছু নয়, বরং তারাই এ বিষয়ে দীর্ঘতম ঐতিহ্যের দাবীদার।

ফ্রান্সের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ শীর্ষ সাহিত্য পুরষ্কার ‘গঁকুর পুরষ্কার’। গত অক্টোবরে এই পুরস্কারের জন্য যে চারটি বই নির্বাচিত হয় তার মধ্যে তিনটিই ছিল আরববিশ্ব নিয়ে। পঞ্চম উপন্যাসটি ছিল আলজেরীয় উপন্যাসিক বৌয়ালেম স্যালসাল রচিত ২০৮৪ । বইটি ইসলামী খেলাফত নিয়ে একটি বেস্ট সেলার বই। ‘গঁকুর পুরষ্কার’-এর জন্য নির্বাচিত বইগুলি বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য পুরস্কারও লাভ করে। একটি দেশ কিভাবে সংগ্রাম করে ও ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে তার সমস্যাপূর্ণ ইতিহাস ধারন করে এই বিষয়গুলিই হোল নির্বাচিত বইগুলোর আকর্ষণ। তাছাড়া ফ্রান্স কিভাবে অতীতের স্মৃতি ও ভবিষ্যতের ভয়ের মধ্যে সীমারেখা টানছে তারই বিবরণ ফুটে উঠেছে উপন্যাসগুলিতে ।

প্যারিস ভিত্তিক সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘লি পয়েন্ট’ এর সাংস্কৃতিক মুখপাত্র ও বই সমালোচক এরিক নূলেউ বলেন- ” এ বছরের ফরাসী সাহিত্য অনেকটা রাজনীতিকেন্দ্রিক এবং তা বিশ্বের প্রতি ছিল উন্মুক্ত। আমরা এখন যে টান টান উত্তেজনার মধ্যে বাস করছি, এটি তারই ফল”।

স্যানসাল-এর ২০৮৪ উপন্যাসটি এ বছরের বেস্ট সেলার ও গঁকুর পুরষ্কার বিজয়ী বৌশলী (কম্পাস)-এর বিপরীতধর্মী। বিজয়ী উপন্যাসটি লিখেছেন ফরাসী উপন্যাসিক ম্যাথিয়াস ইয়েনার্দ। এটি পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের শতাব্দীর উপর একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা।

ফ্রান্সে সাহিত্যের উপর পুরষ্কার ঘোষণাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখা হয় । গতমাসে যখন ফ্রান্সের জাতীয় টেলিভিশন গঁকুর পুরষ্কার ঘোষণা সম্প্রচার করে, তখন দেখা গেল মিঃ ইয়েনার্দ পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যে দিয়ে প্রেসের লোকজন অতিক্রম করছেন। এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা। গঁকুর জুরিরা চার ফাইনালিস্টের নাম ঘোষণা করেন তিউনিসের জাতীয় বার্দোও মিউজিয়ামে যেখানে গত মার্চ মাসে সন্ত্রাসীদের হামলায় ২২ জন নিহত হয়।

গঁকুর পুরষ্কারের জন্য যে সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করা হয়, সেখানে বৌয়ালেম স্যানসাল-এর ২০৮৪ উপন্যাসটি বাদ দেয়া হয়। লেখক স্যানসাল সমালোচক ও জুরিদের রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত থাকার অভিযোগ করেন। স্যানসাল বলেন-” আমার মতো একটি বই লিখেছেন এমন কাউকে পুরস্কৃত করা কঠিন’। তিনি তার ২০৮৪ সালে মৌলবাদী ইসলামের সাথে নাজিবাদ বা ফ্যাসিবাদের তুলনা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, জুরিগণ ভীত ছিলেন এমন একটি উপন্যাসকে পুরষ্কারের জন্য নির্ধারণ করতে যেটি কিনা ‘ সাংঘর্ষিক ইসলামবাদ ও ইসলাম’ বা ‘হিংসাত্মক রাজনৈতিক ইসলাম ও ধর্ম হিসেবে ইসলাম’ –এই বিষয়ের উপর লেখা হয়েছে।

এদিকে জুরি বোর্ড-প্রধান বার্নাড পিভট ও ঔপন্যাসিক তাহার বেন জেলুনসহ অন্য জুরি সদস্যরা বলেছেন যে, প্যানেল উপন্যাসের শৈল্পিক গুণ ও মেধার উপর ভোট দিয়েছে। পিভট বলেন- “আমাদের পছন্দ ছিল সাহিত্য, রাজনীতি না”। উপন্যাস ২০৮৪ নিঃসন্দেহে চমৎকার, তবে সম্পূর্ণ নয়। আর আমরা যদি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত থাকতাম তাহলে তিউনিসের বার্দোও মিউজিয়ামে আমরাই চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পেতাম”।

মাইকেল হুয়েলিবেক, যার নিজের সর্বোচ্চ বিক্রিত উপন্যাস আনুগত্য(Submission) যেখানে তিনি প্রথম মুসলিম প্রেসিডেন্টের অধীন ২০২২ সালের ফ্রান্সকে কল্পনা করেছেন। তিনি ইতিমধ্যে গঁকুর পুরষ্কার জিতেছেন বিধায় এ বছর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন নি। তিনি কিন্তু ২০৮৪ উপন্যাসের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

স্যানসাল-এর উপন্যাসের পটভূমি আবর্তিত হয়েছে ২০৮৪ সালের পৃথিবীর এক কাল্পনিক রাষ্ট্র ও জাতিকে নিয়ে। কাল্পনিক রাষ্ট্রটির নাম ‘আবিস্তান’। যা কিনা তিনি আফগানিস্তান, আলজেরিয়া ও লিবিয়ার উপর ভিত্তি করে কল্পনা করেছেন। গল্পতে একজন মানুষ ইসলামের রহস্যাবৃত গঠন সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানার জন্য প্রশ্ন করে। যা ঐ দেশকে একটি সর্বগ্রাসী আতঙ্কে পরিণত করে। এটিতে পরোক্ষভাবে ১৯৮০ সালে আলজেরিয়ার সামরিক স্বৈরশাসনের সমালোচনা করা হয়, যে সময়কালে সেখানে ইসলাম বিকশিত হয়।

স্যানসাল মনে করেন, একদিন হয়তো মানুষ তার ২০৮৪ বইটির কথা লিখবে ইসলামী একনায়কতন্ত্র কিভাবে এল সে সম্পর্কে ব্যাখা করতে গিয়ে, অনেকটা জর্জ অরয়েলের ১৯৮৪ মতো। এই লেখক তার উপন্যাসে ইসলামী জঙ্গি সংগঠন আইসিস-এর উত্থানকে দেখিয়েছেন কিভাবে একটি পরাবাস্তব কল্পনা সত্যে পরিণত হয়। যার জন্য বইটি তাঁকে খুব দ্রুতই শেষ করতে হয়েছিল। বইটি ইতিমধ্যে ১৯৪,০০০ কপি বিক্রি হয়ে গেছে। আগামী শরতে বইটির ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। বৌয়ালেম স্যানসাল একজন উদারপন্থী মুসলিম, পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। ২০০৪ সালে আলজেরিয়ার আবদেল আজিজ সরকারের সমালোচনা করে তিনি শিল্প উপমন্ত্রীর পদ ছাড়েন। এরই মধ্যে আইসিস তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আরব বিশ্বের ক্ষমতার দিন শেষ, ইসলামের নেতৃত্ব নেবে ইরান”।

সাহিত্যে নতুন সংযোজন: গ্রাফিক নভেল

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পাল্টে যাচ্ছে সব কিছু, তাহলে সাহিত্য কেন নয়? গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ এবং কমিকসের যে রূপের সাথে আমরা এতদিন পরিচিত ছিলাম সেখানে এর সাথে নতুন রূপে যুক্ত হচ্ছে ত্রিমাত্রিক গ্রাফিক নভেল। পশ্চিমাদের কাছে ইতিমধ্যে সাহিত্যের এই নব সংযোজন ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। যদিও এখনো তা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার শেষ নেই। গত আট নভেম্বর এমনই একটি ঘোষণা দিল মার্কিন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও প্রকাশনী সংস্থা ‘ডার্ক হরস কমিস’। প্রথমবারের মতো তারা করতে যাচ্ছে গ্রাফিক কমিক আকারে ধারাবাহিক উপন্যাস এঞ্জেল ক্যাটবার্ড। আর এই কমিকের লেখিকা হলেন, বুকার পুরষ্কারজয়ী এবং কয়েক বছর যাবৎ সম্ভাব্য নোবেলজয়ী কানাডিয়ান সাহিত্যিক মার্গারেট এটউড। যিনি দি ব্লাইন্ড এসাসিনদি হান্ডমেইডস টেল ও দ্য হার্ট গোজ লাস্ট ইত্যাদি বইগুলির জন্য বিখ্যাত। এঞ্জেল ক্যাটবার্ড একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও সাহসী উপন্যাস যেখানে এটউড ও আর্টিস্ট জনি ক্রিস্টমাসের সমন্বয় ঘটেছে। বিড়াল ও পাখির শক্তিসম্পন্ন একজন অসাধারণ সুপার হিরোর গল্প তিন মাত্রার গ্রাফিক্সের মধ্য দিয়ে বর্ণিত হয়েছে। এর প্রথমটি আগামী ২০১৬-এর শরতে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, মূল্য নির্ধারিত হয়েছে ১০.৯৯ ডলার। এঞ্জেল ক্যাটবার্ড সাধারণ মানুষের কাছে পশুপাখির জীববৈচিত্র্য রক্ষা করবার এক মানবিক বার্তাও পৌঁছে দেবে।

তথ্যসূত্র : দ্যা নিউইয়র্ক টাইমস

আর্টস বিভাগে প্রকাশিত বিপাশা চক্রবর্তীর আরও লেখা:

জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গম: অর্ধনারীশ্বর অথবা তৃতীয় প্রকৃতি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart