এলিয়টের অগ্রন্থিত কবিতায় নতুন ভাবনা
(১৮৮৮-১৯৬৫) কবি , নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যসমালোচক ও সম্পাদক। বিংশ শতকের অন্যতম শক্তিমান কবি। শুধু তাই নয়, আধুনিক যুগে কবিতায় এলিয়টের প্রভাব প্রবাদপ্রতিম। ১৯৪৮ সালে সাহিত্যে নোবেলপ্রাপ্ত এ কবির গ্রন্থিত ও অগ্রন্থিত কবিতা নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে একটি কবিতা সংকলন। ‘ দ্য পোয়েমস অফ টি এস এলিয়ট: কালেক্টেড এন্ড আনকালেক্টেড পোয়েমস’ শিরোনামে দুই খন্ডের সংকলনটি সম্প্রতি যৌথভাবে প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের ফেবার এন্ড ফেবার প্রকাশনী এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি প্রেস। এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত ‘স্প্লিন’ এবং’ ইন রেস্পেক্ট অফ ফিলিংস’ নামে দুটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে ‘দ্য নিউইয়র্ক রিভিউ অফ বুক’-এর চলতি সংখ্যায় । এলিয়টের কবিতা অগ্রন্থিত থেকে যাবে , এট আশ্চর্যজনকই বটে। তবে সত্যিটা হলো তাই ছিল অনেকদিন পর্যন্ত। এলিয়টের সেক্রেটারি ও ২য় স্ত্রী ভেলেরির মৃত্যুর বছর তিনেক পর তাঁর পুরোনো নোটবুকে পাতার ভাঁজে পাওয়া যায় এলিয়েটের অপ্রকাশিত তিনটি কবিতা। এর মধ্যে দুটি হছে ‘স্প্লিন’ এবং’ ইন রেস্পেক্ট অফ ফিলিংস’ । এ কবিতা দুটিতে এলিয়টের গৃহপালিত প্রাণী বেড়ালের প্রতি ভালবাসা ও অনুভূতির কথা প্রকাশ পেয়েছে। তবে তৃতীয় যে কবিতাটি এলিয়ট-সমালোচকদের নজর কেড়েছে তা হচ্ছে ভেলেরিকে উদ্দেশ্য করে লেখা কিছু পংক্তি। কবিতাটির শিরোনাম হচ্ছে ‘ আই লাভ টল গার্ল’। হ্যাঁ , এখানে দীর্ঘাঙ্গী রমণীদের প্রতি কবির আকর্ষণ বর্ণিত হয়েছে। প্রথম বিয়েতে এলিয়ট সুখী ছিলেন না। ১৯৫৭ সালে সেক্রেটারি ভেলেরীকে যখন বিয়ে করেন তখন এই জুটির বয়সের ফারাক ছিল প্রায় চল্লিশ বছর। ভেলেরীর উচ্চতা ছিল পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। তাই অনেকেই এখন, বয়েসের এত পার্থক্য থাকা সত্বেও দীর্ঘকায়া এই নারীকে বিয়ে করবার কারণ খুঁজবার প্রয়াশ চালাচ্ছেন ঐ কবিতাটির মধ্য দিয়ে।
দেয়ালচিত্রে ব্যাংকসির প্রতিবাদ
নাম তার ব্যাংকসি। বৃটেনের প্রতিভাবান একজন মানুষ। একধারে তিনি শিল্পী, রাজনৈতিক কর্মী ও চিত্রপরিচালক। দেয়ালচিত্র, ভাস্কর্য, পথশিল্প, ব্রিস্টলের ভূগর্ভস্থ দৃশ্য, বিদ্রূপাত্মক শিল্পকর্ম ও সামাজিক বিবৃতি ইত্যাদির মাধ্যমে ইতিমধ্যে তিনি ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। অতি সম্প্রতি লন্ডনের ফরাসী দূতাবাসের সামনের দেয়ালের গায়ে ‘জঙ্গল’ শিরোনামে তাঁর একটি নতুন শিল্পকর্ম দেখা গেছে যার মাধ্যমে ফ্রান্সের কালেস শরণার্থী শিবিরে কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহারের সমালোচনা করা হয়েছে। চিত্রকর্মটিতে দেখা যাচ্ছে ভিক্টর উগো’র অমর সৃষ্টি ল্য মিজারেবল-এর সেই দরিদ্র কিশোরী মেয়েটির চোখ দিয়ে সি এল গ্যাসের ঢেউয়ের মতো লেস আকারে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। এটি মূলত একটি দৃষ্টিবিভ্রমকারী(Elusive) প্রপঞ্চকর দেয়ালচিত্র। শিল্পকর্মটিতে একটি ধাতব কার্ডবোর্ডে কিউ আর কোড রয়েছে। কোন দর্শক যদি সেই কোডের উপর তাদের ফোন রাখে, তাহলে এটি গত পাঁচ জানুয়ারী কালেশ শরণার্থী শিবিরে পুলিশের আক্রমণের একটি অনলাইন ভিডিও’র লিংক পাবেন। .
ইউরোপের চলমান উদ্বাস্তু সংকট নিয়ে সমালোচনা করে এটি সর্বশেষ ধারাবাহিক দেয়ালচিত্র। সম্প্রতি ফরাসী কর্তৃপক্ষের কালেস শরণার্থী শিবিরের একাংশ ভেঙ্গে ফেলার প্রচেষ্টার উপর এখানে সরাসরি মন্তব্য করা হয়েছে । উচ্ছেদের এই ঘটনার ফলে প্রায় ১৫০০ উদ্বাস্তু বর্তমানে আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে ।
অবশ্য গত সপ্তাহে পুলিশের মুখপাত্র স্টিভ বারবেট সংবাদ মাধ্যমের কাছে শরণার্থী শিবিরে কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহারের কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন- ” কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহার আমাদের স্বার্থ নয় যতক্ষণ পর্যন্ত এটি জনস্বার্থ রক্ষায় বাধ্যতামূলক না হয়, এবং এটি শিবিরে ব্যবহৃত হয়নি”। কিন্তু ইউটিউবে প্রকাশিত ৭ মিনিটের একটি ভিডিও চিত্রে জানুয়ারীর প্রথম দিকে গভীর রাতে ঐ শিবিরে ফরাসী কর্তৃপক্ষকে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করতে দেখা গেছে। একাধিক ভিডিও চিত্র ও প্রতিবেদনে শরণার্থী শিবির ও মূল সড়কের মধ্যে ১০০ মিটার বাফার জোন তৈরির চেষ্টা হিসেবে পুলিশকে একাধিকবার সিএল গ্যাস ব্যবহার করার উল্লেখ রয়েছে ।
এর আগে ব্যাকংসি কালেস শরণার্থী শিবিরের সুড়ঙ্গের দেয়ালে অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের প্রতিকৃতি তুলে ধরেন। স্টিভ জবস যিনি একজন সিরিয়ান অভিবাসীর সন্তান। সেখানে ব্যাংকসি ছোট্ট এক বিবৃতি দিয়েছিলেন ” বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠান অ্যাপল সৃষ্টি হতো না যদি না তারা সিরিয়ার হামস থেকে আসা এক যুবককে আশ্রয় না দিত”।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ‘স্টিভ জবস’ শিল্পকর্মটি একটি নিরাপত্তামূলক কাঁচের পেছনে রাখে কিন্তু গত সপ্তাহে এটি মুছে ফেলা হয়। এর আগে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, একজন উদ্বাস্তু শিল্পকর্মটির পাশে তাবু খাঁটিয়ে এটিকে একবার দেখার জন্য পাঁচ ইউরো করে লোকজনের সাহায্য চাইতো।
ব্যাংকসির অন্যান্য রাজনৈতিক উদ্দেশপ্রণোদিত শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে, সমুদ্রসৈকতে একটি বালক দূরবীন দিয়ে বৃটেনের দিকে তাকিয়ে আছে আর একটি শকুন সেই দূরবীনের উপর বসে আছে। অন্যটি শহরের অভিবাসন অফিসে, যেখানে ১৯ শতকের ফরাসী শিল্পী থিওডর গেরিকোল্ট -এর ‘ দ্য রাফট অফ দ্য মেডুসা’ শিল্পকর্মের একটি সংস্করণ বের করেন। সেটি ছিল জাহাজডুবিতে টিকে থাকার দৃশ্য, যেখানে প্রবল ঢেউয়ের মাঝে ভেসে থাকা একটি ভেলায় কোনরকমে বেঁচে যাওয়া কয়েকজন যাত্রীর দিগন্তের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের নিদারুণ প্রচেষ্টা।
সাহিত্যের রসনা এবং তাতিয়ানা তলস্তয়া
পাশ্চাত্য কায়াদাকানুন রপ্ত করা হোক আর স্বাস্থ্য সচেতনতাই আমরা বাঙালীরাও আজকাল বেশ ক্যালোরি মেপে খাওয়া শুরু করেছি। কিন্তু প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্য উভয়ের সাহিত্য জগতের বড় একটা অংশ জুড়ে আছে কিন্তু এই খাদ্যবস্তু। বাঙলা সাহিত্যের প্রথম যুগে অবহটঠ ভাষা অথবা মঙ্গল কাব্যে কবিতা আর শ্লোকের আকারে এসেছে বহু খাওয়ার বর্ণনা এমনকি রন্ধন প্রনালী। পরবর্তী কালের সাহিত্যিকরাও কম যাননি। নানান ছলে ও কলাকৌশলে ভোজনরসিক বাঙালীর মনের কথাই যেন তারা তুলে ধরছেন তাদের সাহিত্যকর্মে । ভারতচন্দ্রে আমরা দেখেছি ঈশ্বরী পাটনা সোনারূপা না চেয়ে ভগবতীর কাছে চাইছে ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। বঙ্কিমের ইন্দিরাতো শুধু রান্না করেই সমাজেই ফিরলেন। সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন বাঙালী হিন্দুর নিরামিষ হেঁসেলের একজন খাস ভক্ত। আর রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্রের নায়িকারা তো প্রিয়তমদের সারাক্ষণ খাইয়েই গেছেন।
বিশ্ব সাহিত্যের কালজয়ী সব সৃষ্টিকর্মেও নানান খাবার দাবার ভীষণ গুরুত্বের সাথেই এসেছে। এলিসেস এডভেঞ্চার ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড-এর সেই পাগলাটে চায়ের আসর থেকে সিলভিয়া প্লাথের দ্য বেলজার-এ রয়েছে কাঁকড়ার মাংসে ঠাসা সুস্বাদু এভোকেডো। তেমনি আছে অলিভার টুইস্ট-এর স্বাদ হীন জাউ আর জেন আয়ার-এর পোড়া পরিজ-এর করুন ইতিহাস । আবার ফ্রানজ কাফকার মেটামরফসিস-এ শক্ত হয়ে যাওয়া রুটি, দুদিনের বাসি পনির, শুকনো কিছু সবজি, হোয়াইট সস দেয়া সসেজ আর কয়েকটি বাদাম আর কিসমিস যেন পাঠকের কাছে আরাধ্য খাদ্যবস্তু হিসেবে ধরা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পাই, দ্য নিউ ইয়র্কার পত্রিকার গত সংখ্যায় (১৮-২৫ জানুয়ারী) প্রকাশিত রুশ লেখক তাতিয়ানা তলস্তয়ার ছোট গল্প ‘এসপিক’ ।
এসপিক রাশিয়ান ঐতিহ্যবাহী একটি শীতকালীন খাবার। এটি মূলত মাংসের স্টক দিয়ে তৈরি এক প্রকারের জেলেটিন। নতুন বছর উদযাপনের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। প্রায় ঘন্টা ছয়েক সময় লাগে পুরোপুরি তৈরি হতে। জেলেটিন যেহেতু ঠান্ডায় জমে গিয়ে তৈরি হয় তাই বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ খাবারটি শীতের সময় প্রস্তুত করে।
এই ‘এসপিক’ ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে তাতিয়ানার গল্প। তাতিয়ানা তলস্তয়া, সাহিত্য সৃষ্টি যার রক্তের মাধ্যমে অর্জিত। অভিজাত রুশ পরিবারের কন্যা তাতিয়ানার জন্ম রাশিয়ার লেলিনগ্রাদ বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গে। পৈতৃক পিতামহ অ্যালেক্সি নিকোলাইয়েভিচ তলস্তয় ছিলেন সেই সময়ের কল্পবিজ্ঞানের অগ্রণী লেখক। দাদী নাতালিয়া ছিলেন একজন কবি। অন্যদিকে মাতামহ মিখাইল লজোন্সকি ছিলেন সাহিত্যের অনুবাদক। তাতিয়ানা মূলত ছোটগল্পকার । ১৯৮০ সাল থেকে নিয়মিত লিখে আসছেন ছোটগল্প। তাঁর লেখাগুলো সমসাময়িক রাশিয়ার সাধারণ মানুষের জীবন ও রাজনীতির চিত্র শাণিত, ধারালো এবং সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। আর এজন্যই বিখ্যাত তিনি। এই ‘এসপিক’ গল্পটিও এর বাইরে নয়।
দ্য নিউ ইয়র্কারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তাতিয়ানা বলেন, এসপিকের মতো মাংসের উপাদেয় বিলাসী খাবার রাশিয়ার সাধারণ গরীব মানুষরা সচারচর খেতে পারে না। নিউ ইয়ার ইভের মতো উৎসব তাদের এই বিশেষ খাবারটি খাওয়ার সুযোগ করে দেয় । যদিও রাশিয়ায় প্রচুর পরিমাণে খামার ও গবাদী পশু আছে। তারপরেও মাংসের ভাল অংশটুকু ধনীরাই পেয়ে থাকে। আর এসপিক বানাতে মাংসের প্রয়োজন হয়। তাই শুধু বিশেষ দিনেই সাধারণ রুশ পরিবারগুলো এই খাবারটি বানানোর আয়োজন করতে পারে।
এর মাধ্যমে ফুটে উঠেছে আরেক নির্দয় বাস্তবতা। তা হচ্ছে মাংস! হ্যাঁ, এক টুকুরো মাংস আমরা যখন দেখি, তখন তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় এটি এক সময় জীবন্ত ছিল, কোনো প্রাণীর শরীরের অংশ ছিল, যে কিনা নিজের জীবন দিয়ে আমাদের বেঁচে থাকার চাহিদা পূরণ করেছে। আপনি নিরামিষভোজী বলে হাঁফ ছাড়বেন। কিন্তু বিজ্ঞান ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে, আপনি যখন কোনো সবুজ সব্জী খাচ্ছেন তখন সেটিও তাকে খাওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
তথ্য সুত্র: দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউ ইইয়র্কার, দ্য নিউ ইয়র্ক রিভিউ অফ বুকস।