আমাদের সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজনের সন্তান তিনি। তার বাবা নোবেল পুরস্কার জয়ী আন্তর্জাতিকভাবে সর্বাধিক বিক্রিত আইকন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। এবং মা মের্সেদেস বার্চা, যিনি ২০২০ সালে মারা গেছেন। রদ্রিগো গার্সিয়া তার প্রিয় বাবা আর মায়ের ভালোবাসা আর প্রস্থানের এক মর্মস্পর্শী কোমল স্মৃতিচারণ করেছেন। ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’-এর লেখকের ছেলে পিতার বিম্মৃতি-রোগ আর মায়ের মৃত্যুর ঘটনার উষ্ণ ও ঘনিষ্ঠ চিত্র তুলে ধরেছেন লেখক রদ্রিগো তার বইটিতে।
১৯৬০-এর দশকে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস নিঃসঙ্গতার একশো বছর লিখছিলেন। লেখক তখন বলেছিলেন, সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলির একটি ছিল তিনি যখন অবিস্মরণীয় চরিত্র কর্ণেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মৃত্যুর মুখোমুখি হন। কলাম্বিয় এই লেখক ‘গাবো’ নামেই সবার কাছে জনপ্রিয় ও পরিচিত। গাবো তখন মেক্সিকো সিটির তার বাড়ির পাঠকক্ষ থেকে বেরিয়ে বেডরুমে চলে যান স্ত্রী মের্সেদেস বার্চাকে খুঁজতে। ভীষণ বিমর্ষচিত্তে স্ত্রীকে বলেছিলেন, “আমি কর্ণেলকে হত্যা করেছি”। বার্চা জানতেন গাবোর কাছে এই মৃত্যুর মানে কী। এই শোক সংবাদে তারা দুজনেই নির্বাক হয়েছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। এই কথাগুলো বলে বাবা মায়ের মর্মযন্ত্রনার কথা স্মরণ করেছেন গার্সিয়া মার্কেসের ছেলে রদ্রিগো গার্সিয়া। বাবা মায়ের চিরবিদায় নিয়ে রদ্রিগো নিজেরই তীব্র শোকের কথা লিখেছেন Gabo y Mercedes: una despedida (যার ইংরেজি শিরোনাম Gabo and Mercedes: a farewell) নামে তার নতুন বইটিতে।
কলম্বিয়া আর স্পেনে এই গভীর আবেগী শ্রদ্ধার্ঘ্যটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা সংস্থা র্যান্ডম হাউজ । রদ্রিগো গার্সিয়ার বাবা ২০১৪ সালে এবং মা মের্সেদেস বার্চা ২০২০ সালে অগাস্টে মারা যান। তাঁদের স্মৃতির প্রতি নিবেদন করেছেন তার এই সর্বশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি। রদ্রিগো লিখেছিলেন, “আমার বাবা সবসময় অভিযোগ করতেন যে তিনি যেসমস্ত ব্যাপার সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করেন তার মধ্যে একটি হলো মৃত্যু, তার জীবনে এটিই হবে একমাত্র বিষয় যা নিয়ে তিনি লিখতে পারবেন না” ।
রদ্রিগোর বইটিতে তার বাবা-মায়ের অন্তিম দিনগুলোর সাথে ঐ সব মৃত্যুর গল্পকে মিলিয়ে দেখানো হয়েছে, যেগুলো গার্সিয়া মার্কেস বাস্তবেই লিখেছিলেন যেমন, The General in His Labyrinth– এর স্বাধীনতাকামী নেতা ‘সিমন বলিভার’ জানালা দিয়ে তিনি সন্ধ্যাতারার আলো চিরতরে নিভে যেতে দেখছিলেন অথবা নিঃসঙ্গতার একশো বছর -এর মাতৃসত্তা উরসুলা ইগুয়ারান ইস্টারের আগের পবিত্র বৃস্পতিবারে মৃত্যু থেকে জেগে উঠেছিলেন। ঠিক তার বাবার মতো। মার্কেস ২০১৪ সালে পবিত্র বৃহস্পতিবারে ৮৭ বছর বয়সে মারা যান। পবিত্র বৃহস্পতিবার হচ্ছে যীশু খ্রীষ্টের শেষ সন্ধ্যা, এদিন শিষ্যদের পা ধুইয়ে দেয়ার মধ্যে দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করেন।
রদ্রিগো একজন চলচিত্র পরিচালক। তার বাবার বইগুলোকে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করার জন্য গত কয়েক বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত মার্কেসের নন-ফিকশন নিউজ অফ এ কিডন্যাপিং চলচ্চিত্রে রূপদানের কাজ করছেন নিবার্হী প্রযোজক হিসেবে যা অ্যামাজন প্রাইম প্রযোজনা করছে আর বর্তমানে চিত্রায়িত হচ্ছে কলাম্বিয়ায়। এবং নেটফ্লিক্স-প্রযোজিত সংস্করণ ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিচুড-এর প্রি-প্রোডাকশন পর্যায়ে কাজ করছেন। কিন্তু পরিবারটি সবসময়ই তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি প্রকাশ না করার ব্যাপারে সতর্ক ছিল। তার মা সবসময় বলতেন, “আমরা পাবলিক ফিগার নই।” তিনি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে ভীষণ রক্ষণশীল ছিলেন। এই অবস্থায় তার বাবা মাকে যে বেদনা সইতে হয়েছে তার ভেতরে পাঠককে নিয়ে যাবার জন্য বইটি হচ্ছে একটি ছোট্ট জানালার মতো। গার্সিয়া মার্কেস ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তার জীবনের শেষদিনগুলোর কষ্টের কিছুটা পাঠককে অনুভব করাবে বইটি।
রদ্রিগো বলেন ” আমি জানি যে এই স্মৃতিগুলি আমি তখন প্রকাশ করতে পারিনি, যখন আমার মা এসব পড়তে পারতেন। যদি আমার বাবা মা এখন এটি পড়তে পারেন তাহলে আমি ভাবতে চাই যে, তারা গর্বিত এবং আনন্দিত হবেন। তবে আমার মা এটিও বলবেন, ‘কি গালগপ্প করেছ তুমি’!
ছেলের বই অনুসারে, গার্সিয়া মার্কেস তার অন্তিম দিনগুলিতে ধীরে ধীরে স্মৃতি হারাতে শুরু করেন, একটা সময়ে পরিচিত মুখগুলিকে স্মরণ করতে তাকে খুব বেগ পেতে হচ্ছিল। বইয়ের একটি অনুচ্ছেদে আছে গার্সিয়া মার্কেস যখন তাঁর স্ত্রীকে চিনতে পারছিলেন না। বলছিলেন,” কে এই নারী; বাসায় হুকুম দিচ্ছে আর চারপাশে ছুটে বেড়াচ্ছে, যেন এই বাড়িটি আমার না? ঘরের ওপাশের লোকজন কারা?” তিনি তার দুই পুত্র রদ্রিগো এবং গনছালো সম্পর্কে এক গৃহকর্মীকে জিজ্ঞাসা করেন। “এটা আমার বাড়ি নয়। আমি ঘরে যেতে চাই। বাবার বাড়িতে।” অন্য একটি উপলক্ষ্যে মার্কেস একথা বলেছিলেন, যখন তিনি দাদার বাড়ি থেকে ঘরে ফিরতে চান। একজন কর্নেল আট বছর বয়স পর্যন্ত মার্কেসকে দেখাশোনা করেছিলেন এবং যিনি আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার চরিত্র নির্মাণে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন।
কিন্তু গার্সিয়া মার্কেস তাঁর অন্তিম দিনগুলিতে, কলম্বিয়ার আরাকাতাকা গ্রামে কাটানো শৈশবের সবচেয়ে মূল্যবান মুহূর্তগুলি পুনরায় যাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখানেই তিনি ১৯২৭ সালে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। নোবেল পুরষ্কারজয়ী লেখক স্প্যানিশ স্বর্ণযুগের কিছু কবিতাও আবৃত্তি করতে পারতেন। রদ্রিগো বলেন, “এবং তিনি যখন আর এটি করতে পারলেন না তখনও তিনি তার প্রিয় সঙ্গীতগুলি গাইতে পারতেন”। কলম্বিয়ার ক্যারিবিয় অঞ্চলের জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত ‘বাইয়্যেনাতোস’ শুনে তার জীবনের শেষ কটি দিন কাটিয়েছেন, যে সঙ্গীতের সঙ্গে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। নতুন এই বইয়ে রদ্রিগো লিখেছেন, ” এমনকি শেষ মাসগুলিতেও, যখন সে আর কিছু মনে করতে পারত না, অ্যাকর্ডিয়নের প্রথম কয়েকটি ধ্বনিতে তার চোখ জোড়া আবেগে চমকে উঠত। সর্বশেষ দিনগুলোতে নার্স তার বেডরুমের জানালা হাট করে খোলা রেখে উচ্চ শব্দে ‘বাইয়্যেনাতো’ বাজাতে শুরু করেছিলো। কলম্বিয়ার ‘বাইয়্যেনাতো’ সঙ্গীতস্রষ্টা রাফায়েল এস্কালোনার গানগুলি ঠিক যেন ঘুমপাড়ানি গানের মতো চিরবিদায় বলার জন্য মেক্সিকোয় তাদের পুরো বাড়িটি জুড়ে বেজে চলল। রদ্রিগো লিখেছেন “এগুলি আমাকে তাঁর অতীতে নিয়ে যায়,যা আর কিছু নিয়ে যেতে পারে না”।
যদিও বিখ্যাত এই লেখক ডিমনেশিয়ার সাথে লড়াই করেছিলেন, রদ্রিগো বলেন ” তাঁর জীবনের শেষ ধাপটি সহজতর ছিল। একটি ভীতিকর পর্যায় আছে যেখানে ব্যক্তি জানে যে তারা তাদের স্মৃতিশক্তি হারাচ্ছে। ব্যক্তিটিকে কেবল তার শারীরিক কার্যক্ষমতা ছাড়া দেখা নয়, তার বিদায়ের ব্যাপারে খুব শঙ্কিত হওয়াটাও আতঙ্কজনক এবং খুবই কঠিন। শেষ স্তরটি বেদনাদায়ক ছিল, কিন্তু শান্তিপূর্ণ ছিল। তিনি শান্ত ছিলেন, উদ্বিগ্ন ছিলেন না, তিনি অনেকটা বিহ্বল ছিলেন। অনেক কিছুই তিনি মনে রাখেননি, কিন্তু ভালো ও স্থির ছিলেন এবং এটিই আমাদের সান্ত্বনা যুগিয়েছে”।
যদিও রদ্রিগোর বইটার অধিকাংশই তাঁর বাবার মৃত্যু নিয়ে, শেষ অধ্যায়টি তার মায়ের প্রস্থানকে কেন্দ্র করে রচিত। মাকে ডাকা হতো ‘লা গাবা’ বলে। এই নামটিকে রদ্রিগো ‘পুরুষবাচক’ হিসেবে জানতেন। কিন্তু সবকিছু সত্ত্বেও, যারা তাকে চেনে তারা সবাই জানত যে সে নিজেই নিজের একটি দুর্দান্ত সংস্করণে পরিণত হয়েছে। রদ্রিগো বইটিতে তাকে “তার সময়ের নারী” হিসাবে বর্ণনা করেছেন: একজন মা, স্ত্রী এবং গৃহিণী যিনি কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি। তার পরেও, তিনিই ছিলেন যিনি তার স্বামীর সফলতাকে পরিচালনা করেছিলেন এবং তার দৃঢ়-আত্মপ্রত্যয়ের জন্য ঈর্ষার পাত্রী হয়েছিলেন।
মের্সেদেস বার্চা করোনার অতিমারীর মাঝে ২০২০ সালে মারা যান। কোন বন্ধু স্বজনের বিলাপ বা সমাগম ছাড়াই।
এল পাইস পত্রিকায় প্রকাশিত কামিলা অসোরিও রচিত নিবন্ধ অবলম্বনে