গ্রন্থাগারের জন্য ভালোবাসা

১৯৭১, মিশিগানের ট্রয় শহরের গ্রন্থাগারিক মার্গারেট হার্ট স্থানীয় শিশুদের জন্য নতুন স্থাপিত গ্রন্থাগারের উপকারিতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু লেখার জন্য সমাজের বিশিষ্টজনদের অনুরোধ করেন। এ জন্য তিনি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন শিল্পী, লেখক, রাজনীতিবিদদের, এমনকি ধর্মজাযকদেরও অনুরোধ করেন। এর প্রতিউত্তরে ডঃ সিউস, পোপ পল ষষ্ঠ, নিল আর্মষ্ট্রং, কিংসলে আমিস ও আইজ্যাক আসিমভ-এর চিঠিসহ ৯৭টি লেখা আসে।

৪৫ বছর পর গত ৬ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস উপলক্ষ্যে ইংল্যান্ডের আর্ট কাউন্সিল সেই চিঠিগুলির বরাদ দিয়ে আরেকবার ট্রয় গণগ্রন্থাগারের জন্য লেখা আহবান করা হয়। আর এতে বেশ সাড়া পড়ে। আর্ট কাউন্সিলের পরিচালক ব্রায়ান এ্যশলে বলেন, “গ্রন্থাগারের জন্য স্মৃতি সংরক্ষণে বিভিন্ন লেখক ও ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে যে সাড়া আমরা পেয়েছি তা অভূতপূর্ব। তখনকার সময় থেকে তা সংখ্যায় বা রূপে ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু গ্রন্থাগারের জন্য এ ধারণা ও এর গুরুত্ব একই থাকবে।

অ্যান ক্লিভস্, অপরাধবিষয়ক লেখক ও ২০১৬ সালের জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের দূত

তুমি এই গ্রন্থাগার সম্পর্কে যা জানো ও ভাবো সবকিছু ভুলে যাও। এটি বিরক্তিকর কিছু না, আর বাদও দেবার প্রয়োজন নেই। এটি স্কুলের মতো না। এখানকার বই তোমাকে কখনও অতীতে নিয়ে যাবে আবার কখনও ভবিষ্যতে। তারা ডাইনোসর ও মহাশূন্য সম্পর্কে তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। আর প্রত্যেক গ্রন্থাগার গল্পে গল্পে ভরপুর। গল্পগুলিতে রয়েছে বস্তাবন্দি জাদু যা তোমাকে মুক্তি দিতে পারবে। এগুলি এতই বাস্তব যে তুমি ভাববে এটি তোমার জীবনের কথা বলছে। কিছু কিছু গল্প এতই ভয়ংকর যে তোমার সমস্ত সাহস উবে যাবে। কিছু কিছু গল্প পড়ে তুমি হাসতে হাসতে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবে। সকলে ডাক্তার হতে পারে না বা বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার সহকারী হয় না কিন্তু যে কেউ চাইলেই গ্রন্থাগারে যুক্ত হতে পারে। তাহলে তুমি কেন যাবে না?

কারিস ম্যাথিউজ, সুরকার ও রেডিও উপস্থাপক

তোমার কাঁধে থাকা শয়তানটি হয়তো চিৎকার করে বলবে, “আমি বিরক্ত”, ওটাকে গুরুত্ব না দিয়ে হেঁটে গ্রন্থাগারে যাও। একটু আরাম করে বসো আর শয়তানের ভাবনাটাকে শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করো। যেমন-ভেংচানো দানব থেকে অশ্রুপাত করা মাছ, ঘোড়াবহনকারী মেয়েমানুষ থেকে যুদ্ধের ঘোড়া, ট্যারান্টুলাস, মহাশূণ্যে হাঁটা, লৌহমানব এবং শূকরের খামার। সব থেকে ভালো জিনিস কি জানো? এটা বিনামূল্যের একটি চুক্তি যা কি-না শয়তানকে দোজখে তোলার চুক্তি।

নাদিয়া হোসেন, শেফ, কলাম লেখক ও বিবিসি’র “দ্য গ্রেট ব্রিটিশ বেক্ অফ” পুরস্কার বিজয়ী

ব্রিটেনের প্রিয় শিশুরা,

কোন ট্যাবলেট, টেলিভিশন, ল্যাপটপ কিংবা গেম তোমার মনের কল্পনাকে পূর্ণতা দিবে না যা দিতে পারে একটি বই। তাই একটি বই তোল, শব্দগুলি পড়, দেখবে তোমার কল্পনা তোমাকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে গেছে যেখানে কোন ইলেকট্রনিক যন্ত্র তোমাকে কখনও নিয়ে যেতে পারবে না।

তাই বইকে ভালোবাসো, পড়াকে ভালোবাসো এবং তোমার মনের ইচ্ছাপূরণ করো।

নাদিয়া।

রবিন ইন্স, কৌতুকাভিনেতা, অভিনেতা ও লেখক

গ্রন্থাগার সম্পর্কে আমার প্রথম স্মৃতি হচ্ছে, আমাদের গ্রামে প্রতি শুক্রবার সকালে একটি ভ্রাম্যমান গ্রন্থাগার আসার ঘটনা। আকারে বৃহৎ সেই ভ্যানটি বাইরে থেকে আসা উদ্ভট ধরনের ছিল, যার তাক ভর্তি অসংখ্য বই। ভিতরে পা রাখলে প্রথমে কিছুটা টলে যেতে হত। এটা অনেকটা টারডিসের মতো, ভিতরে অনেক জায়গা।

ভ্যানটি অসংখ্য কল্পনা বা ধারণা ও সম্ভাব্য অভিযানে ভরপূর ছিল।

আমার শৈশবে সেই স্থানীয় গ্রন্থাগারকে এখন খুব বড় কিছু বলে মনে না হলেও যখন আমার বয়স আট ছিল তখন ওটাকে বইভর্তি একটি বিশাল গীর্জার মতো মনে হতো।

আমার অর্ডার দেয়া প্রথম বইটির নাম ছিল দ্যা মেকিং অব ডক্টর হু। কিন্তু গ্রন্থাগারে একটি মাত্র কপি থাকার কারণে সার্ভিস বিভাগ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জানায় যে, চোরলেউডের একটি বালক সিলুরিয়ান এবং সিডস অব ডুম (এলিয়নভিত্তিক ফিকশন) বই সম্পর্কে আগ্রহী। জবাব আসে মাত্র চারটি কপি আছে। স্ট্যাম্পের তারিখের দিকে তাকালাম, একটি বই ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বের করা যাচ্ছিল না (তখন ছিল ১৯৭৭ সাল)। মনে হচ্ছে ঐতিহাসিক ঘটনা।

কালির সেই স্ট্যাম্পের দিন এখন চলে গেছে এবং আমার ছেলেও আর সেই চারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আজ বই যন্ত্রে স্থান পেয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তি ও কৌশল আমাদের হাতে বই তুলে দিচ্ছে। এমনকি আমাদেরও আগে রোবট বই খুলে রহস্যের স্বাদ নিচ্ছে।

গ্রন্থাগার হল হাজার হাজার জীবিত ও মৃত মানুষের কল্পনা ও চিন্তার ঘর। গ্রন্থাগারে একটি ভালো দিন কাটানো মানে পৃথিবীকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা। হয়তো তুমি বোঝ তারা কিভাবে জ্বলে, কিভাবে উল্কাপাত হয়, অথবা একজন মহাকাশচারী হতে কত সময় লাগে, অথবা ড্রাগনের মোকাবেলা করেছ বা অতীতের কোন ভয়ংকরতম ইতিহাস আবিস্কার করেছ। গ্রন্থাগার হল সেই জায়গা যেখানে আমরা তৈরী হতে পারি।

মেগ রসোফ, হাউ আই লিভ নাউ-এর লেখক

যার জন্য প্রযোজ্য

গ্রন্থাগারে স্বাগতম

যেখানে

কেউ তোমাকে বলবে না তুমি কী পড়বে

বা বলবে না তুমি কি ভাববে।

কেউ তোমায় বিরক্ত করবে না

বা ভয় দেখাবে না।

কারো প্রতিবেদনেরও দরকার হবে না;

বা তোমার সংশোধন করতে হবে না।

তুমি একজন গুপ্তচর হতে পারো

আঁকো ছবি।

অথবা ঘুমাও।

তুমি লিখতেও পারো,

অথবা ঘুরে বেড়াতে পারো।

পরামর্শ চাও

সাহায্য চাও

যে কোন কিছু ভাবো

সবকিছু

অথবা আদৌ কিছুই না।

কেউ তোমাকে থামাবে না।

কেউ এমনকি সে চেষ্টাও করবে না।

যাহোক,

একটি বই

ঐখানে

তাকের উপরে

তোমার দিকে তীর্যক দৃষ্টি ফেলবে

সাহস নিয়ে উঠে পড়

বের হয়ে পড়

তোমাকে হাসতে শেখাবে

কাঁদতে শেখাবে

তোমাকে প্রেমে পড়তে শেখাবে।

আমি সেরকম একটি বই লেখার চেষ্টা করছি এখন।

গ্রন্থাগারে।

ভালোবাসা রইল,

আমি

তথ্য সুত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart