আলোকচিত্র: তারকনাথ দাস (১৫ই জুন ১৮৮৪ – ২২শে ডিসেম্বর ১৯৫৮) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম বিপ্লবী নেতা এবং একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী।
১৯০৮ সালে, ভারতীয় বাঙালি বিপ্লবী ও পণ্ডিত তারকনাথ দাস তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব লিও তলস্তয়কে চিঠি লিখেছিলেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতের স্বাধীনতায় তলস্তয়ের সমর্থন চেয়ে তারকনাথ দাস চিঠি লিখেছিলেন।
তলস্তয়, যিনি জীবনের সবচেয়ে বড় নৈতিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শেষ বিশ বছর অতিবাহিত করেছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর, একটি দীর্ঘ চিঠিতে জবাব দিয়েছিলেন তলস্তয় । তারকনাথ দাস ভারতীয় সংবাদপত্র ‘ফ্রি হিন্দুস্তান’-এ চিঠিটি প্রকাশ করেছিলেন। এক হাত থেকে আরেক হাত ঘুরে, পত্রিকাটি অবশেষে তরুণ মহাত্মা গান্ধীর কাছে গিয়ে পৌঁছায়। তিনি তখন দক্ষিন আফ্রিকায়। সেখানকার ভারতীয় সম্প্রদায়ের নাগরিক অধিকার আদায়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নেতা হিসেবে সবেমাত্র আত্মপ্রকাশ করেছেন। সেখানে গান্ধী তার অধীনে থাকা সংবাদপত্র ইন্ডিয়ান ওপিনিয়নে এটি পুনঃপ্রকাশের অনুমতি চেয়ে তলস্তয়কে একটি চিঠি লিখেছিলেন। টলস্টয়ের চিঠিটি পরে ইংরেজিতে A Letter to a Hindu শিরোনামে প্রকাশিত হয়। গান্ধী চিঠিটি নিজে গুজরাটি ভাষায় অনুবাদও করেছিলেন।
তারকনাথ দাস (১৫ই জুন ১৮৮৪ – ২২শে ডিসেম্বর ১৯৫৮) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম বিপ্লবী নেতা এবং একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী।
এই পত্র-বিনিময় তলস্তয়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলছিল, যা দুজনের মধ্যে বিদ্যমান ঐক্যকে উদীপ্ত করে। এর মাধ্যমে দুই মহান হৃদয় ও আদর্শের মিলন ঘটেছিলো। অবশেষে সব সংগৃহীত ও একত্রিত হয়ে Letters from One: Correspondence (and more) of Leo Tolstoy and Mohandas Gandhi এই নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়।
অহিংস প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য তলস্তয়ের চিঠিগুলো এক সুস্পষ্ট ডাক দেয়। মানুষের সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতাকে যা উস্কে দেয় সেই ধর্মীয় এবং অপ-বৈজ্ঞানিক মিথ্যা মতাদর্শের বিরুদ্ধে সতর্ক করেন। এসবের মধ্যে এমন আচরণ খুঁজে পান যা মানুষের মানবীয় প্রবৃত্তির বিপক্ষে। ভালবাসার ধর্ম-“প্রেমের বিধান”-এর পক্ষে সমর্থন দেন; এটিই কেবল মানুষকে সবচেয়ে স্বাভাবিক ও মৌলিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারে।
প্রেম এবং সহানুভূতি সম্পর্কে তলস্তয়ের বিশ্বাস ছিল যে,শুধুমাত্র স্বর্গীয় আশির্বাদ বা আধ্যাত্মিক বর প্রাপ্তির জন্যই নিজেকে নিবেদিত করা নয়; পৃথিবীর বস্তুগত লোভ, স্বার্থপরতা, অহংকার, ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণ-মানসিকতা ইত্যাদি ত্যাগ করার চেষ্টা করে নিজের সত্তাকে বিশুদ্ধ রাখা। আর সাধারনভাবে সর্বক্ষেত্রে ভাল কাজ করা হচ্ছে প্রেমের বিধান।
আর শয়তান কিংবা মানুষের মন্দ দিক? তলস্তয় প্রচন্ড আবেগ ও দৃঢ়তার সাথে যুক্তি দেখান, জুলুম হিংসা জ্বালাও পোড়াও দিয়ে নয়, বরং প্রেম ও সংযম দ্বারাই ‘শয়তান’ দমন হয়।
মূল সংস্করণের ভূমিকায় গান্ধী তলস্তয়কে পাশ্চাত্যের একজন বিশুদ্ধতম চিন্তাবিদ এবং শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন হিসেবে উল্লেখ করেন। রচিত বিষয় সম্পর্কে মোটাদাগে একটি সতর্কতাও জুড়ে দেন। ঠিক বর্তমান সময়ের মতোই এক শতাব্দী আগেও তা ছিল যথাযথ।
” তার আর্জির কেন্দ্রীয় সত্য উপলব্ধি করবার জন্য, তলস্তয় যা বলেন তা পুরোটাই কারোর জন্য গ্রহন করার প্রয়োজন নেই”।
“কোন সন্দেহ নেই যে তলস্তয় যা আলোচনা করেছেন তাতে নতুন কিছু নেই। কিন্তু তার পুরোনো সত্যের উপস্থাপনা প্রবলভাবে সতেজ। তার যুক্তি অখণ্ডনীয়। সর্বোপরি তিনি যা প্রচার করেন তা চর্চা করার চেষ্টা করেন। তিনি ব্যাখা করতে শেখান। তিনি সৎ এবং আন্তরিক। তার নির্দেশ মনোযোগের দাবী করে”।
তলস্তয়, চিঠির দৈর্ঘ্যে তার বার্তার এক একটি অধ্যায় তুলে ধরেছেন। যা আদতে, আমাদের সময়ের অস্পষ্ট, গৌণ এবং হঠকারী নানান মত পার্থক্যগুলোকে স্পষ্ট প্রেক্ষাপট দেয় । সত্যিকারের চিন্তাশীল প্রতিফলনের সাথে নিছক প্রতিক্রিয়াশীলতার পার্থক্যকে সামনে রাখে। তার রাজনৈতিক, নৈতিক এবং মানবতাবাদী যুক্তিগুলির নেপথ্যে শ্রীকৃষ্ণের এক একটি বানী উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এ ছাড়াও চিঠিতে তিনি বেদ, উপনিষদ, বাইবেল,তিরুক্কুয়া থেকে স্তবক ব্যবহার করেছেন। উল্লেখ করেছেন স্বামী বিবেকানন্দের কথা। (প্রাচীন তামিল নৈতিক সাহিত্য ‘তিরুক্কুয়া’ যা তলস্তয় চিঠিতে ‘হিন্দু কুরাল’ বলে অভিহিত করেছেন।গান্ধী কারাগারে থাকাকালীন কুরাল অধ্যয়ন শুরু করেন। ) তলস্তয় দেখছেন পৃথিবীর সকল ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থে প্রেমের বিধান প্রবল হয়ে উঠেছে এবং তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে প্রতিবাদ, ধর্মঘট এবং হিংসাত্মক বিপ্লবের একমাত্র বিকল্প হলো শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ ও অন্যান্য রূপে প্রেমের বিধানের ব্যক্তিগত, অহিংস প্রয়োগ। এই ধারণাগুলি শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সফল প্রমাণিত হয়েছিল।
তলস্তয়ের কথাগুলো আজও লক্ষ্যণীয় দূরদর্শিতা বহন করে। যেহেতু আমরা রাজনৈতিক অস্থিরতা, জাতিগত বিদ্বেষ সহিংসতা এবং বৈশ্বিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের ক্রমবর্ধমান জোয়ারের মুখোমুখি , ফলে তলস্তয়কে এই ক্ষেত্রে এখনও আমাদের সমসাময়িক বলে মনে হয়।
“আশ্চর্যজনক সত্যের কারণটি হলো বেশিরভাগ শ্রমজীবী মানুষ মুষ্টিমেয় অলসদের কাছে বশ্যতা মেনে নেয়। ঐ অলসরা তাদের শ্রম এবং একান্ত জীবন যাপনকে নিয়ন্ত্রণ করে সর্বদা-সর্বত্র একইরূপে। নিপীড়ক এবং নিপীড়িতরা অভিন্ন জাতি-বর্ণের হোক বা না হোক… সব নিপীড়কের জাত এক ।
কারণটি নিহিত আছে সঠিক যুক্তিসঙ্গত ধর্মত্বাতিক শিক্ষার অভাবের মধ্যে, যে-শিক্ষা জীবনের অর্থ ব্যাখা করে একটি সর্বোচ্চ আইনের যোগান দিবে । অপধর্মীয় ও অপবিজ্ঞানের দ্বিধাযুক্ত নীতিগুলির অসঙ্গত উপসংহার সরিয়ে নৈতিক আচরণের পথনির্দেশনাকে প্রতিস্থাপিত করবে তাদের জন্য যাদেরকে সাধারণভাবে ‘সভ্যতা’ বলে অভিহিত করা হয়”।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, তলস্তয়ের “ধর্মীয় শিক্ষার” ধারণাটি সম্ভবত “আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা”র ইঙ্গিত। কারণ তিনি সকল প্রধান ধর্মীয় ও দার্শনিক ঐতিহ্যগত জ্ঞান বেছে বেছে সমন্বয় করে নিজের জন্য একটি সঠিক আধ্যাত্মিক দিক উপলব্ধি করার জন্য জীবনের বড় একটা অংশ উৎসর্গ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি চিঠিতে সরাসরি সেই দিকটির কথাই বলেছেন:
“প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে একটি আধ্যাত্মিক উপাদান উদ্ভাসিত হয় যা বিদ্যমান সকল অস্তিত্বকে জীবন দান করে, এবং এই আধ্যাত্মিক উপাদানটি তার মতো প্রকৃতির সকল কিছুর সাথে একত্রিত হবার চেষ্টা করে এবং প্রেমের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করে…
এই চিন্তাধারাটি বিভিন্ন সময়ে এবং স্থানে বিভিন্ন রূপে উপস্থিত হয়েছিল, বৈচিত্র্যময় পূর্ণতা এবং স্বচ্ছতার সাথে। এটি ব্রাহ্মণবাদ, ইহুদি ধর্ম, মাজদা ধর্ম (জরথুস্ত্রের একটি শিক্ষা), বৌদ্ধধর্ম, তাওবাদ, কনফুসিয়ানিজম এবং প্রাচীণ গ্রীক ও রোমান ঋষিদের লেখার পাশাপাশি খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলামের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।
সহজ সত্যটি হলো বিভিন্ন জাতিতে এবং বিভিন্ন সময়ে উদ্ভুত এই ভাবনাটি ইঙ্গিত করে যে এটি মানুষের স্বভাবে প্রচ্ছন্নভাবে আগে থেকেই ছিল এবং তা সত্যকে ধারণ করে। কিন্তু এই সত্যকে এমনভাবে মানুষের কাছে পরিচিত করানো হয়েছিল যাতে তারা বিশ্বাস করে একটি সম্প্রদায়কে তখনই একত্র রাখা যায় যখন তাদের মধ্যে কিছু লোক অন্যদের দমন করবে, তাই এটি সমাজের বিদ্যমান শৃঙ্খলার সাথে পুরোপুরি শত্রুভাবাপন্নরূপে দেখা দেয়”।
তিনি মনে করেন যে, কিভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শগুলো মানব ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে প্রেমের এই মৌলিক বিধানকে ছিনতাই করেছে এবং এটির জায়গায় হিংস্র পরাধীনতার আইন প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করেছে:
“জবরদস্তিমূলক সমাজে সত্যের প্রচারকে সর্বদা এক এবং একই পদ্ধতিতে থামানো হয়। যেমন, ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা মনে করে যে, এই সত্যের স্বীকৃতি তাদের অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সচেতনভাবে বা কখনও অবচেতনভাবে ব্যাখ্যা করে এটিকে বিকৃত করে, সম্পূর্ণ বহিরাগত সংযোজন এবং প্রকাশ্য সহিংসতার মাধ্যমে এর বিরোধিতাও করে। অতএব এই সত্যটি – যে একজনের জীবনকে আধ্যাত্মিক উপাদান দ্বারা পরিচালিত করা উচিত যা তার আদিম ভিত্তি, যা নিজেকে প্রেম হিসাবে উদ্ভাসিত করে, এবং যা মানুষের কাছে খুবই স্বাভাবিক সহজাত -এই সত্যকে মানুষের চেতনা অবধি জোর করে পৌঁছাতে হয়েছে। যে ক্ষীণালোকে এর জন্ম হয়েছিল তা ছাপিয়ে উঠে প্রকাশিত হওয়ার জন্য তাকে লড়তে হয়েছিলো। তার চারপাশে ঘিরে থাকা ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত বিকৃতিগুলির বিরুদ্ধে তাকে কেবল সংগ্রাম করতে হয়নি, আরও সংগ্রাম করতে হয়েছে সুপরিকল্পিত সহিংসতার বিরুদ্ধেও। যে উপায়ে দমন পীড়ন এবং শাস্তির মাধ্যমে চাওয়া হয়েছে শাসকদের দ্বারা অনুমোদিত ধর্মীয় আইনগুলি মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হবে এবং সত্যের সাথে বিরোধ করবে। ‘ভালবাসা’ যে সর্বোচ্চ নৈতিকতার প্রতিনিধিত্ব করে তা কোথাও অস্বীকার করা হয়নি বা বিরোধিতা করা হয়নি, কিন্তু এই সত্যটি সর্বত্র সব ধরণের মিথ্যাভাষণে এতটাই আবদ্ধ ছিল যা এটিকে বিকৃত করে দিয়েছিল। অবশেষে কয়েকটি বাক্য ছাড়া এর কিছুই অবশিষ্ট রইল না। এটা শেখানো হয়েছিল যে এই সর্বোচ্চ নৈতিকতা অর্থাৎ ‘প্রেম’ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত একান্ত জীবনের জন্য প্রযোজ্য – গৃহে ব্যবহারের জন্য – যেন এটি সেখানেই ছিলো- কিন্তু জনজীবনে সব ধরনের সহিংসতা – যেমন কারাবাস, মৃত্যুদণ্ড এবং যুদ্ধ – ব্যবহার করা যেতে পারে সংখ্যাগরিষ্ঠের সুরক্ষার জন্য সংখ্যালঘু দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে। যা কিছুই ঘটুক না কেন এই মাধ্যমগুলি ভালবাসার সেই অবশিষ্টাংশের সম্পূর্ণভাবে বিপরীত। এবং তারপরেও, সাধারণ জ্ঞান নির্দেশ করে, যদি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি গোষ্ঠী অন্যদের সুবিধার জন্য সংখ্যালঘু অংশের প্রতি সব ধরণের সহিংস কান্ড ঘটাতে পারে, তবে সেই সহিংসতার শিকারে পরিণত হওয়া গোষ্ঠী এক সময় মনে করতে পারে তাদের উপর যারা সহিংসতা ঘটিয়েছে তাদের প্রতিও একই ধরনের সহিংস আচরণ করা যেতে পারে। যদিও সকল ধর্মের মহান ধর্মীয় শিক্ষকরা প্রেমের আইনের অনুরূপ বিচ্যুতির আভাস দিয়ে ক্রমাগত প্রেমের একটি অপরিবর্তনীয় অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে গেছেন। যেমনঃ অসৎ কর্মকে মন্দের দ্বারা প্রতিহত না করে বরং আঘাত, অপমান ও সহিংসতাকে ধৈর্যের সাথে সহ্য করতে বলেছেন। কিন্তু মানুষ চলতে থাকে-যাই হোক না কেন সে এগিয়ে যায় আর সে অসঙ্গতিগুলি একত্রিত করার চেষ্টা করে: প্রেমের গুণ নিয়ে অথবা সেটার বিপরীতে গিয়ে মন্দকে সহিংসতা দিয়ে প্রতিরোধ করে। এ ধরনের শিক্ষা, এমনকি মনের ভিতর সাড়া না দিলেও, এমন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে যারা প্রেমকে একটি পূণ্য কর্ম হিসেবে স্বীকার করে তারাও ঠিক একই ধরনের জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। যে ব্যবস্থা সহিংসার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। সেখানে মানুষ শুধুমাত্র সহিংসতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং একে অপরকে হত্যা করার দিকেও ধাবিত করে”।
তিনি এই ধারনাকে ‘সনাতন এবং সরল সত্য’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেনঃ
“একে অপরকে সাহায্য করা ও ভালবাসা এটাই মানুষের জন্য সহজাত, নির্যাতন এবং হত্যা করা নয়।
ধর্মের ভুল ব্যাখা এবং বৈজ্ঞানিক বিশিষ্টকরণ বা ন্যূনতাবাদ উভয় ক্ষেত্রে তলস্তয় অভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন- যা নিঃসন্দেহে বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বড় একটি হুমকির মতো অনুভূত হয়েছিল, যখন বিজ্ঞান ভৌত মহাবিশ্বকে তার মৌলিক আণবিক এককে ভেঙ্গে ফেলতে শুরু করেছিল, এই আবিষ্কারটি নিয়ে অনেকেই আশঙ্কা করেছিল যে এটি এমন একটি বিশ্বাস তৈরি করতে পারে যে “মানবসত্তা শারীরিক ‘বস্তু’ ছাড়া আর কিছুই নয়”। টলস্টয় যুক্তি দেন, বিজ্ঞান এবং ধর্ম উভয়ই বিপজ্জনক গোঁড়ামিতে পরিণত হতে পারে যা প্রেমের মৌলিক নিয়মের প্রতি আমাদের অন্ধ করে দেয়। যদি তার বাহ্যিক সুবিধাটুকু রেখে বাকি সব বিবরণ কেড়ে নেয়া হয়, তাহলে যে বিপদটি হবে- যেমটি তিনি বলেছেন “ধর্মীয় কুসংস্কারের জায়গায় বৈজ্ঞানিক কুসংস্কার প্রতিস্থাপিত হবে”।
তবে, ‘বৈজ্ঞানিক’ শব্দটি দিয়ে যে অর্থ বোঝায়, পূর্বে “ধর্মীয়” শব্দটি দিয়েও ঠিক একই অর্থ বোঝা যেত: আগে “ধর্মীয়” শব্দটি ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে সবকিছুকেই প্রশ্নাতীত বলে ধরা হত, কেননা, এটাকে ধর্মীয় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে…। তাই এখন যাকে “বৈজ্ঞানিক” বলা হয়, তা প্রশ্নাতীত বলে ধরে নেয়া হয়…। এই “বৈজ্ঞানিক সত্য” যে আড়ম্বরপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে হতভাগ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষরা এতটাই চমকে গেছে যে তাদেরকে সীমাহীন পরিশ্রম করতে বাধ্য হতে হয়েছে। নতুন এই প্রভাবের অধীনে পবিত্র সত্যের জন্য তারা এই সব বৈজ্ঞানিক অজ্ঞতাকে গ্রহণ করে, ঠিক যেমনভাবে পূর্বে তারা মিথ্যা-ধর্মীয় ন্যায্যতা গ্রহণ করেছিল”।
তিনি মূল বিষয়বস্তুতে ফিরে আসেন, গান্ধীর অহিংস প্রতিরোধের পক্ষে সমর্থন করার বিষয়টি পুনরায় নিশ্চিত করেন:
“মানবতাকে সমস্ত অসুস্থতা থেকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হল ভালোবাসা, এবং সেই সাথে আপনার জনগণকে দাসত্ব থেকে রক্ষা করার একমাত্র উপায়… ভালোবাসা, এবং অমঙ্গলকারীদের জোরপূর্বক প্রতিরোধের মধ্যে এমন পারস্পরিক দ্বন্দ্ব জড়িত, যা ভালবাসার ধারণাশক্তির মর্মার্থের সকল চেতনা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়” ।
ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশের কথা উল্লেখ করে, তলস্তয় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন, কিভাবে “একটি বাণিজ্যিক কোম্পানি দুইশো মিলিয়ন জনসংখ্যার একটি জাতিকে দাস বানিয়ে রেখেছে” এবং তিনি যুক্তি দেন, নিপীড়ক ও নিপীড়িত উভয়ই “মনুষ্যত্বের মজ্জাগত প্রেমের শ্বাশত আইনের” সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়েছিলো বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। তিনি লেখেন:
“যে মুহূর্ত থেকে মানুষ তার হৃদয়ের সহজাত প্রেমের বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবন যাপন করতে শুরু করবে , যা সহিংসতা দ্বারা সকল প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ত্যাগ করে এবং হিংস্রতায় সব ধরনের অংশগ্রহনকে নির্লিপ্ত করে- যখনই এটা ঘটবে- ঠিক তখনই তাদের কাছে প্রতিভাত হবে – শ’খানেক লোক লক্ষ লক্ষ মানুষকে দাস বানাতে পারছে না, আবার লক্ষ লক্ষ মানুষ মিলেও মাত্র একজন ব্যক্তিকে দাসে পরিণত করতে অক্ষম।
দুষ্কর্মকারীকে প্রতিরোধ করবেন না এবং তা করতে পারে এমন কিছুতে অংশ নেবেন না, না প্রশাসনের সহিংস কর্মকাণ্ডে, না আদালতে, কর আদায়ে বা সর্বোপরি সৈন্যবৃত্তির মধ্যে, এবং বিশ্বের কেউ সক্ষম হবে না আপনাকে দাসে পরিণত করতে”।
তলস্তয় সেই ” চিরন্তন আইন”-কে পুনরায় জাগ্রত করার প্রক্রিয়া বিবেচনা করে একটি ক্রমবিকাশী রূপকের প্রস্তাব দেন:
“এই সময়ে পশ্চিমের মতো পূর্বের মানুষের সাথে যা ঘটছে, একই রকম প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ঘটে যখন সে শৈশব থেকে কৈশোর এবং যৌবন থেকে প্রাপ্তবয়স্কের দিকে যায়। এই বয়সে এসে সে হারিয়ে ফেলে সেটা যা তার জীবনকে এপর্যন্ত পরিচালিত করেছিলো এবং সে কোন দিকনির্দেশনা ছাড়াই বাঁচতে থাকে। তিনি তার বয়সের উপযোগী কোন জুতসই মানদন্ড খুঁজে পান না । ফলে তিনি তার দুর্দশা এবং অসংবেদনশীলতা থেকে তার মনোযোগ সরানোর জন্য অন্য সব ধরনের উদ্ভাবনে মনোনিবেশ করে যেমন- পেশা, সেবাসমূহ, চিত্তবিনোদন ও মূর্খদলাদলি। এ ধরনের পরিস্থিতি দীর্ঘসময় ধরে চলতে পারে।
একজন ব্যক্তি জীবনের একটা সময় অতিবাহিত করার পর যখন আরেকটা সময়ে এসে পৌঁছায় তখন সে আগের মতো অর্থহীন কর্মকান্ড এবং উত্তেজনায় বেশিক্ষণ নিজেকে নিয়োজিত করে রাখতে পারে না , কিন্তু বুঝতে হবে এতদিন তাকে যা পথনির্দেশনা দিয়েছে বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে তাকেও অতিক্রম করে এগিয়ে এসেছে, তার অর্থ এই না যে তাকে কোন যুক্তিসঙ্গত দিকনির্দেশনা ছাড়াই এখন বেঁচে থাকতে হবে, বরং তাকে জীবনকে বোঝার জন্য বয়সের সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটি ধারণা প্রণয়ন করতে হবে এবং এটির ব্যাখা-বিশ্লেষণ অব্যাহত রেখে এর দ্বারাই পরিচালিত হতে হবে। এবং এই অভিন্ন পথে মানবতার বৃদ্ধি ও বিকাশেও একই রকম সময় অবশ্যই আসে- আমি বিশ্বাস করি যে, সে রকম সময় এখনই উপস্থিত হয়েছে – এই অর্থে নয় যে এটি ১৯০৮ সালেই এসেছে, কিন্তু মানুষের জীবনের অন্তর্নিহিত স্ববিরোধিতা এখন উদ্বেগের চরম মাত্রায় উপনীত হয়েছে: একদিকে ‘প্রেমের বিধানের’ দান হিসেবে চেতনা রয়েছে, এবং আরেক দিকে শতাব্দী পর শতাব্দী ধরে বিদ্যমান জীবনের ব্যবস্থায় সৃষ্ট- শূন্যতা, আশঙ্কা, অস্থিরতা এবং ক্লেশিত প্রত্যহিকতা,যা নির্মিত হয়েছে সহিংসতা ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে, যা প্রেমের বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। এই বৈপরীত্যের মুখোমুখি হতে হবে, এবং সমাধানটি অবশ্যই টিকে থাকা ‘ল অব ভায়োলেন্স “বা সহিংসতার আইনের পক্ষে যাবে না, কিন্তু সেই সত্যের দিকে যাবে যা মানুষের হৃদয়ের গীভরতম স্থানে অনাদিকাল থেকে বাস করে আসছে। যে-সত্যটি মানুষের সহজাত প্রকৃতি বা স্বভাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সেটি হলো “ল অব লাভ” বা ভালোবাসার বিধান।
কিন্তু মানুষরা কেবল তখনই এই সত্যকে পূর্ণ মাত্রায় চিনতে পারবে যখন তারা নিজেদেরকে পরিপূর্ণরূপে মুক্ত করতে পারবে সকল ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক কুসংস্কার থেকে এবং সকল প্রকার ভণ্ডামি আর আপাতদৃষ্টে সত্য মনে হওয়া বিকৃতিগুলো থেকে, যেসবের দ্বারা এই সত্যের স্বীকৃতি বহু শতাব্দী ধরে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
একটি ডুবন্ত জাহাজকে রক্ষা করার জন্য এর উপর থেকে ভারী বোঝাগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়, যদিও সেগুলো ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একসময় দরকার ছিল কিন্তু এখন সেগুলো ডুবে যাবার কারণ”।
বিশ্বজুড়ে চাপা উত্তেজনা ঘনীভূত হচ্ছে উপলব্ধি করে তলস্তয় ক্ষোভের সঙ্গে পূর্বাভাস যোগ করে বলেন “আমাদের সময়ে এই সমস্ত বিষয়কে এক এক করে কাটিয়ে উঠতে হবে যাতে মানবজাতি স্ব-প্রদত্ত বিপর্যয় এড়াতে পারে যা চরম তীব্রতায় পৌঁছেছে।” তলস্তয় গান্ধীকে এই কথা লিখবার পাঁচ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল ।
মানবতার সর্ববৃহত স্ব-প্ররোচিত দুর্যোগগুলির মধ্যে এমন একটি হচ্ছে আধুনিক যুদ্ধ যা আমাদের দেখিয়ে দেয়, তলস্তয়ের কল্পনা করা প্রেমের মৌলিক প্রকৃতিতে পৌঁছানোর আগে আমাদের এখনও অনেক দূর যেতে হবে – এই কারণেই গান্ধীর উদ্দেশে লেখা তলস্তয়ের শেষ কথাগুলি আজও ধ্বনিত হয় অত্যন্ত জোরালোভাবে:
“ভারতীয়দের জন্য যা প্রয়োজন একইভাবে ব্রিটিশ, ফরাসি, জার্মান এবং রাশিয়ানদের জন্যও প্রয়োজন,তা সংবিধান এবং বিপ্লব নয়, সব ধরনের সম্মেলন এবং কংগ্রেস নয়, সাবমেরিন নেভিগেশন এবং এয়ার নেভিগেশনের জন্য বুদ্ধিমান ডিভাইস নয়, না কোন শক্তিশালী বিস্ফোরক, না সেসব সেবা-সুবিধা যা শুধুমাত্র ধনী এবং শাসক শ্রেণীর ভোগবিলাসে যুক্ত হয়, বিজ্ঞানের অসংখ্য অনুষদসহ নতুন স্কুল আর বিশ্ববিদ্যালয় নয়, না পত্রিকা এবং পুস্তকের প্রবৃদ্ধি, না গ্রামোফোন এবং চলচ্চিত্র, না সেই শিশুসুলভ এবং অধিকাংশই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়া মূর্খতা যাকে শিল্প বলে অভিহিত করা হয়; একটি মাত্র জিনিস প্রয়োজন: সহজ ও স্বচ্ছ সত্যের প্রজ্ঞা যা প্রতিটি সত্তায় স্থান করে নেয় যা ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক কুসংস্কারগুলো দ্বারা অচেতন হয় না – সত্যটি যা আমাদের জীবনের জন্য এক মাত্র বৈধ আইন- প্রেমের বিধান,যা প্রতিটি ব্যক্তির পাশাপাশি সমস্ত মানবজাতির জন্য সর্বোচ্চ সুখ বয়ে আনে। আপনার মনকে মুক্ত করুন সেই জীর্ন,পাহাড়সম জড়তা থেকে যা আপনার স্বীকৃতিকে বাধা দেয় এবং ঠিক তখনই সত্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে ধর্মের মিথ্যা ছাইভস্মের ভেতর থেকে যা তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছিল: মানুষের মধ্যে থাকা সন্দেহাতীত, চিরন্তন সত্য, যা বিশ্বের সকল মহান ধর্মে এক ও অভিন্ন।
শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আট সপ্তাহ আগে ১৯১০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মহাত্মা গান্ধীকে আবার চিঠি লিখেছিলেন- এবার তলস্তয় আরো গভীর অনুভূতি নিয়ে বিষটি পুর্নবিবেচনা করেন-
“যতদিন আমি বাঁচি- বিশেষ করে এখন আমি ষ্পষ্টভাবে মৃত্যুর সান্নিধ্য উপলব্ধি করতে পারছি-আমি যতটুকু অনুভব করতে পারছি তা অন্য যে কোন কিছুর তুলনায় আরও বেশী জোড়ালোভাবে প্রকাশ করতে অনুপ্রাণিত বোধ করছি। আমার মতে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যাকে আমরা বলে থাকি ‘সকল বিরোধিতার বিসর্জন’ দাও। সহজ ভাষায় যা দিয়ে প্রেমের আইনের মতবাদ ব্যাখ্যা করা যায়। তবে পরিশীলিতজনদের কাছে বিষয়টি অপ্রচলিত। প্রেম, অথবা অন্য কথায় মানুষের আত্মার যে ঐক্য প্রচেষ্টা এবং একে অপরের প্রতি বিনয়ী আচরণের ফলে যে ঘটনাটি ঘটে তাহল- মানুষ জীবনের সবচেয়ে মহত্তম ও একটি মাত্র নিয়মকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। যেমনটি প্রতিটি মানুষ তার হৃদয়কে জানে এবং তাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারে (আমরা শিশুদের মাঝে সবচেয়ে ষ্পষ্টভাবে যেটা দেখতে পাই)। একজন মানুষের সেই জানা এবং উপলব্ধি ততক্ষণ পর্যন্ত বিরাজ করে, যতক্ষণ না সেই মানুষটি জাগতিক চিন্তাধারার মিথ্যা জালে জড়িয়ে পড়ে…। যে কোন প্রকার বল প্রয়োগ প্রেমের সাথে বেমানান।
তথ্য সুত্র
The Project Gutenberg EBook of A Letter to a Hindu, by Leo Tolstoy