মানব তুমি মহীরুহ তুমি

অনেক দিন আগে, ১৮৫৮ সাল। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে জন্ম নেয়া পৃথিবীর প্রথম বায়োফিজিস্ট, জগদীশ চন্দ্র বসু। তিনিই প্রথম প্রকৃতির এক নতুন সত্য জানিয়েছিলেন পৃথিবীকে। সেটা কী? উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। আছে সংবেদনশীলতা। তাঁর পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব পদ্ধতিতে এবং দেশীয় উপাদানে তৈরি যন্ত্রপাতি দিয়ে তিনি একটি বৈদ্যুতিক সংবেনশীল যন্ত্রের মডেল তৈরি করেন যা অনেকটা কম্পিউটারের সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিটের মত। সে যন্ত্রই সর্বপ্রথম উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও সংবেদনশীলতা মাপার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। জগদীশ চন্দ্র বসুর আগে কেউ ধারণা করতে পারেনি উদ্ভিদের যে প্রাণ আছে। তিনিই প্রথম গবেষণা করেছিলেন উদ্ভিদের শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া নিয়ে। এই অসাধারণ মেধার মানুষটির মৃত্যু ঘটে ১৯৩৭ সালে ২৩ নভেম্বর। তারপর কেটে গেছে বহু সময়। তারই দেখানো পথ ধরে সারা পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে উদ্ভিদ সম্পর্কিত নানা গবেষণায়। গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে সম্পূর্ণ নতুন এক শাখা: প্লান্ট বায়ো সায়েন্স। বাইরের দেশগুলোতে এই শাখায় রাত দিন গবেষণা করে যাচ্ছেন শত শত মাইক্রো বায়োলজিস্ট, উদ্ভিদ বিজ্ঞানী। তারই ধারাবাহিকতায় এই ২০১৫ সালে এসে আমরা জানতে পারছি নানা চমকপ্রদ সব তথ্য।

আপনি অবাক হবেন এটা ভেবে যে, আপনার পায়ের তলার ঘাসেরা কি অনুভব করছে? আপনি যখন বাগানে গোলাপ, বেলী, হাসনাহেনাদের গন্ধে মাতোয়ারা , আপনি কি জানেন, ওরাও তখন আপনার ঘ্রাণও পেতে পারে? কখনো ভেবেছেন, আপনার বাড়ির পাশে বেড়ে ওঠা মেহগনি, দেবদারুদের চোখে এই পৃথিবী কেমন দেখায়? রোদ, জল আর বাতাসের স্বাদ ওদের কেমন লাগে?

উদ্ভিদ অন্যান্যদের মতো খাদ্য অন্বেষণে বের হতে পারে না, ঝড় বৃষ্টি থেকে রেহাই পাবার জন্য লুকাতে পারে না, সে কঠিন পরিবেশে নিজেকে রক্ষার জন্য সংগ্রাম করে। তার চোখ নেই, নাক নেই, কান নেই, জিহবা নেই। তারপরও সে কিভাবে অনুভূতিপ্রবণ হয়? শীত এবং গরমের প্রতি আমরা বৃক্ষের স্পর্শকাতরতা দেখা পাই। আবহাওয়া, ও পানির কম বেশি ব্যবহারের উপর নির্ভর করে তাদের বৃদ্ধির তারতম্য । এজন্যই বায়ুপ্রবণ এলাকার গাছ বামনাকৃতির হয়ে থাকে।

জৈব রসায়নের ক্রমোন্নতি একসময়ে এনেছিল অজানাকে জানার আনন্দ, তারপর বিস্ময়, আর এখন হতভম্ব করে দেয়ার মতো অনেক বিচিত্র তথ্য। এতকাল পর্যন্ত ইন্দ্রিয় বা সচেতনতার ক্ষেত্রে মানুষ আর অন্যান্য জীববৈচিত্রের কথা ভাবা হতো। কিন্তু এ ধারনা পাল্টে গেছে, গাছের প্রাণ আছে অথবা আলোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য শক্তি তৈরি,সংগীতের ধ্বনিতে সারা দেওয়া এসব এখন পুরোনো। ইতিমধ্যে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, উদ্ভিদের সাথে মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অদ্ভুত মিলের কথা ।

ইতালির ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান্টস নিউরো-বায়োলজীর গবেষণাগারে এ নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। অন্যদিকে তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্লান্ট বায়ো-সায়েন্স বিভাগের গবেষকরাও একই বিষয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। তাঁদের গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাণী জগতের সাথে বিশেষ করে মানুষের সাথে বৃক্ষের অদ্ভুত মিলের কথা।

অনেকটা মানুষের মতোই গাছেরাও দেখতে পায়। গাছেরা আলো দেখতে পায়। খাদ্য প্রস্তুত করবার জন্য গাছের আলো উৎস সন্ধানের প্রয়োজন হয়। আমাদের চোখে যেমন ফোটো রিসেপ্টর আছে ঠিক তেমনি গাছেদের কান্ড এবং পাতা , ডগা, কোষ ঝিল্লি জুড়ে আছে লাইট রিসেপ্টর। যদিও এর গঠন মানুষ বা প্রানীর তুলনায় ভিন্ন তবুও এর মাধ্যমেই গাছ দেখতে পায়। লাল ও নীল রঙয়ের পার্থক্য করতে পারে। এমনকি বর্ণালীর লাল ও বেগুনী অংশের তরঙ্গদৈর্ঘ্য পর্যন্ত বুঝতে সক্ষম যা কিনা আমরা পারি না। এভাবেই গাছ বুঝে নেয় আলো কোনদিক থেকে আসছে তা কতখানি হালকা , তীব্র না অস্পষ্ট। দিনের কোন সময়ে আলো ফুরিয়ে আসবে তাও বুঝতে পারে গাছেরা।

অনেক দিন আগে ডারউইন বলেছিলেন, বীজ থেকে অংকুরিত সদ্য চারা গাছটির প্রথম শিকড়ে থাকে তাদের মস্তিষ্ক বা স্নায়ুতন্ত্র। যা শিরা উপশিরার মাধ্যমে প্রবাহিত হয় ডালে ডালে পাতায় পাতায়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, উদ্ভিদ মানুষের মস্তিষ্কের মতো সরাসরি আবেগীয় অনুভূতিময় বার্তা না পেলেও, তাদের স্পর্শ ক্ষমতা দ্বারা পরিবর্তিত পরিবেশে সঠিক ও নিখুঁত সাড়া দিতে পারে।

একটি টমেটো গাছ বুঝতে পারে তার কোন একটি পাতায় শুঁয়োপোকা এসে বসেছে? কারণ পাতাটি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সতর্কবানী পৌঁছে দেয় গাছটির অন্যান্য অংশে। মিনিট কয়েকের মধ্যে অন্যান্য পাতায় প্রস্তুত হয়ে যায়, প্রোটিজ ইনহিবিটর এবং পলিফিনাইল অক্সিডেজ (পি পি ও) জাতীয় রাসায়নিক। শুঁয়োপোকাটি অন্য পাতা খেলেই তার পাচন সয়াহক উৎসেচক ক্ষরণ বন্ধ হয়ে যাবে। স্থবির হয়ে পড়বে সে, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে সে ,ধীরে ধীরে । বহিঃশত্রু আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পিপিও-র পারমাণবিক বিন্যাস, ধর্ম , রাসায়নিক বিক্রিয়ার হার প্রাণিদেহে সংশ্লেষিত রাসায়নিকের খুব কাছাকাছি। আর মাংসাশী উদ্ভিদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যখন কোন মাছি বা গুবরে পোকা এমনকি ব্যাঙও তার পাতার কাছে আসে তখন অবিশ্বাস্য গতিতে আটকে ফেলে। কারন সে জানে কখন তার পাতার দরজা বন্ধ করতে হবে? এখানেই কাজ করে তাঁদের স্পর্শ-ইন্দ্রিয়।

ঠিক একই ভাবে পাতার অসংখ্য ছিদ্র দ্বারা মিথাইল জেসমনয়েট নামে একধরনের উদ্বায়ী গ্যাসীয় অনুর মাধ্যমে খাদ্যের স্বাদ বুঝতে পারে গাছেরা। বিশেষ করে তখন যখন কোন পাতায় পোকা মাকড় বা ব্যাকটেরিয়া এসে পড়ে। তা ভাল কি না মন্দ তা বুঝবার জন্য গাছ তখন সেই গ্যাসীয় অনুর ব্যবহার করে থাকে।

শুধু তাই নয়, জননকালে মানবদেহ, বলা ভাল প্রাণীদেহ, থেকে একধরণের গন্ধ নিঃসৃত হয় যার জন্য দায়ী ফেরোমন। উদ্ভিদদেহেও পরাগমিলনের জন্য এধরনের গন্ধ সাহায্য করে। শুক্রাণু যেভাবে নির্দিষ্ট পথে ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়, উদ্ভিদও যেন তেমন জননে পারদর্শী। এমনকি ফেরোমনের রাসায়নিক ধর্মের মধ্যে দেখা যায়, অদ্ভুত মিল। বৃদ্ধি, উত্তেজনায় সাড়া দেওয়া, ক্লান্তি আর অবসন্নতায় নুয়ে পড়ার নিয়ন্ত্রক রাসায়নিকগুলি গবেষণাগারে পরীক্ষালব্ধ ফল অনুযায়ী নতুনভাবে প্রাণী আর উদ্ভিদের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেছে।

আর একটা ছোট্ট উদাহরন দেয়া যাক। একটি টোমেটো গাছে যদি স্যালিসাইলিক এসিড এবং অ্যাসপিরিন প্রবেশ করিয়ে একটি ডাল কেটে রাখা যায়, দেখবেন ডালটি বেশ কয়েকদিন জীবন্ত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্যালিসাইলিক এসিড এবং অ্যাসপিরিন তৈরি করে অ্যাসিটাইল স্যালিসাইলিক এসিড যা উদ্ভিদের দেহে ‘এন্টি ইনফ্লেমেটরি’ হিসেবে কাজ করে। অপরদিকে অ্যাসপিরিন খেলে তা আমাদের প্রোস্টাগ্লাডিনকে মাথা ব্যাথার জন্য দায়ী হতে নিষেধ করে।

গবেষণায় আরও দেখা যায়, গাছ পালা একে অন্যকে প্রভাবিত করতে পারে এবং যোগাযোগ করতে পারে। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, এই যোগাযোগের জন্য তাঁরা ব্যবহার করে ন্যানো –মেকনিকাল দোলন বা ক্ষুদ্রতম আণবিক স্কেলের কম্পন। যেন অনেকটা ট্যালিপ্যাথি। তাদের এই বার্তা প্রবাহিত হয় মূলত শিকড় থেকে শিকড়ে। এভাবে তারা একে অন্যকে যেন শুনতে পায়।

আরো সূক্ষ্ম, অতি সহজ ও প্রাচীন একটি মিল, প্রানীদেহের হিমোগ্লোবিন এবং উদ্ভিদের ক্লোরোফিল হল প্রাণীত্বের চাবিকাঠি। এই দুই যৌগের অনুই রসায়নের অন্যতম গঠন বৈশিষ্ট্য প্রোফাইরিনের গঠন সম্পন্ন। রসায়নশাস্ত্রে বিভিন্ন যৌগের বিভিন্ন শ্রেনীর গঠন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। দেখা গিয়েছে প্রোফাইরিন জাতীয় গঠনবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে উক্ত দুই যৌগের গঠনবৈশিষ্ট্যের মিল রয়েছে। আর অতি পারমানবিক জগতে যে, সকল বস্তুর গঠন অভিন্ন তা বলাই বাহুল্য।

গাছেদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। গবেষকরা নিয়মিত বিরতিতে আমাদের সামনে নতুন নতুন তথ্য উপস্থাপন করছেন।

গাছ বা সবুজ প্রকৃতিকে তাই নতুন করে দেখতে হচ্ছে মানুষকে। নতুন ভাবে অনুভব করতে হচ্ছে, নতুন করে ভাবাচ্ছে মানুষকে। গাছকে ইন্দ্রিয় সচেতন প্রাণ হিসেবে অধিকার দেবার প্রশ্নটিও সামনে এসে যাচ্ছে।

এসব কিছুই আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষ প্রাণী গাছ আসলে সবাই আমরা একই প্রকৃতির সন্তান। মনে করিয়ে দেয় লক্ষ লক্ষ বছর আগের মানুষ, প্রাণী আর উদ্ভিদের এক ও অদ্বিতীয় পূর্ব পুরুষ একক সেই সরল প্রাণের কথা।

অভিব্যক্তির সুনির্দিষ্ট পথ পরিক্রমায়, অভিযোজনের ফলেই আমরা আজ মানুষ, প্রাণী আর উদ্ভিদের পৃথক জগতে সৃষ্টি হয়েছি। অথচ আমরা বিবর্তিত হয়েছি একে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে অদৃশ্য এক সামঞ্জস্য বিধানের মাধ্যমে। যা কিনা আমাদের একে অপরকে টিকে থাকতে সাহায্য করে আসছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart