রেনেসাঁয় নগ্নতা কামোদ্দীপক নাকি ধর্মীয়?

মানব জীবনে যৌনমিলন চিরকাল ধরেই আছে। কিন্তু এটি নিয়ে আলাপ করা শুরু হয়েছে খুব বেশি কাল হয়নি। যদি আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতির দিকে তাকাই, দেখতে পাব মধ্যযুগীয় সময় কালটা সবচেয়ে বেশি শালীনতার ভান ধরে ছিল। শিল্পজগতেও শারীরিক ভালবাসার চিত্র খুব কম পাওয়া যায়। খ্রীষ্টের জন্মের আগের সময়ে পাওয়া গ্রীক কিছু ইরোটিক ফুলদানী চিত্রই শুধু এখানে বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। উল্লেখ করার মতো আর তেমন কিছু পাওয়া যায় না। চিত্রকলা, ভাস্কর্যসহ শিল্পের অন্যান্য কারুকার্যময় কলাকৌশল সবই নিয়ন্ত্রিত হতো ধর্মীয় বিষয়বস্তু দ্বারা। স্পষ্টতই এখানে আমরা কোনও উরু দেখতে পাচ্ছিলাম না। ‘তোমার উরুতে ছিল কামনার বিশাল ইশারা’– কবি সমর সেন যদি এই ইশারা লক্ষ্য করে থাকেন, পশ্চিমারাও নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন। কিন্তু সমাজ ও সংস্কারের বিধিনিষেধ ওই কামোদ্দীপ ইশারাকে আড়াল করে রেখেছিলে পশ্চিমের শিল্পীরা–বহুদিনের জন্য। আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল ইউরোপের রেনেসাঁর পৃষ্ঠপোষক ও শিল্পীদের আগমন পর্যন্ত। তারাই প্রথম নারীদেহকে উন্মোচিত করলেন পৌরাণিক চরিত্রের মাধ্যমে।

রেঁনেসা যুগের চিত্রশিল্পীরা পশ্চিমা চিত্রকলার ধরনটা বদলে দিয়েছিলেন। তারা যৌনতাকে তাদের শিল্পচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসেন। বলা যায়, রেনেসাঁ শিল্পীরাই যৌনতা আর নগ্নতাকে শিল্পের রূপ দেন। নগ্নতাকে ঘিরে তাঁদের এই শিল্পচাতুর্যময় অনুশীলন শিল্প-ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এসময় ধ্রুপদী অতীতের প্রতি নতুন করে আগ্রহের জন্ম নেয়। আর খ্রিস্টীয় উপসনার চরিত্রগুলোর ভূমিকার দিকের নতুন রূপে আলোকপাত করা হয়। যা কিনা শিল্পীদের উৎসাহিত করেছিল জীবন থেকে আঁকতে। ফলে মানুষের শরীরের প্রাণবন্ত প্রতিরূপের বিকাশ ঘটে তাঁদের শিল্পসৃষ্টিতে।

নগ্ন দেহের প্রতিরূপ আঁকার ক্ষমতা শৈল্পিক প্রতিভা পরিমাপেরও মানদণ্ড হয়ে উঠেছিল তখন। কিন্তু এর প্রকাশ একেবারেই কোন বিতর্ক ছাড়াই ঘটেছে এমনটি ভাবা ঠিক হবে না, বিশেষ করে ধর্মীয় চিত্রকলার ক্ষেত্রে। যদিও অনেক শিল্পীই দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁরা বলেন ঐসব সুডৌল আর নিপুণভাবে সমানুপাতিক সুগঠিত দেহগুলি আসলে পূন্যের কথা বলে। অন্যরা কিন্তু নিজেদের ভেতরের সুপ্ত কামনা বাসনার পরোয়া করেই নগ্নতা এনেছিল তাঁদের শিল্পে, অবশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণও ছিল।

লন্ডনের রয়্যাল একাডেমি রেনেসাঁ চিত্রকর্মে নগ্নতার বিকাশের ওপর এক অনুসন্ধান চালায়। তাতে দেখা যায়, নবজাগরণ পুরো ইউরোপ জুড়ে চিত্রকলায় নগ্নতার বিকাশ ঘটিয়েছে। ধর্মীয়, চিরায়ত কিংবা লোকায়ত বিভিন্ন রূপেই এটা ঘটেছে। এর প্রভাব এতই প্রবল ছিল যার দরুন এটি শিল্পজগতে একটি আধিপত্যবাদী অবস্থানে উঠে আসে। পাশাপাশি, আমাদের মাঝে এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে যে, আমরা অবাক হয়ে ভাবি, তখনো যৌন আবেদনময়তা আর নগ্নতারও অস্তিত্ব ছিল!

ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দী জুড়ে খ্রিষ্টীয় চিত্রকলায় নগ্নতা নিয়মিত দেখা গেছে। সর্বপ্রথম যে চরিত্রটি নগ্ন রূপে হাজির হয়েছিল এবং বার বার হয়েছে সেটি ছিল যিশু খ্রীষ্টের শরীর। কিন্তু চতুর্দশ শতাব্দিতে খ্রিষ্টীয় চিত্রকলায় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। মানুষ চাইত তাঁদের ব্যক্তিগত আরাধনায় আর ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে এইসব চিত্রকলার ব্যবহার করতে। ঐশ্বরিক সহানুভূতি পাওয়ার চিন্তা থেকে মানুষজন চাইতো এর মাধ্যমে যেন তারা খৃষ্টের আর সাধুসন্তদের সত্যিকারের বেদনাটা অনুভব করতে পারে।

যার ফলে, শিল্পীরা চিত্রগুলি আরও বস্তুনিষ্ঠভাবে করার চেষ্টা করেছিলেন। খ্রিষ্টের অবয়ব, সাধু এবং অন্যান্য ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা ক্রমশ স্পৃশ্য হয়ে ওঠে। এই বিকাশটি সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় চিত্রশিল্পী ইয়ান ভ্যান ইয়ক-এর ঘেন্ট গীর্জার বেদীর পিছনে আঁকা দক্ষ চিত্রকর্ম আদম আর হাওয়ার শরীরে (১৪৩২)। এটি শুধু মানবজীবনের সাথে ঘনিষ্ঠই নয়, বরং চমকপ্রদভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণযোগ্য। এখানে দেখানো হয়েছে, আদমের রোদে পোড়া হাত আর হাওয়ার ঈষৎ স্ফীত তলপেটে ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে থাকা লম্বা কালো রেখা। যা কিনা স্পষ্টতই হাওয়ার গর্ভবতী হবার লক্ষণ প্রকাশ করেছে।

ভ্যান ইয়ক এবং অন্য উত্তরাঞ্চলীয় শিল্পীরা তাঁদের নগ্ন চিত্রায়ণগুলি দেশজ ঐতিহ্যের মিশ্রণে নিপুণভাবে সমৃদ্ধ করেছিলেন। যা কেবলমাত্র ধর্মীয় চিত্রকলা নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়বস্তুকেও একদেহভুক্ত করেছিল। একইসাথে গজদন্তের পান্ডুলিপির কারুকার্যময় চিত্রাবলীর স্নানের দৃশ্য অথবা গণিকালয়ের দৃশ্যগুলো এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাদের এই বিকাশের ধারাটি আরও উন্নত হয় যখন দ্যুতিময় তৈলচিত্রের কলাকৌশলগুলোকে তারা গ্রহণ করে । এটি ছিল সংস্কারবিমুখ প্রকৃতিবাদের এক উচ্চতর পর্যায়।

ইউরোপের উত্তরাঞ্চলীয় শিল্পীরা নগ্নতার প্রতি সাধারণভাবে শিথিল মনোভাবের কারণে উপকৃত হয়েছিলেন। উওরে পাজেন্ট(pageant-কারুকার্যময় এক উন্মুক্ত প্রদর্শনী পথপাশে পথিমধ্যে এতিহাসিক ঘটনাগুলোকে অবলম্বন করে গড়ে উঠতো। পুরান ঢাকার মহরমের মতো খানিকটা) প্রদর্শনীর মতো জিনিসগুলিতে প্রচুর নগ্নতা ছিল। এটি ইতালীর থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। এমনকি বিবাহিত অবস্থায় নারীদেহ দেখার ব্যাপারে তাদের প্রথাগত নির্দেশনা পালনের মধ্যে দিয়ে যেতে হতো। উদাহরণস্বরূপ, স্বামী তার স্ত্রীকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখতে পারবেন না। ইতালীয়রা আরও বিশ্বাস করত, নারীদেহ জন্মগতভাবেই অপূর্ণতা নিয়ে জন্মায়। অ্যারিস্টটলের মতে, নারী দেহগুলি গর্ভে সঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি এবং জরায়ু থেকে নির্গত হবার সময় তাপের অভাব ছিল। এই মতামতেই তারা বহুকাল বিশ্বাস স্থাপন করে রেখেছিল। যদিও ইতালীর শিল্পানুরাগী পৃষ্ঠপোষকরা উৎসাহের সঙ্গেই উত্তর থেকে নগ্ন নারী চিত্রগুলো সংগ্রহ করতেন। সম্ভবতঃ একারণেই যে, পনেরো শতকের ইতালীয় শিল্পীরা শুধুমাত্র পুরুষদেহকে মনোযোগ দেবার জন্য পছন্দ করে নিয়েছিল। উল্লেখ করার মতন ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল বত্তিচেল্লী।

মানবিক সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি আঁকিয়ে শিল্পীদের সৃষ্টির উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন ভাষ্কর্যগুলোতে। বিশেষ করে ফ্লোরেন্সের ব্যাপ্টিস্টার ক্যাথেড্রালের দরজার জন্য গিবার্তির ২১ বছর ধরে তৈরি করা ব্রোঞ্জের প্যানেলটি। (Ghiberti’s panel for the Baptistery doors of Florence cathedral (c 1401-3)) যেখানে আব্রাহাম পুত্র আইজ্যাককে দেখা যায় বুকের সুতীব্র পেশি ফুলিয়ে বীরত্বপূর্ণ ভঙ্গিমায়, যা ব্রোঞ্জের গায়ে নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ এটিকে রেনেসাঁর নগ্নতার সূচনা হিসেবে গণ্য করেন। ফ্লোরেন্সে ভাস্কর্যশিল্পী দোনাতেলো (Donatello) রাজা ডেভিডের একটি দুঃসাহসী ভাষ্কর্য নির্মাণ করেছিলেন (১৪৩০-৪০)। এমনকি পুরুষরাও যার শান্ত নমনীয় ভঙ্গিমার মাঝে সুদর্শন তরুণের কমোউদ্দীপক শরীর খুঁজে পেয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, পঞ্চদশ শতাব্দীতে সমকামীতা বেআইনী হওয়া সত্ত্বেও সমাজে তা খুব স্বাভাবিক প্রথার মতোই বিরাজ করত। অর্ধেকেরও বেশি ফ্লোরেন্টাইন পুরুষ দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল অন্য পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের দায়ে।

একইভাবে ‘সেইন্ট সেবাস্তিয়ান’ ছিল চিত্রকলার একটি প্রিয় বিষয়। যার রূপের আগুনে শুধু পুরুষরা না, নারীরাও পুড়েছিল। ফ্রা বার্তোলোমে’এর (Fra Bartolommeo) আঁকা সেবাস্তিয়ানের একটি চিত্র ছিল ফ্লোরেন্সের সেইন্ট মারকো চার্চে। সেটিকে পরে সরিয়ে ফেলা হয়। কারণ ভাবা হয়েছিল চিত্রটি নারীরা প্রবল আগ্রহ নিয়ে দেখে আর তাদের মনের মধ্যে নানা শয়তানী ভাবনা আসে! দুর্ভাগ্যজনক ফলাফল হলেও, ফ্রা বার্তোলোমোর আন্তরিক উদ্দেশ্য নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে পঞ্চদশ শতাব্দীর সচিত্র প্রার্থনার বই ‘বুক অব আওয়ারস’ এর ক্ষেত্রে এটি বলা যায় না। এটি লিম্বার্গ ভাতৃদ্বয় তৈরি করেছিল ডিউক অব বেরি’র জন্য। আপাতদৃষ্টে ব্যক্তিগত আরাধনার জন্য হলেও এটাতে কিছু চরিত্রের চিত্রায়ন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়। যেমন সেইন্ট ক্যাথেরিন অব আলেকজান্দ্রিয়া’র মতো চরিত্রকে হাজির করা হয়েছে পুরোপুরি যৌনাবেদনয়ী রূপে। এক চিমটি কোমর,অতিউন্নত স্তন আর ক্ষীণকায় পান্ডুর দেহ সেরকমই প্রকাশ করে ।

এই জাতীয় কাজগুলি তখনকার ফ্রান্সের ধর্মীয় শিল্পে আধ্যাত্মিকতার সাথে কামুকতার সম্মিলনের এক মঞ্চ স্থাপন করে। সপ্তম চার্লসের রাজ দরবারে চিত্রশিল্পী জঁ ফোকের উপস্থিতি এই প্রবণতাটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। সপ্তম চার্লসের প্রিয়তমা স্ত্রী এগ্নেস সোরেলকে মডেল করে জঁ ফোকে চিত্রকর্মে কুমারী মাতা মেরীকে পেশ করেছিলেন। সেখানে মেরীর নিখুঁতভাবে গোলাকার অনাবৃত বাম স্তনটি লক্ষ্য করার মতো যা কিনা শিশু খ্রিষ্টের প্রতি উদাসীনতা প্রকাশ করে। এটি ছিল উদ্ভটতার অন্যতম উদাহরণ।

ধর্মীয় শিল্পে যৌনতার এই বিকাশটি কিন্তু চার্চের নজর এড়ায়নি। বিশেষ করে ১৫১৭ সালে ইউরোপে খ্রীষ্ট ধর্ম সংস্কারের পর থেকে উপসনা স্থলে ধর্মীয় চিত্রকল্পের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এরপরেই প্রোটেস্ট্যান্ট দেশগুলির শিল্পীরা নগ্নতাকে ধর্মনিরপেক্ষ আর পৌরাণিক বিষয় নির্ভর রূপ দেবার ব্যাপারে সচেষ্ট হলেন। তাদের এই চেষ্টা সফল তো হলোই, বরং রীতিমতো সাড়া ফেলে দিল। জার্মান রাজদরবারের চিত্রশিল্পী লুকাস ক্রানাক দি এল্ডার (Lucas Cranach the Elder) দেবী ভেনাসকে নিয়ে বিভিন্ন বিষয়নির্ভর বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন। ওই চিত্রকর্মগুলো দেখলে এটা মনে হবে যে ধর্মীয় পরিমণ্ডলের বাইরে গিয়েও আঁকা যায়, চিন্তা করা যায়। এটি অন্যান্য চিত্রশিল্পীদের জন্য স্বাধীনতার দুয়ার খুলে দেয়।

নগ্ন নারী প্রতিকৃতিকে ডাইনী হিসেবে এঁকে উপস্থিত করা ঐসময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। যা পুরুষের ওপর নারীর ছদ্মবেশী যৌনশক্তির প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করার দিকে আলোকপাত করে, সুতরাং এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ওটাই ডাইনী হত্যার উন্মাদনাকে আরও উসকে দিয়েছিল যার পরিণাম হাজারো নারীর মৃত্যুদন্ড। এটি কোনভাবেই শুধুমাত্র নগ্নতাকে উদ্ভট করেনি বরং কিছু কুৎসিত কার্যক্রমের দোসরও হয়ে উঠেছিল অতিমাত্রায় শক্তিশালী রূপে।

ইতালীও আরও বেশি চিরায়ত থিমগুলোকে কিছুটা রূপান্তরিত করে নিচ্ছিল ক্রমশ বিস্তৃতি লাভ করতে থাকা মানবতাবাদী সাহিত্য ও কবিতার স্বার্থে। ভেনিসের অধিবাসী শিল্পী জির্জয়নি এবং তিশিয়ান গর্ব করার মতো বেশ কিছু ইন্দ্রিয়উদ্দীপক নগ্ন শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেছিলেন। তবে এইসব চিত্রকর্মে স্পষ্ট কামোদ্দীপনা থাকলেও এগুলি প্রায়শই ‘ক্লাসিক্যাল ন্যুড’ হিসেবে বর্ণিত হতো যাতে এর সৃষ্টিকর্তারা দাবী করতে পারে তাদের আগ্রহের জায়গাটা আসলে বুদ্ধিবৃত্তিক ছিল, কামাকাঙ্ক্ষী নয়।

যাহোক, একজন শিল্পীর দক্ষতার সাক্ষ্য-প্রমাণগুলির একটি হচ্ছে এর দর্শকদের মাঝে শারীরিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা। যাতে এটির দ্বারা হয়তো আপনি কামনা অনুভব করবেন। তিশিয়ানের ‘ভেনাস অব উরবিনো’ সাক্ষ্য দেয় শিল্পীর দক্ষতার।

খাঁটি ক্লাসিক্যাল ন্যুড একটি ব্যাপার হলেও ক্যাথলিক ধর্মীয় শিল্পে প্রাচীনতার প্রভাব ক্রমশ বিতর্কিত হয়ে উঠছিল। মাইকেলেঞ্জেলো একইসঙ্গে তাঁর বলয়ের খ্রিষ্টীয় মানবতাবাদী ও যাজকদের সাথে বিশ্বাস করতেন যে, সৌন্দর্যময় শারীরিক গড়ন মানুষের পূন্য ও পূর্ণতার নিদর্শন।

কিন্তু খ্রিষ্টীয় শিল্পে পুনরায় শক্তি সঞ্চারিত করার ব্যাপারে তাঁর পদক্ষেপটি একটু বেশিই হয়ে গেছিল চার্চের পক্ষে মেনে নেয়া। বিশেষ করে প্রাচীন প্যাগান মডেলদের অন্তর্ভুক্ত করে ভ্যাটিক্যান সিটিতে পোপের বাসস্থান সিস্টিন চ্যাপেলে দেয়াল জুড়ে তাঁর সৃষ্টিকর্ম( ফ্রেস্কো) ‘দ্য লাস্ট জাজমেন্ট’ (১৫৩৬-৪১)। তাঁর মৃত্যুর পর সেই বাইবেলীয় চরিত্রগুলির জননেন্দ্রিয় কাপড়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল।

তবে চার্চের শিষ্টাচারপণা থাকা সত্ত্বেও, মাইকেলেঞ্জেলোর এই প্রতিভাদীপ্ত সৃষ্টি নগ্নতার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল। এটিকে শৈল্পিক প্রকাশের সর্বোচ্চ রূপ হিসেবে বিবেচনা করা শুরু হয়। সিস্টিন চ্যাপেলের পর থেকে সবাই চাইতো শিল্পীরা যেন ন্যুড আঁকেন।

আমরা যদি রেনেসাঁ যুগের ভুবনখ্যাত মাস্টার সব চিত্রকরদের ব্যক্তি জীবনে ডুব দেই আর ভিন্ন চোখে দেখার চেষ্টা করি, তাহলে দেখা যাবে তাঁদের সৃষ্টিকর্মে ব্যক্তিজীবনের প্রভাব ছিল প্রবল। এতটাই আদিম আর বন্য ছিল তাঁদের ব্যক্তিজীবন। তিশিয়ান তাঁর মডেলদের কাছে ছিলেন ক্ষিপ্র এক ঘোড়ার মতই। রাফায়েল অতিমাত্রায় যৌনাসক্তিতে মারা যান। লিওনার্দোর সঙ্গে ফ্লোরেন্টাইন সেক্স-পুলিশের ঝামেলা বেঁধেছিল। রেমব্রান্টের শোবার ঘরে হেনরিক্রিক স্টোফেলস’এর প্রতিকৃতি তাঁর প্রেমিক হৃদয়ের স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর দুর্দান্ত ঐ শিল্পীরা কেবল দুরদর্শী ছিলেন না, প্রেমিকও ছিলেন বটে। রেনেসাঁ শিল্পীদের ব্যক্তিজীবনে যৌনতা নিয়ে লিখতে গেলে শেষ করা যাবে না।

সময়ের সাথে সাথে, নগ্নতা হয়তো নারীকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু গত দুই শতাব্দী ধরে নারী ও পুরুষ উভয়ের সৌন্দর্যই উদযাপিত হয়েছে ঐসব মহান শিল্পীদের মাধ্যমে যারা চিরকাল বেঁচে আছেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart