মেক্সিকোর কিংবদন্তী চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কাহলোর চিত্রকলা নিয়ে লিখেছেন প্রাবন্ধিক বিপাশা চক্রবর্তী
মার্ক্সবাদী, জাতীয়তাবাদী, নারীবাদী–এগুলি এমন শব্দ যা কেবল রাজনৈতিক প্রত্যয়ই নয়, ফ্রিদা কাহলোর শিল্পকর্মকেও বর্ণনা করে। যদিও ১৯০৭ সালে মেক্সিকোর শহরতলীতে মাগদালেনা কারমেন ফ্রিদা কাহলো ই কালদেরন নামে জন্মেছিলেন, তথাপি তিনি সবাইকে বলতেন যে, ১৯১০ সালে তার জন্ম। একই সাথে তিনি তার নামটাও ছোট করে ফেলেছিলেন, শুধুই ফ্রিদা কাহলোতে। এটা ছিল সেই সাল, যখন দেশজুড়ে চলতে থাকা রাজনৈতিক অস্থিরতা, শেষ পর্যন্ত মেক্সিকান বিপ্লবে পরিণত হয়।
সাড়ে নয় বছরের সংঘাত ও বিপ্লবের ফলে মেক্সিকোর রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। অভিজাত শাসকবর্গের উৎখাত সেখানে একটি নতুন সংবিধানের পথ প্রশস্ত করে, যার ফলে আমূল ভূমি সংস্কার, নারীদের জন্য সম-মজুরি আইন এবং দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক স্রোতের ধারা বইতে শুরু করে। এই ধারারই বিপ্লবী এক কন্যা ছিলেন ফ্রিদা কাহলো। গভীর শিল্পসত্তার সাথে রাজনৈতিক উৎকর্ষতার এমন যুগল বন্দি প্রকাশ ইতিহাসে সম্ভবত খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
বিপ্লবী শিল্পী
বিপ্লবের উত্তাপে বেড়ে ওঠা কাহলো জাতীয় গর্বের পুনরুত্থান এবং পরবর্তীতে প্রগতিশীল ধারণার দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কাহলোর ‘মোজেস’ চিত্রকর্মটি হতে পারে এর চমৎকার একটি উদাহরণ। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ‘মোজেস এন্ড মনৌথীজাম (একেশ্রবাদ)’ বইটির প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিনি এই চিত্রটি এঁকেছিলেন, যেখানে তাঁর সামাজিক ও রাজনৈতিক মনোভাবের বেশ কিছু উদাহরণ ফুটে ওঠে।
এই ম্যুরালটির মূল ফোকাস হল, জীবনের সর্বজনীন দাতা হিসেবে সূর্য এবং বৃষ্টির সাথে নারী প্রজনন অঙ্গগুলির প্রতীকীকরণ। এটির উপরের বাম কোণটি মেক্সিকোর আদিবাসী অ্যাজটেক সংস্কৃতির প্রতি নিবেদিত, যা প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার পাশাপাশি গ্রীক, হিব্রু ও খ্রিষ্টান ধর্মের ধ্রুপদী পুরাকালের সাথে সমান স্তরে উপস্থাপন করা হয়েছে। দেবতাদের স্তরের ঠিক নীচেই কাহলো মহান কয়েকজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের অবয়ব এঁকেছেন, যাদের তিনি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মনে করতেন। যেমনঃ স্ট্যালিন, লেনিন, মার্কস, গান্ধী এবং যীশু ছিলেন অন্যতম। তবে তাদের মধ্যে হিটলারের বিদ্রুপাত্মক অন্তর্ভুক্তি ছিল কৌতুহলোদ্দীপক সংযোজন, যাকে শিল্পী এই দলের মধ্যে “হারানো শিশু” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এরপর, নীচের স্তরটিতে তিনি মানব ও সামাজিক বিবর্তনের প্রতীক স্বরূপ উত্তাল জনগণের একটি বিবরণ চিত্রায়ন করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফ্রিদা
মেক্সিকান বিপ্লব ছাড়াও, সম্ভবত কাহলোর জীবনে অনুপ্রেরণার সবচেয়ে বড় উৎস ছিল তার আজীবন সঙ্গী দিয়েগো রিভেরা। ১৯২৯ সালে এই দুই শিল্পী বিয়ে করেন এবং পরের বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সেখানে তার স্বামী বেশ কিছু চুক্তিভিত্তিক কাজের ছবি আঁকায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কাহলো তখন একাকিত্বে ভুগতে শুরু করেন। তিন বছর সেখানে থাকাকালে, ক্রমশ তিনি স্বদেশের জন্য আকুলতা অনুভব করতে থাকেন এবং দিনে দিনে অসুখী একজন মানুষে পরিণত হন। এ সময়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিরও যথেষ্ট সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন, যেটিকে তিনি শোষণমূলক শিল্পায়ন এবং পুঁজিবাদের মূর্ত প্রতীক হিসেবে দেখেছিলেন।
তার আঁকা “বর্ডার লাইন বিটুইন মেক্সিকো এন্ড দ্য ইউনাইটেড স্টেটস” আত্ম-প্রতিকৃতিটি দুটি দেশের মধ্যে একটি ষ্পষ্টতর দ্বিধা-বিভক্তি বা বৈপরীত্য তুলে ধরেছে। সেখানে মেক্সিকান দিকটি প্রকৃতি, ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের রঙিন চিত্র দ্বারা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অন্যদিকে, নিস্তেজ ধূসর কারখানা আর দূষণের একটি ল্যান্ডস্কেপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চিহ্নিত করেছে। যদিও কাহলোর বাম হাতের পতাকাটি ষ্পষ্ট করে দেয় যে শিল্পীর আনুগত্য কোথায় রয়েছে। এখানে বিদ্যুতের জেনারেটরটি লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যেটি তার পাদদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। সেখানে লেখা আছে “কারমেন রিভেরা ১৯৩২ সালে তার প্রতিকৃতিটি এঁকেছিলেন।” একইভাবে এটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, জেনারেটরটি সীমান্তের অন্যদিক, অর্থাৎ মেক্সিকো প্রান্তের গাছের শিকড়ের সাথে পরজীবীর মতো সংযুক্ত রয়েছে। এর মাধ্যমে কাহলো তার দক্ষিণের প্রতিবেশীদের সাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের শোষণমূলক প্রকৃতির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
স্বামী রিভেরার চুক্তিভিত্তিক কাজগুলির মধ্যে একটি ছিল “ম্যান অ্যাট দ্য ক্রসরোড”। রকফেলার সেন্টারের শিল্প-অগ্রগতির প্রশংসা করে এই ম্যুরালটি তার আঁকার কথা। এই বিষয়বস্তু সম্পর্কে কাহলো তার মতামত ভিন্নভাবে প্রকাশ করেছিলেন। যে কারণে তার “মাই ড্রেস হ্যাং দেয়ার” চিত্রকর্মটি একটি কংক্রিটের জঙ্গলের পটভূমিতে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন, সেলিব্রিটি সংস্কৃতি এবং সামাজিক অস্থিরতার এক ধরনের অরাজকতার কোলাজ সৃষ্টি করে। সেখানে আধুনিক গগনচুম্বী অট্টালিকাগুলি কিটস্কি গ্রীক কাঠামো এবং একটি মধ্যযুগীয় গির্জার সাথে একাকার হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও দেখা যায় এই বিশৃঙ্খল দৃশ্যের একমাত্র প্রকৃত স্বতন্ত্র বস্তু হল শিল্পীর ঐতিহাসিক তেহুয়ানা পোশাক, তার কাজের মূল কেন্দ্রবিন্দু।
ফ্রিদা এবং ত্রোতস্কির মৃত্যু
১৯২৯ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সফরের পূর্বে, বেশ কয়েক বছর ধরে মেক্সিকান কমিউনিস্ট পার্টির একজন উচ্চপদস্থ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও, কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যান্য সদস্যদের সাথে এক আদর্শিক মত বিরোধের কারণে শেষ পর্যন্ত রিভেরাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়। স্বামীর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে কাহলোও দল থেকে অব্যহতি নেন। তিনি স্টালিনপন্থী দলে যোগদান করেন। এরপর থেকে কয়েক বছর যাবৎ এই যুগলের রাজনৈতিক সহানুভূতি রুশ নির্বাসিত নেতা লিওন ত্রোতস্কির সমর্থনে চলে যায়। (যোসেফ স্তালিনের সাথে মতবিরোধের কারণে ত্রোতস্কি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পালিয়ে তখন লাতিন আমেরিকায় অভিবাসন গ্রহণ করেছিলেন।)
১৯৩৭ সালে তারা ত্রোতস্কি ও তার স্ত্রী নাটালিয়া সেডোভাকে মেক্সিকোতে আশ্রয় দেবার জন্য রাষ্ট্রপতি লাজারো কার্ডেনাসের বামপন্থী সরকারকে রাজি করাতে সক্ষম হন। এরপর তারা এই দম্পতিকে ফ্রিদা কাহলোর পারিবারিক বাড়ি লা কাসা আজুলে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানান। এদিকে, রিভেরার সন্দেহ হয় যে, ত্রোতস্কি ও কাহলোর মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ফ্রিদার সাথে তার দাম্পত্য কলহের অনেকগুলি কারণের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। এরই জেরে শেষ পর্যন্ত, ত্রোতস্কি অন্য জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
কাসা আজুল থেকে চলে আসার সময় স্ত্রীর অনুরোধে ত্রোতস্কি কাহলোর আত্ম-প্রতিকৃতির পেইন্টিংটি রেখে যান। ত্রোতস্কির ৫৮তম জন্মদিনের সময় কাহলো এটি একেঁছিলেন। পেইন্টিংতে কাহলো নিজেকে একজন সম্ভ্রান্ত ও আকর্ষণীয় নারী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। সেখানে দেখা যায়, তার হাতে একটি কাগজ, যেখানে লেখা আছে “লিওন ত্রোতস্কিকে, আমার সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে আমি এই পেইন্টিংটি ৭ নভেম্বর, ১৯৩৭ সালে তাকে উৎসর্গ করছি। ফ্রিদা কাহলো, সান অ্যাঞ্জেল, মেক্সিকো।” রাশিয়ান দম্পতি কাসা আজুলের কাছেই নিজেদের জন্য একটি বাসস্থান খুঁজে পেয়েছিলেন। যাহোক, ১৯৪০ সালের মে মাসে রাশিয়ার এজেন্ট আইওসিফ গ্রিগুলেভিচ এবং মুরালিস্ট ডেভিড আলফারো সিকুইরোস ত্রোতস্কিকে হত্যার চেষ্টা করেন। যারা রিভেরার চলে যাবার পর মেক্সিকান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি অনুগত হয়েছিলেন। একই বছরের আগস্ট মাসে তাকে আরেকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। স্প্যানিশ এজেন্ট রামন মারকেডারের দ্বিতীয় বারের এই প্রচেষ্টা সফল হয়। ১৯৪০ সালের ২১ আগস্ট, মেক্সিকো সিটিতে লিওন ত্রোতস্কিকে হত্যা করা হয়।
শেষ পর্যন্ত একজন বিপ্লবী
ত্রোতস্কির মৃত্যু এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে ক্রমবর্ধমান বিভেদ সত্ত্বেও, কাহলো তার বাকি জীবনে নিজের বিপ্লবী আদর্শের প্রতি নিবেদিত ছিলেন। একইভাবে, ত্রোতস্কির মৃত্যু প্রমাণ করে যে, স্ট্যালিনই ছিলেন কমিউনিস্ট বিশ্বের মোড়ল, দল থেকে বিদায় নেয়া সত্ত্বেও এই রূঢ় বাস্তবতা কাহলো ও রিভেরাকে মেনে নিতে হয়েছিল।
১৯৫৩ সালে মার্চে, স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর, কাহলো তার সম্মানে একটি চিত্রকর্মের কাজ শুরু করেন। “মহান নেতার” সাথে তার সেই আত্ম-প্রতিকৃতি পরবর্তীতে স্ট্যালিনকে প্রায় ধর্মীয় মর্যাদার আসনে উন্নীত করেছিল, যেমন মর্যাদা সোভিয়েত ইউনিয়নে তার ত্রিশ বছরের শাসনকালে তিনি ভোগ করেছিলেন। নেতার প্রতি তার শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও, কাহলো তার পূর্ববর্তী কাজের সূক্ষ্ণতা ও স্বচ্ছতা এ ক্ষেত্রে ধরে রাখতে পারেন নি। কেননা, যৌবনে বাস দুর্ঘটনার তীব্র ব্যাথা আর অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে তাকে প্রতিনিয়ত অধিক মাত্রার ওষুধ গ্রহণ করতে হতো, যা তার শৈল্পিক কৌশলকে প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত করছিল।
জীবনের অন্তিম সময়ে, কাহলো তার শেষ যে রাজনৈতিক চিত্রকর্মটি এঁকেছিলেন, সেটি ছিল “মার্কসবাদ অসুস্থদের সুস্থ্য করবে (মার্কসিজম গিভ হেলথ টু দ্য সিক।)” । ক্রমাগত ব্যাথা, ভগ্ন স্বাস্থ্য আর ওষুধের প্রতিক্রিয়ায়, কাহলো মার্কসকে একজন ঐশ্বরিক সত্তা হিসেবে চিত্রিত করেন, যিনি স্বয়ং তাকে স্বর্গের পানে নিয়ে যাচ্ছেন এবং একই সাথে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অন্যায় শক্তিকে শাস্তি দিচ্ছেন। মৃত্যু আসন্ন জেনে, কাহলো চিত্রে তার চামড়া দিয়ে বানানো কাঁচুলিটি প্রকাশ করার জন্য উপরের আচ্ছদনটি খুলে ফেলেন, যেটি বাস দুর্ঘটনার পর থেকেই তার ভাঙ্গা মেরুদন্ডের সহায়ক হিসেবে এতদিন কাজ করছিল। একই সময়ে তিনি তার হাতে ধরা ক্রাচটিও ফেলে দেন। তবে সেটি করেছিলেন-হাত দিয়ে বাইবেল আঁকড়ে ধরবেন বলে নয় বরং কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টোর ছোট্ট সেই লাল বইটি জড়িয়ে ধরে রাখবেন বলে।
১৯৫৪ সালের ১৩ জুলাই, মেক্সিকো সিটিতে ফ্রিদা কাহলো মারা যান। পরের দিন, পালাসিও দে বেইয়্যাস আর্টেস থেকে প্যান্টেন সিভিল দে ডোলোসের পর্যন্ত বিশাল এক জনসমুদ্র তার শবযাত্রায় সঙ্গী হয়। হাতুড়ি এবং কাস্তে সমন্বিত মস্ত এক পতাকায় কাহলোর মৃতদেহটি ঢেকে রাখা হয়েছিল। যদিও তার শেষ ইচ্ছা ছিল তাকে যেন শুধুই কঠোর এবং অটল এক বিপ্লবী হিসেবে স্মরণ করা হয়, যেমনটি দিয়েগো রিভেরা তাকে বিয়ের বছর খানেক আগে আর্সেনালের কেন্দ্রে দেখেছিলেন, যে কাহলো মেক্সিকোতে বিপ্লবের প্রস্তুতির জন্য তার দেশবাসীকে অস্ত্র বিতরণ করেছিলেন।
বিদেশি পত্রিকা অবলম্বনে রচিত