বিশ শতকের প্রভাবশালী শিল্পীদের অন্যতম পাবলো পিকাসো। তিনি কিউবিস্ট আন্দোলনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, নির্মিত (Constructed)ভাস্কর্য ও কোলাজের সহ-উদ্ভাবক। স্পেনিশ এ চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, প্রিন্টমেকার, মৃৎশিল্পী, মঞ্চ নকশাকারী, কবি ও নাট্যকার ১৯৭৩ সালের ৮ এপ্রিল ফ্রান্সে মারা যান। চিত্রশৈলীর ক্ষেত্রে দৃষ্টিগ্রাহ্য ভিন্নতা এবং বৈচিত্রের কারণে তিনি অধিক পরিচিত। পিকাসোর বিখ্যাত চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে প্রোটো-কিউবিস্ট ‘লেস ডেমোইজেল দ’আভিগনন’ (১৯০৭) ও স্পেনের গৃহযুদ্ধের বিরুদ্ধে আঁকা ‘গোয়ের্নিকা’ (১৯৩৭)।
পিকাসো ১৮৮১ সালের ২৫ অক্টোবর স্পেনের মালাগায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম পাবলো দিয়েগো হোসে ফ্রান্সিসকো দে পাউলা হুয়ান নেপোমুসেনো মারিয়া দে লস রেমেদিওস সিপ্রিয়ানো দে লা সান্তিসিমা ত্রিনিদাদ রুইস ই পিকাসো। তার বাবার নাম ডন হোসে রুইস ই ব্লাসকো ও মায়ের নাম মারিয়া পিকাসো লোপেস।
পিকাসোর বাবা ছিলেন বার্সেলোনার চারুকলা বিদ্যালয়ের অধ্যাপক। পিকাসোর শিল্পী হওয়ার পেছনে তার অবদান বিরাট। অল্প বয়স থেকেই আঁকাআঁকিতে পিকাসোর ঝোঁক ছিল। ১৮৯০ সালের আগে ফিগার ড্রইং ও তৈলচিত্রের আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি বাবার কাছেই। বাবা একদিন দেখলেন, তার অসমাপ্ত কবুতরের চিত্রটি পিকাসো এত নিখুঁতভাবে আঁকছে যে, মনে হল না এটি ১৩ বছরের কোনো ছেলে আঁকতে পারে। মনে হল পিকাসো তাকে অতিক্রম করে গেছে। এর পর পিকাসোর বাবা পেইন্টিংয়ে ইস্তফা দেন।
পিকাসোর সে সময়কার অগ্রগতি ফুটে ওঠে বার্সেলোনা জাদুঘরে সংগৃহীত চিত্রকর্মগুলোতে। জাদুঘরটি যে কোনো প্রধান শিল্পীর প্রারম্ভিক কাজের সংগ্রহের জন্য বিখ্যাত। পিকাসো ১৪ বছর বয়সে ১৮৯৫ সালে স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরীক্ষায় পাস করেন। এর দুই বছর পর মাদ্রিদের রয়্যাল একাডেমিতে পড়াশোনা করতে যান।
১৯ বছর বয়সে শিল্প সমালোচকদের নজর কাড়েন পিকাসো। ১৯০৪ সালে মাদ্রিদের পড়াশোনা শেষে প্যারিসে চলে আসেন, আমৃত্যু তার শিল্প সাধনার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে প্যারিস। এখানে বন্ধু কবি ম্যাক্স জ্যাকবের সহায়তায় ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা অর্জন করেন।
কিউবিস্ট ধারার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিখ্যাত পিকাসোর শিল্পকর্ম বৈচিত্র্যের জন্যও সমাদৃত। শৈশব ও কৈশোরে রিয়ালিস্টিক ধারায়ও বিস্ময়কর শৈল্পিক মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন পিকাসো। তবে বিশ শতকের প্রথম দশকে তিনি বিভিন্ন শিল্পতত্ত্ব, কৌশল ও ধারণার মুখোমুখি হন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানা ধরনের নিরীক্ষা করেছেন। ১৯১০ সালের মধ্যেই কিউবিস্ট অঙ্কনশৈলী তার চেষ্টায় পূর্ণতা লাভ করে। তার আঁকাআঁকিকে সময়কাল হিসেবে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়— ব্লু পিরিয়ড (১৯০১-১৯০৪), রোজ পিরিয়ড (১৯০৪-১৯০৬), আফ্রিকান-ইনফ্লুয়েনড পিরিয়ড (১৯০৭-১৯০৯), এনালাইটিক কিউবিজম (১৯০৯-১৯১২) ও সিনথেটিক কিউবিজম (১৯১২-১৯১৯)। একই সময় আরও কয়েকজন উল্লেখযোগ্য চিত্রশিল্পীর আগমন ঘটে। বলা হয়ে থাকে পিকাসো, আঁরি মাতিস ও মার্সেল ডুশাম্প বিশ শতকের শুরুতে প্লাস্টিক আর্টে বৈপ্লবিক উন্নতি সাধনের মাধ্যমে চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, প্রিন্টমেকিং ও মৃৎশিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটান।
পাবলো পিকাসোর উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম হল— ল্যা মূল্যাঁ দা ল গালেৎ, দ্য ব্লু রুম, ওল্ড গিটারিস্ট, সালত্যাঁবাঁক, সেলফ-পোট্রেট, টু নুডস, আভাগঁর রমণীবৃন্দ, থ্রি মিউজিশিয়ানস, স্কাল্পটর, মডেল এ্যান্ড ফিশবৌল, থ্রি ডান্সার্স, গিটার, গ্লাস অব আবস্যাঁৎ, সিটেড বাথার, পালোমা ও গোয়ের্নিকা। পিকাসো একের পর এক ছবি আঁকছেন, ভাস্কর্য গড়ছেন, প্রিন্ট ও খোদাইয়েরও কাজ করছেন! যখন কাজ করতেন না তখন মেতে থাকতেন বুলফাইটিং বা ষাঁড়ের লড়াই নিয়ে। এ ছাড়া ১৯৩৫-১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তিন শতাধিক কবিতা লিখেছেন।
বলা হয়ে থাকে, প্রত্যেক মহান পুরুষের অন্তরালে নাকি ছয়জন মহান নারী থাকেন- অন্তত পাবলো পিকাসোর ক্ষেত্রে তেমনই ছিল। ২০২০ সালের গোড়ার দিকে লন্ডনের রয়্যাল একাডেমিতে ‘পিকাসো এন্ড পেপার’ শিরোনামের একটি প্রদর্শনীতে আমরা দেখতে পেয়েছি, কীভাবে নারী রূপের প্রতি তাঁর মুগ্ধতা প্রবল হয়ে ক্যানভাসের গন্ডি ছাড়িয়ে ভিন্ন এক পরিসরে বিস্তৃত হয়েছে।
…………….
ফ্রাঁসোয়া জিলো
…………….
১৯৪৩ সালে, দাম্পত্য জীবনের দশ বছরের শেষে, পাবলো পিকাসো তাঁর দয়িতা ফ্রাঁসোয়া জিলোকে বলেছিলেন, “আমি মনে করি, নারীরা দু’ধরণের/নারীদের শুধুমাত্র দুটি রূপেই দেখতে পাওয়া যায়- দেবী আর পাপোশ (ব্যবহারিক বা পরাধীন)।” এটি ছিল এক পূর্বাভাস এবং জিলোর জন্য তা নতুন কিছু ছিল না – তাঁর এক বন্ধু ইতিমধ্যেই তাঁকে বলেছিল যে, সে কিন্তু সোজা সম্পর্কের শেষ পরিণতির দিকে পৌঁছাচ্ছে। ১৯৬৪ সালে “লাইফ উইথ পিকাসো” স্মৃতিকথাতে এই চিত্রশিল্পী লিখেছিলেন, “আমি আমার বন্ধুকে বলেছিলাম, সম্ভবত তাঁর ধারণাই সঠিক, কিন্তু আমার মনে হয়েছে যে, এমন পরিণতি আমি নিজেই এড়িয়ে যেতে চাই না।” এক যুগ যথেষ্ট সময়। ১৯৫৩ সালে জিলো তাঁকে ছেড়ে চলে যান- পিকাসোর নারীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী, যিনি এই কাজটি করেছিলেন।
পিকাসোর আঁকা ফ্রাঁসোয়া জিলোর প্রতিকৃতি
একজন ক্যাসানোভা প্রেমিক পুরুষ, অবিরাম পুরুষছিনাল পিকাসোর সৃজনশীলতা তাঁর ধারাবাহিক যৌনাচারের সাথে সন্নিবদ্ধ মনে হয়। যদিও তাঁর প্রণয়ঘটিত ব্যাপারগুলি ছিল অগণিত, তা সত্ত্বেও পিকাসোর বর্ণিল প্রেমময় জীবনে বিশেষভাবে ছয়জন নারীকে তাঁর শৈল্পিক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক বলে মনে করা হয়। তাঁদের প্রভাবের পরিণতি ব্যক্তিজীবনের বিপর্যয় দিয়ে চুকাতে হয়েছিল; এই ছয় নারী মধ্যে দুজন আত্মহত্যা করেছিলেন এবং দুজন গুরুতর মানসিক অসুস্থতার শিকার হয়েছিলেন।
পিকাসোর কোলে ছোট্ট মেরিনা
২০০১ সালে পিকাসোর নাতনী মেরিনা পিকাসো ‘পিকাসোঃ আমার দাদু’ স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “তিনি নারীদেরকে তাঁর পাশবিক যৌনতার কাছে অবনত করেছেন, তাঁদেরকে বশে এনেছেন, মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন, গ্রাস করেছেন, এরপর তাঁদেরকে ক্যানভাসের পর্দায় নিষ্পেষিত করেছেন।” তিনি সেখানে আরও উল্লেখ করেছেন, “তিনি নারীদের থেকে নির্যাস বের করতে অনেক রাত একসাথে কাটিয়েছেন। আর তাঁরা নিরস হয়ে গেলে, তাঁদেরকে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন।”
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে সম্মানিত, পিকাসোর অনিয়ন্ত্রিত সম্পর্কগুলি তাঁর কাজের মধ্যে বোনা হয়েছে। বিষয়বস্তুগুলি একবার কোমলতায় ফুটিয়ে তোলার পর তা উচ্ছিষ্ট আকারে ফেলে দেয়া হয়, তারপরে ঘষামাজা করে কিউবিজমের রূপ দেয়া হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তা আবার অন্য কোন নারীদের সাথে লীন হয়ে যায়, যেন সেগুলি বাস্তব জীবনের কোন যুগপৎ সংঘটন।
পিকাসোর প্রয়াত শিল্পী বন্ধু স্যার জন রিচার্ডসন “এ্য লাইফ অব পিকাসো” গ্রন্থে লিখেছেন, “পিকাসো অপরাধবোধের চেয়ে খানিকটা গর্বের সাথেই বলতেন, এটি অবশ্যই বেদনাদায়ক হতে হবে। তাঁর শিল্পে, একজন নারী নিজেকে একটি দানবে রূপান্তরিত হতে দেখে অথবা বিবর্ণ হতে দেখে সে বেদনা অনুভব করবে। সে দেখবে, তাঁর সমস্ত মহিমা একটি নতুন প্রক্রিয়ায় মূর্ত হচ্ছে। এই জীবনীর উপর ভিত্তি করে লেখা নতুন বই “পিকাসো’স উইমেনঃ ফার্নান্দে টু জ্যকুলিন” এ, শিল্পীর যে-৩৬টি শিল্পকর্মের বর্ণনা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে, তাতে ছয়জন অনুপ্রেরণাদায়ী নারী চিত্রিত হয়েছে, যারা শিল্পীর জীবন ও কাজ সংশ্লিষ্ট হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
…………….
ফার্নান্দে অলিভিয়ার
…………….
প্রথম নারীটি ছিলেন ফার্নান্দে অলিভিয়ার। ১৯০৪ সালে যখন তাদের দেখা হয়, তখন ফার্নান্দে ছিলেন একজন মডেল আর পিকাসো ছিলেন একজন উদীয়মান শিল্পী, যিনি তখনও খ্যাতির দেখা পাননি। ঈর্ষা তাঁদের সম্পর্কে ফাটল ধরায়, পিকাসো তাঁকে অন্য শিল্পীদের জন্য মডেল হতে নিষেধ করেন। তিনি পিকাসোর জন্য ৬০টিরও বেশী প্রতিকৃতির জন্য পোজ দিয়েছিলেন এবং তাঁর প্রথমদিকের বেশ কিছু কিউবিস্ট ঘরানার চিত্রের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন।
পিকাসোর আঁকা ফার্নান্দে অলিভিয়ার প্রতিকৃতি
পারস্পরিক বিশ্বাসভঙ্গের কারণে ১৯১২ সালে তাঁদের সম্পর্কের ইতি ঘটে, যদিও তাঁদের মাঝে ঝগড়া-কলহ লেগেই ছিল। পিকাসো যখন সাফল্যের শীর্ষে অবস্থান করছিলেন, তখন অলিভিয়ার বেলজিয়ামের একটি সংবাদপত্র লে সোয়ারের কাছে পিকাসোকে নিয়ে একটি ধারাবাহিক গল্প বিক্রি করেছিলেন। পরে পিকাসোর আইনজীবীরা ছয়টি ইস্যুকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। উভয়ের মৃত্যুর পর, ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত এটির সম্পূর্ণ সংস্করণ প্রকাশিত হয়নি।
…………….
ওলগা খোকলোভা
…………….
১৯১৭ সালে পাবলো পিকাসো রাশিয়ান ব্যালে নৃত্যশিল্পী ওলগা খোকলোভাকে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন তাঁর প্রথম স্ত্রী ও বড় সন্তান পাওলো পিকাসোর মা। খোকলোভা ছিলেন তাঁর আর্টের নতুন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনুপ্রেরণা, যার সাথে সমন্বয় করে পিকাসো তাঁর কিউবিস্ট আকারগুলিকে আরও উচ্চমার্গে উন্নীত করতে পেরেছিলেন।
পিকাসোর আঁকা ওলগা খোকলোভার প্রতিকৃতি
১৯২১ সালে যখন তাঁর বড় ছেলের জন্ম হয়, শিল্পী তখন মাতৃত্বের ধারণাটি অন্বেষণ করতে শুরু করলেন। খোকলোভা ছিলেন তাঁর মাতৃত্ব নামক যাদুঘরের প্রতীক। পিকাসোর হাত থেকে তখন জন্ম নেয় বৈবাহিক জীবনের আনন্দময় ছবি। তবে সেটি ছিল তাঁর বাস্তবতা-বহির্ভূত এক অধ্যায়। তাঁর স্বামীর অবিশ্বস্ততার কারণে খোকলোভা এক ধরণের বিকারজনিত ঈর্ষায় আক্রান্ত হয়ে স্নায়বিক ব্যাধিতে ভুগেছেন, যা সারাজীবন ধরে তাঁর উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল।
…………….
মারি-থেরেস ওয়াল্টার
…………….
১৯২১ সালের দিকে, পিকাসো যখন প্যারিসের একটি ডিপার্টমেন্ট স্টোরের ১৭ বছরের তরুণী মারি-থেরেস ওয়াল্টারের উপর নজর দিয়েছিলেন, তখন খোকলোভার সমস্যা আরও বেড়ে যায়। পিকাসো তাঁকে প্ররোচিত করবার জন্য কয়েকটি কথা বলেছিলেন: “তোমার চেহারার একটা ভীষণ আকর্ষণ আছে। আমি তোমার একটি প্রতিকৃতি সৃষ্টি করতে চাই। আমার ধারণা আমরা দু’জনে মিলে দারুণ কিছু করতে পারবো। ওহো! আমার নামটিই যে বলা হয়নি, আমি পিকাসো।”
এরপর তাঁদের মাঝে একটি গোপন সম্পর্ক শুরু হয়, যদিও শিল্পীর কিছুই করার ছিল না কিন্তু তাঁর কাজের মধ্যে দিয়েই তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ফুঁটে উঠেছিল। প্রথম দিকে ওয়াল্টারের প্রভাব কিছুটা সূক্ষ্ম ছিল, কিন্তু ১৯৩২ সালে, জর্জেস পেটিট গ্যালারিতে শিল্পী ওয়াল্টারের তিনটি কামোত্তেজক প্রতিকৃতি উন্মোচন করেন। সেগুলির নাম ছিল, যথাক্রমেঃ নুড উইম্যান ইন অ্য রেড আর্মচেয়ার, লে রিভ এন্ড নুড, গ্রিন লিভস এন্ড বাস্ট। খোকলোভার কাছে আর বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তাঁর স্বামীর মনোযোগ অন্য কোন নারীতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে, তাঁর মানসিক স্বাস্থ্য আরও অবনতির দিকে যায়। ১৯৩৪ সালের দিকে, শিল্পীর ব্যভিচারী চরিত্রের উপর তাঁর ক্রোধ এতটাই হিংস্র হয়ে ওঠে যে ডাক্তাররা তাঁকে বাড়ি থেকে সরিয়ে হোটেলে রাখতে বাধ্য হন।
পিকাসোর আঁকা মারি-থেরেসের প্রতিকৃতি
১৯৩৫ সালে পিকাসোর ঔরসে মারি-থেরেস ওয়াল্টার একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। তাঁর নাম রাখেন মায়া উইডমায়ার-পিকাসো। খোকলোভা তখন বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করলেন। কিন্তু পিকাসো সেটি প্রত্যাখ্যান করলেন। কেননা, তিনি নিজের অর্থ বা সম্পত্তির কোনটারই ভাগ খোকলোভাকে দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। ১৯৫৫ সালে খোকলোভা ক্যান্সারে মারা যান, তখনও তাঁর বিচ্ছেদের আবেদন অপূর্ণই ছিল।
পিকাসোর কন্যা মায়ার বয়স যখন মাত্র দু’মাস, তখন শিল্পীর মনোযোগ আবার ভিন্নখাতে প্রবাহিত হয়, এইবারের নারীটির নাম ডোরা মার। তিনি ছিলেন একজন পরাবাস্তববাদী ফটোগ্রাফার। সে সময় ডোরা টেট মডার্নে শিল্পীদের অতীত কাজের বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করছিলেন। পিকাসোর সাথে প্যারিসের একটি ক্যাফেতে তাঁর পরিচয় হয়। এই দুজন ১১ বছর একসাথে কাটিয়েছিলেন। পিকাসোর আশা ছিল ডোরা তাঁর আজ্ঞাবহ থাকবেন। ওয়াল্টারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে রাজি না হওয়া সত্ত্বেও তিনি সেই কাজটিই এতোদিন করে আসছিলেন। সারাদিন ঘরে বসে থাকতেন কখন শিল্পীর কাছে থেকে তাঁর ডাক আসে এই আশায়!
…………….
ডোরা মার
…………….
ডোরা আর পিকাসোর সম্পর্ক স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সূচনার সাথে মিলে যায় এবং তাঁর আঁকা প্রতিকৃতিগুলি তখনকার রাজনৈতিক আবহকে প্রতিফলিত করে, ঠিক তাঁদের সম্পর্কের যন্ত্রণার মতোই। পিকাসো যখন ওয়াল্টারকে উজ্জ্বল রঙে আঁকতে থাকেন, ডোরা তখন আবেগীয় বিনাসে অমর হয়ে ওঠেন, যেমনটি তাঁর বিখ্যাত চিত্র দ্য উইপিং উম্যানে দেখতে পাওয়া যায়। ১৯৪৪ সালে যখন তাঁরা দু’জন আলাদা হয়ে যান, ডোরার তখন স্নায়বিক বৈকল্য দেখা যায়। তাঁকে তাঁর মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্যে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে স্থানান্তর করা হয়।
পিকাসোর আঁকা ডোরার প্রতিকৃতি
ডাক্তার পিকাসোকে বলেছিলেন, “একজন শিল্পী হিসেবে আপনি অসাধারণ হতে পারেন, কিন্তু নৈতিকভাবে বলতে গেলে আপনি খুবই বাজে এক মানুষ।”
এরপর, পিকাসোর জীবনে আসেন জিলো। পিকাসো তাঁর থেকে ৪০ বছর বড় হওয়া সত্ত্বেও, ১৯৪৩ সালে ২১ বছর বয়সী আইনের ছাত্রী জিলোর সাথে যখন তাঁর দেখা হয়েছিল, তখন সে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছিল। তাঁরা তিন বছর পর একত্রিত হয়েছিলেন, তাঁর বিয়ের পর প্রথমবারের মতো কোন প্রেমিকা তাঁর সাথে এমনটি করেছিলেন। জিলো ছিলেন অস্থিরচিত্তের একটি মেয়ে এবং ১০ বছরের মাথায় শিল্পীকে ছেড়ে চলে যান। সে সময় তাদের দুটি সন্তান ছিল, ক্লদ আর পালোমা পিকাসো। জিলো তাঁর সাথে সন্তানদের নিয়ে যান। তিনি বলেছিলেন, ” আমি তাঁকে ছেড়ে না গেলে, সে আমাকে নিশ্চিত শেষ করে দিত।”
১৯৬৪ সালে জিলো তাঁর স্মৃতিকথা প্রকাশ করেন। পিকাসোর প্রকাশনা সংস্থা এটির প্রকাশ আটকাতে ব্যর্থ হয়। পিকাসো তখন ক্রোধে উন্মত্ত। এমনকি নিজের সন্তাদের পর্যন্ত আর কোনদিন দেখতে চাননি। তিনি তাদের মিচুয়াল ডিলারকে ক্লায়েন্ট হিসেবে জিলোকে বাদ দিতে রাজি করান। জিলো তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেন, “পিকাসো আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সেটি ছিল খুবই নোংরা ধরণের যুদ্ধ। কেননা, সকল ক্ষমতা তখন তাঁর হাতে ছিল।” এটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল এবং আজও প্রায় ১০০ বছর বয়সে তিনি এখনো ছবি এঁকে যান।
…………….
জ্যাকলিন রোক
…………….
১৯৫৩ সালে পিকাসোর সাথে তাঁর শেষ প্রেমিকা জ্যাকলিন রোকের সাথে দেখা হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল ৭১ বছর আর জ্যাকলিনের ২৬। পিকাসো তাঁর বাড়িতে চক দিয়ে একটি ঘুঘু একেঁ দিয়ে তাঁর মন জয় করেছিলেন এবং যতদিন সে তাঁর সাথে বাইরে যেতে রাজি না হচ্ছিলেন, ততদিন পর্যন্ত তাঁকে প্রতিদিন একটি করে গোলাপ দিতেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা বিবাহে আবদ্ধ হন এবং বিশ বছরের সম্পর্কের সময় জ্যাকলিন অন্তত তাঁর ৪০০টিরও বেশী চিত্রকর্মের অনুপ্রেরণা ছিলেন, সংখ্যার দিক থেকে তা ছিল পিকাসোর বিগত প্রেমিকাদের চেয়ে অনেক বেশী। তাঁর এই সময়ের প্রতিকৃতিগুলি ছিল একটু ভিন্নধর্মী, পারিবারিক ও বিবাহ সম্পর্কিত আবেগপ্রবণতায় আঁকা। পূর্ববর্তী সময়ে তাঁর এমন ধরণের কাজ দেখা যায়নি। জ্যাকলিনকে সে সময় বেশ স্থিতিশীল মনে হয়েছিল।
১৯৭৩ সালে পিকাসো যখন মারা যান, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তখন তিনি একটি সর্বনাশা উত্তরাধিকার রেখে যান। স্বামীর অনুরোধে জ্যাকলিন পিকাসোর পরিবারের বেশীরভাগ সদস্যকে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে আসতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি কোন কিছু উইল করে রেখে যাননি। গুজব ছড়ায় যে, তিনি ৪৫০০০ পেইন্টিংস, নগদ ৩.৫ মিলিয়ন ডলার এবং ১ মিলিয়ন পাউন্ড সমপরিমান ডলারের স্বর্ণ রেখে গেছেন। যার ফলে, তাঁর উত্তরাধিকারের মধ্যে একটি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
পিকাসোর আঁকা জ্যাকেলিনের প্রতিকৃতি
মেরিনা পিকাসো লিখেছিলেন, “আমার পরিবারের কেউই তাঁর প্রতিভার নিষ্পেষণ থেকে পালাতে পারেনি।” প্রকৃতপক্ষে, শিল্পীর মৃত্যুর পরে, জ্যাকলিন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে, এভাবে তেরটি বছর কাটিয়ে দেবার পরে নিজেকে গুলি করে হত্যা করেন। পিকাসোর মৃত্যুর চার বছর পর ওয়াল্টারও গলায় ফাঁস দিয়ে মারা গিয়েছিলেন; পিকাসোর নাতি পাবলিটো এক বোতল ব্লিচ কেমিক্যাল পান করে মারা যান; তাঁর ছেলে, পাওলো বিষন্নতায় ভুগে মদ খেতে খেতে মারা যান।
পিকাসোর জীবনের ঘটনা লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাঁর নারীরা অমূল্য অবদান রেখেছিলেন। জিলো ও অলিভিয়ারের স্মৃতিকথার পাশাপাশি, খোকলোভা ও ওয়াল্টার ফটোগ্রাফ এবং চিঠির বিস্তৃত ভান্ডার সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন আর ডোরার নিজের আঁকা ছবিগুলি জীবন্ত কিছুর সাক্ষী হয়েছিল।
ডোরা পরবর্তী সময়ে রোমান ক্যাথলিকবাদে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল, “পিকাসোর পর, একমাত্র ঈশ্বরই আছেন।” পিকাসোর প্রেমিকারা তাঁর প্রতি যেমন মোহগ্রস্ত ছিলেন, তেমনি তিনিও তাঁদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। প্রতিটি সম্পর্কই তাঁর কাজের ক্ষেত্রে নতুন নতুন দিক উন্মোচন করেছিল, শৈলীর বৈচিত্র্য এনে দিয়েছিল। বিশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পীকে বিচার করতে হলে শুধুমাত্র পুরুষ পিকাসোকে বিবেচনা করলেই হবেনা, সেই পুরুষকে যারা তৈরী করেছে, সেই নারীদেরও বিবেচনায় আনতে হবে।
উইকিপিডিয়া ও বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ অবলম্বনে রচিত