ভূমিকা ও ভাষান্তর: বিপাশা চক্রবর্তী
অ্যামি লোরেন্স লাওয়েল ছিলেন একাধারে কবি, সম্পাদক, অনুবাদক। যিনি আধুনিক কবিতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। লাওয়েল ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন,”ঈশ্বর আমাকে একজন ব্যবসায়ী মহিলা বানিয়েছেন,” “এবং আমি নিজেকে একজন কবি বানিয়েছি।” মাত্র বারো বছরের কিছুটা বেশি সময় বিস্তৃত এক কর্মজীবনে ৬৫০ টিরও বেশি কবিতা লিখেছিলেন এবং প্রকাশ করেছিলেন।
অ্যামি লাওয়েল ইমেজিস্ট (চিত্রকল্পবাদ) আন্দোলনের প্রতি গভীরভাবে আগ্রহী এবং পরে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তার সংকলন What’s A Clock এর জন্য ১৯২৬ সালে তাকে মরণোত্তর পুলিৎজার পুরস্কার দেয়া হয়।
অ্যামি লোয়েল ১৮৭৪ সালে ম্যাসাচুসেটসের ব্রুকলাইনের সেভেনেলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ছিল এপিস্কোপ্যালিয়ান। পুরানো নিউ ইংল্যান্ডের অধিবাসী এবং বোস্টন সমাজের শীর্ষস্থানীয় বনেদী ধনী পরিবারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে লাওয়েল ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। বড় ভাই অ্যাবট লরেন্স, তার জন্মের সময় হার্ভার্ডে একজন নবীন ছাত্র ছিলেন। পরে হার্ভার্ড কলেজের সভাপতি হন। শৈশবে তিনি প্রথমে বাড়িতে শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন। তারপরে বোস্টনের প্রাইভেট স্কুলে পড়াশোনা করেন। সেই সময়ে তার পরিবারের সাথে ইউরোপে বেশ কয়েক বার ভ্রমণ করেন। স্কুল ছিল অ্যামি লাওয়েলের জন্য যথেষ্ট হতাশার। স্কুলে তাকে “পুরুষালী” এবং “কুৎসিত” বৈশিষ্ট্যগুলির বিকাশকারী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তিনি অনেকটা সামাজিকভাবে বহিষ্কৃত হয়ে পড়েন। স্পষ্টভাষী এবং একগুঁয়ে মতামত দেওয়ার জন্য সহপাঠীদের মধ্যে তার খ্যাতি ছিল। এমনকি লাওয়েলকে লেসবিয়ান বলা হয়েছিল। ১৯১২ সালে তিনি অভিনেত্রী অ্যাডা ডোয়ায়ার রাসেলের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। রাসেল তার বেশকিছু কামোত্তেজক সৃষ্টিকর্মের বিষয় হিসেবে পরিচিতি পান। গ্রন্থিজনিত একটি সমস্যা তাকে চিরতরে অতিরিক্ত ওজনের করে রাখে। পরিবারের বাধার কারণে কখনো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার সুযোগ পাননি। কিন্তু সতেরো বছর বয়সে সাহিত্য অধ্যয়নের জন্য সেভেনালসের সাত হাজার বইয়ে সমৃদ্ধ পাঠাগারের নির্জন পরিবেশ পেয়েছিলেন। লাওয়েল ছোটবেলা থেকেই লিখতে উৎসাহিত হন। ১৮৮৭ সালে তার মা এবং বোনের সাথে গল্প লিখেছেন। পরে গল্পগুলি ফেইরি ল্যান্ড বাই এ ড্রিমার নামে বোস্টনের প্রকাশনী কাপলস অ্যান্ড হার্ড থেকে ব্যক্তিগতভাবে মুদ্রিত হয়। তার কবিতা “ফিক্সড আইডিয়া” ১৯১০ সালে মাসিক পত্রিকা আটলান্টিকে প্রকাশিত হয়। পরে লাওয়েলের অনেক কবিতা বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯১২ সালের অক্টোবরে প্রকাশনা সংস্থা হাউটন মিফলিন থেকে তার প্রথম কবিতা সংগ্রহ, A Dome of Many Colored Glass প্রকাশিত হয়।
২০ শতকের গোড়ার দিকের একটি অ্যাংলো-আমেরিকান ক্যাবিক আন্দোলন ইমেজিজম বা চিত্রকল্পবাদ হিসেবে পরিচিত। এই ইমেজিজম সেসময়কার আধুনিক কবিতায় প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। যা সুনিদির্ষ্ট চিত্র ব্যবহারের মাধ্যমে কবিতার ভাব প্রকাশের স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করে। প্রাথমিক ইমেজিস্টরা ছিলেন এজরা পাউন্ড, ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড, এইচ ডি (হিলডা ডুলিটল), এবং রিচার্ড অল্ডিংটন।
অ্যামি লাওয়েল এই অ্যাংলো-আমেরিকান আন্দোলনে বিশ্বাস করতেন। লাওয়েলের ভাষায়, “কবিতার সারমর্ম হল একাগ্রতা” যা কখনই অস্পষ্ট বা অনির্দিষ্ট নয় বরং মজবুত আর সুস্পষ্ট এমন কবিতা তৈরি করার জন প্রচেষ্টা চালায়”। লাওয়েল আমেরিকায় ইমেজিস্ট কবিতার সাফল্যের জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন । নিজের কবিতা লেখার ক্ষেত্রে এর নীতিগুলি গ্রহণ করেছিলেন। ১৯১৫ সালে ইমেজিস্ট কবিদের একটি সংকলন সম্পাদনা এবং প্রকাশে অবদান রাখেন। তার এই প্রচেষ্টা এজরা পাউন্ড আর এইচ ডি’র ইমেজিজমের প্রতি আমেরিকান পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কবিতার এই সমসাময়িক প্রবণতাগুলি আমেরিকা তথা সাহিত্যের পাঠকদের গোচরে আনবার জন্য তার ভূমিকা আর অক্লান্ত প্রচেষ্টাকে সাহিত্য ইতিহাসের একটি প্রভাবশালী অবদান হিসেবে পণ্ডিতরা স্বীকার করেছেন।
তার উৎসাহী সম্পৃক্ততা এবং প্রভাব এই আন্দোলনে কবি এজরা পাউন্ডের ভূমিকাকেও ম্লান করে দেয়। লাওয়েল যখন ইমেজিস্ট শৈলী অন্বেষণ করতে থাকেন তখন তিনি ইংরেজিতে “পলিফোনিক গদ্য” ব্যবহারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন যা প্রচলিত কবিতার এবং মুক্ত ফর্মের মিশ্রণ। পরে তিনি চীনা ও জাপানি কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং এগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হন। এই আগ্রহ তাকে ১৯২১ সালে অনুবাদক ফ্লোরেন্স অ্যাসকফের সাথে ফার-ফ্লাওয়ার ট্যাবলেট প্রকাশে সহযোগিতা করতে পরিচালিত করে। কবি জন কিটসের প্রতি লাওয়েলের আজীবন ভালবাসা ছিল যার চিঠিগুলি তিনি সংগ্রহে রেখেছিলেন। তার প্রভাব লাওয়েলের অনেক কবিতায় দেখা যায়। তিনি জন কিটসকে ইমেজিজমের বাহক বলে বিশ্বাস করতেন। লাওয়েলের লেখা কিটসের জীবনী ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। একই বছর প্রকাশিত হয় তার সংগ্রহ What’s A Clock যার জন্য পুলিৎজার পুরস্কার জিতেছিলেন।
লাওয়েল ছিলেন একজন আত্মবিশ্বাসী জাঁকালো চরিত্রের নারী। নিউ ইংল্যান্ডের একটি অবস্থাসম্পন্ন ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবারের দেওয়া শিক্ষা আর প্রতিপালন পদ্ধতিকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছিলেন। তার আদিম-নারীবাদী কবিতাগুলি সার্বজনীন চেতনা আর প্রচলিত প্রথাগুলিকে আকুন্ঠভাবে বিদ্রুপ করে। “কবি, প্রচারক, বক্তা, অনুবাদক, জীবনীকার, সমালোচক … তার তেজস্বিতা প্রায় তার কবিতার মতোই অসাধারণ,” কবি লুই আনটারমেয়ার তার ১৯২৩ সালের রচনা American Poetry since 1900-তে লাওয়েল সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন।
এই নিবেদিতপ্রাণ কবি ৫১ বছর বয়সে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে ১৯২৫ সালে জন্মস্থান সেভেনলে মারা যান।
ভোরের কাকলি
আমি যেভাবে সবুজ আচ্ছাদনের ভেতর থেকে সাদা বাদামকে মুক্ত করব
সেভাবে তোমার জমকালো পোষাক টেনে খুলবো
প্রিয়তম।
এবং কোমল আর নিকষ মর্মস্থলে অঙ্গুলিসঞ্চালনে
আমি দেখতে চাই যে আমার হাত ঝিকমিক করছে অগণিত রত্নে ।
বিরোধীরা
নগন্য মানুষের বকবকানি
বিগড়ে দেয় আমার অভিসন্ধি
যেভাবে জলের বিন্দু যা ধীরে করে পাথরকে চূর্ণ।
আর যখন হাসি আমি
আমার তেজে ভেঙে পরে তাদের উপহাসের স্পর্শ।
বর্ণালি মণি
তুমি বরফ আর আগুন
তোমার স্পর্শে আমার হাত পুড়ে যায় তুষারের মতো
তুমি শৈত্য আর অগ্নিশিখা
তুমি অ্যামিরিলিসের রক্তিম আভা
চন্দ্রকান্তি ম্যাগনোলিয়ার রূপা
আমি যখন তোমার সাথে
আমার হৃদয় এক হিমায়িত জলাশয়
ঝলমলে হয় কম্পিত মশালে।
প্রেমিকার প্রতি
যদি এক জোনাকির সবুজ লন্ঠন আমি ধরতে পারতাম
তোমাকে একটি চিঠি লিখছি আমি দেখতে পেতাম।
এক দশক
তুমি যখন এসেছিলে, তুমি ছিলে লাল শরাব আর মধুর মতো,
আর তোমার স্বাদ আমার মুখে পুড়িয়ে দিয়েছিল তার মিষ্টতায়।
এখন তুমি সকালের পাউরুটির মত,
নিভাঁজ এবং উপাদেয়
আমি খুব কমই তোমার স্বাদ গ্রহণ করি কারণ আমি তোমার স্বাদ জানি ,
কিন্তু আমি একদম পরিপুষ্ট।
তথ্যসূত্র
allpoetry.com
poetryfoundation.org