এক নজরে নোবেলজয়ী অক্তাবিও পাস

বিশ্বসাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র অক্তাবিও পাস লোসানো, পরে যিনি বিশ্বব্যাপী নামের শেষ অংশটুকু ছাড়াই পরিচিত হয়ে পড়বেন। ছিলেন একাধারে কবি, লেখক ও কূটনীতিবিদ। চিত্রকলা এবং চলচ্চিত্রেরও এক গুণবিচারী লেখক। স্বদেশ ও পৃথিবীর রাজনীতি সম্পর্কে তার আগ্রহ ছিল প্রবল। ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রায় সর্বত্র তার প্রবেশ ছিল অবাধ, এসব নিয়ে লিখেছেনও অকৃপণভাবে। অক্তাবিও পাস মানেই প্রায় গোটা বিশ্বের মন ও মননকে একটি আয়নায় পেয়ে যাওয়ার অমেয় আনন্দ।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া গৃহযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ১৯১৪ সালের ৩১ মার্চ মেক্সিকো সিটিতে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। তার বাবার নাম পাস সোলার্সানো আর মা’র নাম হোসেফিনা লোসানো। বাবা ছিলেন একজন সক্রিয় রাজনীতিবিদ,বিপ্লবী দলের সদস্য। কাজ করেছেন অন্যান্য প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের সাথে একজন সক্রিয় রাজনৈতিক সাংবাদিক হিসেবে। তিনি এমিলিয়ানো সাপাতার নেতৃত্বে কৃষি বিপ্লবে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সাপাতা নিহত হবার পর পাসের পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। শৈশবকালটি অক্তাবিওকে পিতামহের তত্বাবধানে পার করতে হয়েছিল। পাসের দাদা ছিলেন একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি রাজনৈতিক কর্মী এবং প্রখ্যাত লেখক । মেক্সিকোর আদিবাসীদের প্রেক্ষাপটে প্রথম যারা উপন্যাস লিখেছেন, তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। বিদ্বান এই মানুষটির পড়শুনার প্রতি গভীর ঝোঁক ছিল। সেই সুবাদে গড়ে তুলেছিলেন উৎকৃষ্ট এক পাঠাগার। পাসের সৌভাগ্য তিনি এমন একজন দাদা পেয়েছিলেন, সেই সাথে সমৃদ্ধ একটি পাঠাগার যেখানে তিনি কম বয়সেই সাহিত্যের স্বাদ নিতে পেরেছিলেন। এই পাঠাগারেই মেক্সিকান ও ইউরোপীয় সাহিত্যের সাথে পাসের প্রথম পরিচয় হয়। আট বছর বয়স থেকেই লিখতে শুরু করেন । উনিশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে তিনি মেক্সিকোর কূটনৈতিক পেশায় যোগদান করেন। ভারতে রাষ্ট্রদূত থাকাকালে তিনি হিন্দু ও বৌদ্ধ দর্শন অধ্যয়নের সুযোগ পান যা তার পরবর্তী লেখাকে প্রভাবিত করে। বামপন্থী লেখক হিসেবে পরিচিত পাস কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বা নিকারাগুয়ার স্যান্ডিনিস্টা গেরিলা আন্দোলনকে সমর্থন করেননি। পরে তিনি বলেছিলেন, “বিপ্লব একটি প্রতিশ্রুতি হিসাবে শুরু হয়, হিংসাত্মক আন্দোলনে তছনছ হয় এবং রক্তাক্ত স্বৈরশাসনে স্থবির হয়ে যায়, আর অস্বীকার করে সেই জ্বলন্ত আবেগকে যা এর অস্তিত্ব এনে দিয়েছিল।”

স্পেনে গৃহযুদ্ধের সময় পাস রিপাবলিকানদের প্রতি নিজের সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তারই এক সহযোদ্ধাকে রিপাবলিকানরা হত্যা করে বিধায় তাদের প্রতি তার মোহভঙ্গ হয়। পাসের জীবনে ডেভিড রোসেট, আঁদ্রে ব্রেতোঁ ও আলবেয়ার কামুর প্রভাবও কম ছিল না। সে কারণের পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে রাশিয়ার জোসেফ স্তালিনের বিরুদ্ধে তার সমালোচনামূলক বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। Plural ও Vuelta সাময়িকীতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানবাধিকার লংঘনের চিত্র তুলে ধরেছিলেন পাস। ফলশ্রুতিতে, লাতিন আমেরিকার বামপন্থীদের একাংশের কাছে তিনি শত্রু বলে পরিচিতি পেয়েছিলেন। কমিউনিস্ট ভাবধারা ত্যাগ করার কারণে অনেক মেক্সিকান বুদ্ধিজীবীরাও তার প্রতি প্রকাশ্যে শত্রুতা শুরু করেছিলেন। তবে পাস নিজেকে বামপন্থী চেতনার ধারক বলেই মনে করতেন। তিনি ছিলেন অনেকটা গণতান্ত্রিক বামপন্থী। কিন্তু তার মূল বিরোধ ছিল গোড়া মতাদর্শের সাথে আর আধিপত্যবাদী ভাবধারার সাথে।

শৈশব এবং প্রাথমিক জীবন

অক্তাবিও পাস লোসানো ১৯১৪ সালের ৩১ শে মার্চ মেক্সিকো সিটিতে স্প্যানিশ এবং আদিবাসী বংশোদ্ভূত এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা অক্তাবিও পাস সোলার্সানো একজন বিশিষ্ট আইনজীবী এবং সাংবাদিক ছিলেন। তিনি মেক্সিকান বিপ্লবী এমিলিয়ানো সাপাতার পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করেছিলেন। এবং ১৯১১ সালের কৃষি-বিদ্রোহে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।

বাবা বেশিরভাগ সময়ই বিপ্লবী আন্দোলনে অংশ নেয়ার কারণে পরিবার থেকে দূরে থাকতেন। পুরো পরিবার আর অক্তাবিওর দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করতেন দাদা ইরেনেও পাস। দাদাও ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী এবং লেখক । ১৯১৫ সালে দাদা শিশু অক্তাবিও আর তার মাকে নিয়ে আসেন তার নিজের বাড়িতে। দাদার বাড়িটি ছিল মেক্সিকো শহর থেকে কিছুটা দূরে মিক্সওয়াক নামের এলাকায়। এটাকে প্রাক- হিস্পানিক শহরও বলা চলে। এখন এটি মেক্সিকো শহরের অংশ। সেখানে শিশু অক্তাবিওকে তার দাদা, মা হোসেফিনা লোসানো এবং ফুপু আমালিয়া পাস লালন পালন করেছিলেন। শহরের বিশাল বিশাল বাড়ি, আশেপাশের বাগান সেইসাথে কাঁকড় বিছানো রাস্তাগুলি তার মনে চিরন্তন ছাপ রেখেছিল যা পরে তার অনেক লেখায় প্রতিফলিত হয়েছিল।

১৯১৯ সালে, সাপাতা নিহত হওয়ার পর, পাসের বাবা অক্তাবিও পাস সোলার্সানো লস এঞ্জেলেসে স্থানান্তরিত হন। পরের বছর, ১৯২০ সালের কোন এক সময় তিনি তার স্ত্রী এবং সন্তানকেও নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। তাই ১৯২০ সালে, ছয় বছর বয়সী অক্তাবিও এবং তার মা লস এঞ্জেলেসের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সেখানে তারা দুই বছর ছিলেন। লস এঞ্জেলেসে, পাস একটি স্থানীয় কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি হন। ইংরেজির একটি শব্দও না জানার কারণে, তিনি কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারতেন না। নিজেকে একজন বহিরাগত বলে মনে করতেন। বিব্রত হয়ে তিনি নীরবতার আশ্রয় নেন। শিশু হলেও তিনি দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্যটা অনুভব করতে পেরেছিলেন। এই অনুভূতি একদিন তার লেখায় প্রতিফলিত হবে, বিশেষ করে ‘এল লাবেরিন্তো দে লা সোলেদাদ’ (দ্য ল্যাবিরিন্থ অফ সলিচুড, ১৯৫০)।

১৯২২ সালের দিকে তারা মেক্সিকোতে ফিরে আসেন। মিক্সওয়াকের বাড়িতে তার দাদা এবং ফুপুর সাথে বসবাস শুরু করেন। আবারও, এখানে তরুণ অক্তাবিওর খাপ খাওয়ানো কঠিন মনে হচ্ছিল। নিজেকে একজন বাইরের লোকের মতো অনুভব করতে শুরু করেছিলেন। এবার, তিনি লেখার দিকে এগিয়ে গেলেন, কবিতা আর গদ্য, উভয় ক্ষেত্রেই তার তীব্র অনুভূতির প্রকাশের চেষ্টা করলেন।

১৯২৪ সালে তাঁর দাদার আকস্মিক মৃত্যুও তাঁর লেখায় আবেগ যোগ করে। তিনি পরে লিখেছিলেন,”মৃত্যুতে আমি ভাষা আবিষ্কার করেছি।” মিক্সওয়াকে, অক্তাবিও প্রথমে শহরের মাঝখানে অবস্থিত লা সাইয়্যে ব্রাদার্স প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে তাঁকে একই শহরের কলেহিও উইলিয়ামস-এ পড়তে পাঠানো হয়। এখানে তিনি ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন। এতদিনে, তাদের আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে তাদের বাসস্থানের ঘরগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছিলেন না। কক্ষগুলো একের পর এক বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে উঠছিল। মূল্যবান কিছু আসবাবপত্র অন্য কক্ষে সরিয়ে নিয়ে সেগুলো তারা পরিত্যাগ করতে থাকেন।

যাইহোক, অক্তাবিও এখনও তার দাদার রেখে যাওয়া দুর্দান্ত পাঠাগারে প্রবেশাধিকার পাচ্ছিলেন। সেখানে তিনি ইংরেজী ভাষার চিরায়ত সাহিত্যের পাশাপাশি সেরা মেক্সিকান সাহিত্যের সংস্পর্শে এসেছিলেন। এভাবে তিনি অল্প বয়সে হেরার্দো দিয়েগো, হুয়ান রামন হিমেনেস এবং আন্তোনিও মাচাদোকে আবিষ্কার করেন, পরবর্তীতে যা তার লেখায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করবে। তার জীবন, তখনও পর্যন্ত ছোট শহর মিক্সওয়াককে কেন্দ্র করেই ছিল। কিন্তু তা বদলে যায় ১৯২৭ সালের দিকে। এসময় তিনি ‘প্রিপারেটরিয়া ন্যাশনাল-এ ভর্তি হন। দু’বছর ধরে, তিনি প্রতিদিন মেক্সিকান শহরের কেন্দ্রে ভ্রমণ করেন যা তাকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মুখোমুখি করে।

কলেজ জীবন

১৯৩২ সালে, অক্তাবিও পাস লোসানো মেক্সিকোর জাতীয় স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে(UNAM) প্রবেশ করেন। এখানে বামপন্থী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। পড়াশোনা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি লেখালেখিতেও মনোনিবেশ করেন, একই বছরে বেশ কয়েকটি কবিতা প্রকাশ করেন। সেই সময়ে প্রকাশিত আরও সুপরিচিত কবিতাগুলির মধ্যে একটি ছিল ‘Cabellera. তাঁর প্রথম নিবন্ধ, ‘Etica del artista’ (Ethics of the Artist) ও একই সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল। যাইহোক, এই সময়ের মধ্যে তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব ছিল তিন বন্ধু রাফায়েল লোপেস মালো, সালভাদর তোসকানো এবং আর্নুলফো মার্তিনেস লাবাইয়্যেকে নিয়ে ‘Barandal’শিরোনামের একটি আভাঁ-গার্ড সাহিত্য পত্রিকার প্রতিষ্ঠা। পাসের প্রথম কবিতার বই ‘লুনা সিলবেস্ত্রে’ (ওয়াইল্ড মুন বা বুনোচাঁদ) ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে, তার আরও দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৩৬ সালে ‘No pasarán!’ এবং ১৯৩৭ সালে ‘Raíz del hombre’। এই সময়ের মধ্যে, তিনি তার কিছু কাজ চিলির বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদার কাছে পাঠান। নেরুদা তা পাঠ করে কেবল অনুকূল অভিমতই জানাননি, এমনকি তাকে পরবর্তীতে স্পেনে অনুষ্ঠিতব্য বামপন্থী লেখকদের সভায় যোগদানের জন্য উৎসাহিত করেছিলেন।

লেখকদের সভায় অংশগ্রহণ

অবশেষে অক্তাবিও পাস রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং লেখালেখির সাথে এতটাই জড়িত হয়ে পড়েন যে তিনি আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ ত্যাগ করেন। ১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে, স্কুলমাস্টার হওয়ার জন্য মেক্সিকোর মেরিদা চলে যান। বিদ্যালয়টি গরীব কৃষক ও শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য স্থাপন করা হয়েছিল। এখানে, তার কাজ কেবল পড়া শেখানো নয়, বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর জন্য ছাত্রদের খুঁজে বের করার দায়িত্বও ছিল। তাদের সন্ধান করতে গিয়ে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন কিভাবে কৃষকরা জোতদারদের জুলুমের শীকার হয়। তিনি এখানে যা দেখেছিলেন তা তাকে একটি দীর্ঘ কবিতা শুরু করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। পরে কবিতাটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘এন্ত্রে লা পিয়েদ্রা ই লা ফ্লোর’। তবে সেখানে বেশিদিন থাকতে পারেননি। তিন মাসের মধ্যে, ভ্যালেন্সিয়ায় স্পেনের ডিফেন্স অফ কালচারে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক লেখক কংগ্রেসে যোগদানের জন্য স্পেনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তারপর মেরিদায় তাঁর শিক্ষকতার পদে আর ফিরে আসেননি। পাস রিপাবলিকানদের দৃঢ়ভাবে নিজের সমর্থন দিয়েছিলেন। এসময় তিনি যা দেখেছিলেন তা প্রতিফলিত হয়েছিল ‘Bajo Tu Clara Sombra y otros poemas sobre España’ নামে তার চতুর্থ কবিতার বইটিতে।সে বছরেই স্পেনে প্রকাশিত হয়েছিল বইটি। এটি তাকে প্রতিশ্রুতিশীল লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ১৯৩৮ সালে, মেক্সিকোতে ফেরার পথে তিনি প্যারিসে থামেন। এখানে, তিনি অনেক পরাবাস্তববাদী শিল্পীদের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন । পরাবাস্তববাদ এবং এর সমর্থনকারী ভক্ত, উভয়ের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

মেক্সিকোতে প্রত্যাবর্তন

১৯৩৮ সালে, মেক্সিকোতে ফিরে আসার পর, অক্তাবিও পাস দুটি সাহিত্য পত্রিকার সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। একটির নাম ‘Taller’ অর্থ কর্মশালা এবং অন্যটি El Hijo Prodigo, যার অর্থ শিশু জাদুকর । এই পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে মেক্সিকোর উদীয়মান নুতন প্রজন্মের লেখকদের ও সংবেদনশীল সাহিত্যের উপর প্রেরণা দেবার কাজে নিয়োজিত হন। একইসঙ্গে, ‘Entre la piedra y la flor’- নিয়ে পুনরায় কাজ শুরু করেন, যে দীর্ঘ কবিতাটি তিনি মেরিডায় শুরু করেছিলেন। এটি ১৯৪১ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৪৩ সালে, পাস দুই বছরের জন্য গগেনহেইম ফেলোশিপ অর্জন করেন। এটি ব্যবহার করে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাংলো আমেরিকান আধুনিক কবিতার উপরে অধ্যয়ন শুরু করেন। এই সময়ে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক এলাকা ভ্রমণ করেন।

একজন কূটনীতিবিদ

১৯৪৫ সালে, অক্তাবিও পাস লোসানো তার জীবনের একটি নতুন পর্বে প্রবেশ করেন। সে বছর, তিনি মেক্সিকান কূটনৈতিক পরিষেবাতে যোগদান করেন। প্রথমে নিউ ইয়র্ক সিটি তারপর প্যারিসে নিযুক্ত হন। পাস ১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত প্যারিসে থাকেন। এখানে তিনি অনেক বিখ্যাত চিন্তাবিদ এবং লেখকের সাথে সাক্ষাত করেন । জ্যাঁ পল সার্ত্রে, আঁদ্রে ব্রেতোঁ, অ্যালবেয়ার কামু, বেঞ্জামিন পেরেটসহ আরো অনেকের সাহচর্য পান। তাদের সাথে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি প্রকাশনাগুলিতে অংশ নেন। এই সময়টা তার জন্য খুবই ফলপ্রসূ ছিল। এখানেই কোন এক সময়, তিনি লিখেছেন ‘এল লাবেরিন্তো দে লা সোলেদাদ’ (নিঃসঙ্গতার গোলকধাঁধা)। এটি মেক্সিকান জাতিসত্তার পরিচয় নিয়ে মৌলিক গবেষণাধর্মী একটি প্রবন্ধ যা বই আকারে ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয়। এটি তাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে ভুমিকা রাখে। ১৯৫২ সালে, তিনি প্রথমবার ভারত আসেন। পরবর্তীতে একই বছর, তিনি টোকিওতে মেক্সিকান দূতাবাসে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসাবে যোগদান করেন । সেখান থেকে তাকে জেনেভা পাঠানো হয়।১৯৫৪ সালে মেক্সিকো সিটিতে ফিরে আসেন।

এরপর ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি মেক্সিকোতে বসবাস করেন । এই বছরেই তার অমর কবিতা ‘Piedra de sol’ (“সানস্টোন”) প্রকাশিত হয়। দাপ্তরিক কাজে প্যারিসে অল্প কিছুদিন থাকার পর, ১৯৬২ সালে মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত হিসেবে ভারতে আসেন। এবার তিনি হিন্দু ও বৌদ্ধ দর্শন অধ্যয়নের ব্যাপক সুযোগ পান। তবে তার আগ্রহ ধর্মের চেয়ে এর মননশীল ক্ষেত্রেই বেশি ছিল । এই সময়কালে, তিনি কলকাতার আভান্ট-গার্ড কবিদের একটি দল ‘হাংরি জেনারেশন’-এর সদস্যদের সাথেও ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন । ঐ কবিদের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেন। এটি ছিল কবির জীবন ও কর্মের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ভারতে অবস্থানকালেই অসামান্য কয়েকটি প্রবন্ধের বই লিখেছেন, পাশাপাশি লিখেছেন প্রচুর সংখ্যক কবিতাও যা তার তিনটি কাব্যগ্রন্থে বিধৃত হয়ে আছে। তার এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজ হল ‘লাদেরা এস্তে’ (ইস্টার্ন স্লোপ, ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত) এবং ‘এল মনো গ্রামাটিকো’ (১৯৭৪ সালে প্রকাশিত মাঙ্কি গ্রামারিয়ান)। ২ অক্টোবর, ১৯৬৮ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমসের সময় মেক্সিকো সিটির ত্লাতেলোল্কো বিভাগের প্লাসা দে লাস ত্রেস কালচারাসে মেক্সিকান সামরিক ও পুলিশ কর্তৃক আনুমানিক ৩০০ ছাত্র এবং বেসামরিক লোক নিহত হয়েছিল। বিক্ষোভরত ছাত্রদের উপর সরকারের রক্তক্ষয়ী দমন-পীড়নের প্রতিবাদে পাস কূটনৈতিক পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

পরের বছরগুলো

ভারত ত্যাগ করার পর, পাস প্যারিসে কিছু সময় কাটান । ১৯৬৯ সালে মেক্সিকোতে ফিরে আসেন। একই বছরে, তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিমন বলিভার চেয়ারে অভিষিক্ত হন । এই পদে থেকে তিনি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। তারপরে, তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চার্লস এলিয়ট নর্টন প্রফেশরশিপ নিয়ে ১৯৭০থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। এখানে তার দেয়া লেকচার নিয়েই সৃষ্টি হয় আরেক সাহিত্য-কীর্তি ‘লস ইহোস দেল লিমো (কর্দমার শিশু)।

এছাড়াও ১৯৭০ সালে লিবারেল মেক্সিকান এবং লাতিন আমেরিকান লেখকদের একটি দলের সাথে ‘Plural বা বহুবচন’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকার সহ-প্রতিষ্ঠা হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৫ সালে, মেক্সিকান সরকার Plural নিষিদ্ধ করলে তিনি Vuelta’ নামে আরেকটি সাংস্কৃতিক পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এটির সম্পাদক ছিলেন।

উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্ম

১৯৫৭ সালে প্রকাশিত ‘Piedra de Sol (সানস্টোন বা সূর্যপাথর) পাসের অত্যন্ত প্রশংসিত কবিতাগুলির একটি। এটি বৃত্তাকার অ্যাজটেক ক্যালেন্ডারের ৫৮৪ দিনের উপর ভিত্তি করে রচিত ৫৮৪টি লাইনের একটি পরাবাস্তববাদী মাস্টারপিস কবিতা। যা প্রেমময়তা, মৃত্যু, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ এসবকিছুকে স্পর্শ করেছে। এটি পরবর্তীকালে এলিয়ট ওয়েইনবার্গার ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। ১৯৮৭ সালে ‘The Collected Poems of Octavio Paz 1957-1987 (‘অক্তাবিও পাসের কাব্যসংগ্রহ ১৯৫৭-১৯৮৭’) গ্রন্থের অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রবন্ধগুলির মধ্যে ‘এল লাবেরিন্তো দে লা সোলেদাদ’ বা নিঃসঙ্গতার গোলকধাঁধার জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়। কাজটি নয়টি অংশে বিভক্ত।

পুরস্কার ও কৃতি

১৯৯০ সালে, অক্তাবিও পাস লোসানো সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেছিলেন। নোবেল কমিটি তাঁর এই প্রাপ্তি সম্পর্কে বলেছিল- “for impassioned writing with wide horizons, characterized by sensuous intelligence and humanistic integrity.”

এছাড়াও, সাহিত্যে ব্যক্তিস্বাধীনতার আবেদন উপজীব্য হবার কারণে জেরুজালেম পুরস্কার (১৯৭৭) লাভ করেন। তিনি আরও অনেক পুরষ্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, মিগেল দেসের্ভান্তেস পুরস্কার (১৯৮১) এবং সাহিত্যের জন্য নিউস্ট্যাড ইন্টারনাল প্রাইজ (১৯৮২)। ১৯৮০ সালে, তাকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট প্রদান করা হয়।

ব্যক্তিগত জীবন এবং উত্তরাধিকার

১৯৩৭ সালে, অক্তাবিও পাস বিখ্যাত মেক্সিকান লেখিকা এলেনা গাররোকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির এলেনা লাউরাপাসগাররো নামে একটি কন্যাসন্তান ছিল। ১৯৫৯ সালে তাদের বিয়ে ভেঙ্গে যায়। যাইহোক, এলেনা সর্বদা দাবি করতেন যে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি এবং যদি এমন কোন কাগজ থাকে তবে তা প্রতারণামূলক। ১৯৬৫ সালে পাস ফরাসি নারী মারি হোসে ত্রামিনিকে বিয়ে করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ত্রামিনির সঙ্গেই ছিলেন পাস। জীবনের শেষ দিকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন । ১৯ এপ্রিল ১৯৯৮ সালে ৮৪ বছর বয়সে মেক্সিকো সিটিতে মারা যান।

পাস ছিলেন একজন খাঁটি কবি ও প্রবন্ধকার। ‘কবিতা হচ্ছে- আধুনিক যুগের গোপন ধর্ম– এই বিশ্বাস দ্বারা তার কাব্যিক রচনা সংকলন পরিপুষ্ট হয়েছে। এলিয়ট ওয়েইনবার্গার পাস সম্পর্কে লিখেছেন, “শব্দের বিপ্লব মানে বৈশ্বিক বিপ্লব, আর এ দুটোরই অস্তিত্ব আত্মার বিপ্লব ছাড়া টিকতে পারে না: জীবন হলো শিল্প, হারিয়ে যাওয়া পৌরাণিক মানুষ, প্রকৃতি, চিন্তা ও আত্মার একত্রে ফিরে আসা, আমি এবং সবার ফিরে আসা। তার কবিতা শাশ্বত প্রেরণায় ও অনন্ত অস্তিত্বশীল স্বচ্ছতায় প্রসারিত হয়েছে। একজন অসাধারণ গদ্য রচনাশৈলীর অধিকারী পাস প্রবন্ধ রচনায় অনন্য সৃজনশীলতার সাক্ষর রেখেছেন। সেগুলির মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু বই আকারের গবেষণা, রসশাস্ত্র, সাহিত্য ও শিল্প সমালোচনা, পাশাপাশি ছিল মেক্সিকান ইতিহাস, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি। অক্তাবিও পাসের সৃষ্টিকর্মগুলির অধিকাংশই বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এই সৃষ্টিকর্মগুলোই তার উত্তারাধিকার হিসেবে বেঁচে আছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart