যদিও অসামান্য এই কথাসাহিত্যগুলো নিষ্ক্রান্ত হয়েছিল নারীদের হাত থেকে, তার বিষয়বস্তুও ছিল নারী, কিন্তু তার পাঠক কেবল নারীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সর্বজনীনতার গুণে তার পাঠক ছিল নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলেই।
অন্য অনেক কিছুর মতোই অনেক আগে থেকেই সাহিত্য জগতও পুরুষশাসিত। সেখানে নারীদের লেখালেখি অনেকের জন্য যন্ত্রণাদায়কও বটে। .আঠারো শতকের শেষের দিকে গল্প পড়া–বিশেষ করে সেই লেখা যদি কোন নারীর হতো–তাহলে তা নারীদের জন্য মানসিক ও শারিরীকভাবে বিপদের কারণ হয়ে দেখা দিত। পরিস্থিতির উদাহরণ দিতে গেলে ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের বিখ্যাত দুই লেখিকা বোনের কথা বলা যেতে পারে, যারা ব্রন্টি সিস্টারস নামে সাহিত্য জগতে পরিচিত লাভ করেছেন; শুরুতে তারাও পুরুষের ছদ্মনামে লেখা প্রকাশ করতেন। প্রেম-ভালোবাসার গল্প রীতিমত নিষিদ্ধ এক বস্তু ছিল তাদের জন্য। ইংল্যান্ডে তখন বিদ্যমান ছিল এক কর্তৃত্বপূর্ণ সংস্কৃতি, নারীদের শিল্প-সাহিত্য চর্চা ছিল বিপজ্জনক। সেই পরিস্থিতি বদল হতে অনেক কাল লেগেছিল।
বর্তমানে প্রকাশক, বিক্রেতা ও সমালোচকরা কোন সাহিত্য কি ধরনের, তার জন্য শুরুতেই তারা একটি লেবেল বা মার্কা দিয়ে দেন; যাতে করে পাঠকরা সহজেই নির্দিষ্ট বইটি খুঁজে পেতে পারেন। যেমন একটি বইকে যদি “গোয়েন্দা গল্প” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে গোয়েন্দা বইয়ের পাঠকদের জন্য তা বিশেষভাবে সহায়ক হয়। প্রকাশক ও বই বিক্রেতারা এমন যুক্তিই তুলে ধরেন।
কোন সাহিত্য কি ধরনের, কোন কোন ক্ষেত্রে তার উপযোগিতা আছে এবং তা কোন শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হবে, সেগুলি নির্দিষ্ট করে দিলে জটিলতা কোথায়? সাধারণ চোখে এখানে জটিলতা না থাকলেও নারী লেখকদের লেখার ক্ষেত্রে এক প্রকার জটিলতা দেখা দিতে পারে। সাহিত্যকে শ্রেণিবিন্যাস করা ব্যাক্তির নিজস্ব সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে। তবে ‘নারী লেখকদের বই’–এমন শ্রেণিবিন্যাস করলে যে সাহিত্যকেই লিঙ্গের দ্বারা বিভাজন করা হয়। তাই সাহিত্যের ধরন নির্ধারন করার পরিবর্তে যদি নারী লেখকদের লেখাকে শুধুমাত্র “উপভোগ্য” হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে কেমন হয়?
আজ আমার বিংশ শতাব্দির পাঁচ নারী লেখকের উপন্যাস ও তাদের কথা বলবো। এই উপন্যাসগুলি এক একটি সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। নারী ও তার স্বাধীনতার ভিন্ন এক শিল্প।
আগাথা ক্রিস্টি, দ্য ম্যান ইন দ্য ব্রাউন স্যুট (১৯২৪)
এটি একটি গোয়েন্দা উপন্যাস। আন্না বেডিংফিল্ড উপন্যাসের একজন দুঃসাহসী চরিত্র। সে সব সময় বিপদ আছে, উত্তেজনা আছে এমন কাজ করতে পছন্দ করে। একদিন লন্ডনের এক রেল স্টেশনে আন্নার সামনেই এক ব্যক্তি মারা যায়।
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এই মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলে রায় দেয়। কিন্তু আন্না তাতে সন্তুষ্ট হতে পারে নি। কেননা, সে নিজ চোখে দেখেছে বাদামী কোর্ট পরিহিত এক ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির দেহ তল্লাশী করছিল। এই লোকটা কে? সে কেন পুলিশ দেখে দৌড়ে পালালো?
খুনের শিকার সেই ব্যক্তির পকেটে থাকা নোটবই আন্নার হাতে আসে। সেই সূত্র ধরে সে দক্ষিণ আফ্রিকায় আসে। সন্ধান পায় আন্তর্জাতিক এক অপরাধী চক্রের। অসাধারণ আত্মবিশ্বাস ও নৈপুন্যের সাথে সমস্ত রহস্য উদ্ঘাটন করে আন্না।
লুসি মড মন্টগোমারি, দ্য ব্লু ক্যাসল (১৯২৬)
উনত্রিশ বছর বয়সী ভ্যালান্সী একটি সনাতন-রক্ষণশীল পরিবারে থাকে। সে উপলব্ধি করে এই পরিবারে থাকলে সারা জীবনেও সুখী হতে পারবেনা। তাই ভ্যালান্সী পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে স্বল্প পরিচিত এক ব্যক্তির সাথে নির্জন একটি দ্বীপের কেবিনে এসে থাকতে আরম্ভ করলো। সেখানেই সে ভালোবাসা ও সুখের নুতন এক পৃথিবী আবিষ্কার করলো। রোমান্টিক এই গল্পটি কানাডার এক নির্জন বাঁধনহারা বুনো পরিবেশে দীর্ঘায়িত হয়েছে। উপন্যাসটি মন্টগোমারির প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য লেখা উপন্যাসগুলির মধ্যে অন্যতম।
মেরি স্টুয়ার্ট, নাইন কোচেস ওয়েটিং (১৯৫৮)
উপন্যাসের নায়িকা লিন্ডা মার্টিন, থাকেন ইংল্যান্ডে। গভর্নেসের চাকুরি নিয়ে প্যারিসে যান। সেখানে নয় বছরের এক এতিম বালকের দায়িত্ব নেন। বালকটির বাবা-মা দু’জনেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তখন পিতার অগাধ সম্পত্তি ও তার দেখা শুনার দায়িত্ব নেন বালকটির চাচা-চাচি। তারাই লিন্ডাকে বালক ফিলিপের দেখাশুনার জন্য নিয়োগ দেন। কিন্তু লিন্ডা বালক ফিলিপের দেখাশুনা করতে গিয়ে বহুমুখী সমস্যার মধ্যে আবদ্ধ হন। একদিকে, ফিলিপের চাচা লিওনের হাত থেকে নিজের সম্ভ্রম ও জীবন রক্ষা, অন্যদিকে, বালক ফিলিপকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র থেকে তাকে উদ্ধার করার দুরূহ সব ঘটনা নিয়ে উপন্যাসটি রচিত হয়েছে।
অক্টাভিও বাটলার, কিন্ড্রেড (১৯৭৯)
ইডানা ফ্রাঙ্কলিন হাসপাতালের বিছানায় জ্ঞান ফিরলে দেখে তার হাত ডাক্তাররা কেঁটে বাদ দিয়েছে। পুলিশ তাকে ও তার স্বামীকে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। ইডানা তাদেরকে জানালো, এটি স্র্রেফ একটি দুর্ঘটনা আর তার স্বামী কেভিন নির্দোষ। তারা দু’জনেই জানে সত্যি ঘটনা বললে তাদের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।
ইডানা একজন আফ্রিকান-আমেরিকান লেখক। হঠাৎ করেই সে একদিন অতীত কালে ফিরে যান। গৃহযুদ্ধ-পূর্ববর্তী মেরিল্যান্ড। ইডানা সেখানে তার পূর্বপুরুষদের দেখা পেলেন: তাদের মধ্যে একজন কালো নারী চাষী ও একজন শ্বেতাঙ্গ জমির মালিক ছিলেন। শ্বেতাঙ্গ জমির মালিক কালো নারীকে তার দাসী হতে বাধ্য করে। যেহেতু ইডানা অনেক সময় ধরে অতীতে ছিলেন, সেহেতু সেখানকার চাষীদের সাথে তার বেশ ঘনিষ্টতা তৈরী হয়। সে নিজেও দাস হিসেবে ক্ষেতে কাজ করে। দাসদের প্রতি অকথ্য নির্যাতন, তাদের দুর্দশার বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ইডানা এক সময় বর্তমানে ফিরে আসে। সেখানেও তার উপর শ্বেতাঙ্গ স্বামীর নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। উপন্যাসটিতে পুরুষতন্ত্র, ক্ষমতা এবং নির্যাতন ইত্যাদি বিষয়ের উপর গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের অবতারণা করা হয়েছে।
শির্লি জ্যাকসন, প্যাচওয়ার্ক গার্ল (১৯৯৫)
প্যাচওয়ার্ক গার্ল একটি ইলেকট্রনিক উপন্যাস। বর্তমান ডিজিটাল সাহিত্য’র গোড়ার দিককার অন্যতম একটি ই-বুক হিসেবে পরিচিত। বলা যায়, শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইন (১৮১৮) এবং বাউম-এর দ্য প্যাচওয়ার্ক গার্ল (১৯১৩)-এর একত্রিত পুনর্বিন্যাস। এখানে জ্যাকসন নারী দেহের বিভিন্ন অংশকে এক একটি টুকরো হিসেবে ছবির মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাধর্মী এই উপন্যাসটি মোট পাঁচটি ভাগে বিভক্ত। বইয়ের মাধ্যমে লেখিকা পাঠকদের শুধুমাত্র নারী দেহের জোড়াতালি দেয়া এক একটি অংশের সাথে পরিচয় করে দেন নি বরং নারী শরীরকে মানুষের শরীর হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে চেয়েছেন। জোড়াতালি দেয়া সমস্ত অংশ মিলেই যে নারীদের নিয়ে ডিজিটাল গল্প তৈরী হয়, তারও উপলব্ধি এনে দিয়েছেন।
বেশীরভাগ সময় নারী লেখকদের জনপ্রিয় উপন্যাসগুলির একধরনের বর্ণনামূলক ধারা থাকে, যা গোড়াতেই দৃশ্যমান থাকে। আর শেষের দিকে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি একজন রোমান্টিক সহযোগীর দেখা পায়। উপরের বইগুলিরও কিছু নারী চরিত্ররা এরকম করে। আবার কেউ কেউ তা করে না। যারা করে তাদের কাছে রোমান্স মূখ্য কোন বিষয় না। সেখানে নারীরা স্বাধীনভাবে নিজ জীবনের জন্য পছন্দ করেন। কেউ পছন্দ তাদের উপর চাপিয়ে দেয় না।
সবগুলি উপন্যাস যদি একত্রিত করা হয়, তাহলে দেখা যাবে এখানে নারীদের নিজেদের ইচ্ছা বা পছন্দের সমাবেশ ঘটেছে। তাদের মধ্যে কেউ একজন এ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে দুঃসাহসিক কাজে ঝাপিয়ে পড়েছে, কেউ নিজেকে যৌন স্বভাব ও লিঙ্গভিত্তিক প্রতিমূর্তি হিসেবে প্রকাশ করেছে, কেউ নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাস প্রথায় নারীর অবস্থা ও অবস্থানের সন্ধান করেছে, কেউ বা টুকরো টুকরো নারী শরীরের অংশ জোড়া লাগিয়ে নারীর শরীর সম্পর্কে সংস্কার ভাঙার চেষ্টা করেছেন।
নারীদের নিয়ে লেখা বা নারীদের লেখা আমাদেরকে কিছু ধারনা দেয় যে তারা বাস্তব জীবনে কতখানি চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। আবার এক একটি চ্যালেঞ্জ একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতিতে কি ধরনের প্রভাব ফেলে সে সম্পর্কেও বুঝতে সাহায্য করে। উপরের নারী লেখকরা এই কাজটিই সফলভাবে সমাধা করেছেন।
(ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় ২০১৮ সালে ১১ মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত Stacy Gillis-এর নিবন্ধ অবলম্বনে)
আর্টস বিভাগে প্রকাশিত বিপাশা চক্রবর্তীর আরও লেখা:
জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গম: অর্ধনারীশ্বর অথবা তৃতীয় প্রকৃতি
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: আইনস্টাইন, শেক্সপিয়র, আঁদ্রে গ্লুক্সমাঁ, ফের্নান্দো ও বিয়োরো
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতি
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতি: স্রোতের বিরুদ্ধে স্নোডেন, অরুন্ধতী, কুসাক
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতি: ভিক্টর হুগো ও টেনেসি উইলিয়াম
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: আরবমুখী ফরাসী লেখক ও মার্গারেটের গ্রাফিক-উপন্যাস
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: গত বছরের সেরা বইগুলো
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: নতুন বছরে নারীরাই রবে শীর্ষে
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতি: নতুন এলিয়ট, ব্যাংকসির প্রতিবাদ ও তাতিয়ানার রসনা
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য:চিরকালের শত শ্রেষ্ঠ
নারী দীপাবলী: তুমি হবে সে সবের জ্যোতি
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য:চিরকালের শত শ্রেষ্ঠ ননফিকশন
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: যাদুবাস্তবতার শাহেনশাহ মার্কেসের মানসিক গ্রন্থাগার
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য:ভাষারাজ্যের তীর্থযাত্রী ঝুম্পা লাহিড়ী ও টেন্টাকলের মার্গারেট এটউড
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: প্রত্যাখ্যাত রাউলিং ও পুনর্বাসনে লুইয এলিজাবেত ভিযে ল্য ব্রাঁ
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: রোবট লিখবে হাইব্রিড উপন্যাস?
সাম্প্রতিক শিল্পসাহিত্য: পানামা পেপার্স-এ চিত্রকলাও
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: বিজ্ঞানসচেতন শেক্সপিয়র
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: দ্য জাঙ্গল বুক-এর চোখধাঁধানো নতুন অলংকরণ
জাহা হাদিদ: আপোষহীন প্রতিভার অনন্য স্থাপত্য
সুর বাগিচার বুলবুলি, গান সায়রের মতি
আদিম লতাগুল্মময় শেকসপিয়রের নগ্ন প্রদর্শনী
ভিতরে বাইরে ছন্দোময় কবি মোহাম্মদ আলী
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: বিদায় রাবাসা, অজানা কাফকা ও শিল্পকর্মের উল্টোপিঠ
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতি: বিদায় আব্বাস, বিদায় বনফয়
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সর্বশেষ উপন্যাস ‘দূর হ শয়তানের দল’
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতি: নতুন তথ্যে আত্মঘাতী তিন খ্যাতিমান
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: নতুন হ্যারি পটার, পাঠের নতুন ধরন এবং ধনী লেখককুল
প্রত্যাখ্যাত ৮টি গবেষণার নোবেলজয়
ক্রিস্টোফার মার্লো শেক্সপিয়রের সহ-লেখক ছিলেন!
বুলবন ওসমানের সাক্ষাৎকার: কলকাতায় একবার বাঙালি মুসলিমরা হামলা করেছিল বাবাকে
কবি ইউসেফ কমুনিয়াকার কবিতা: মোকাবেলা
আন্তঃনাক্ষত্রিক সভ্যতার স্বপ্ন ও স্টিফেন হকিং-এর সেরা বইগুলো
অক্তাবিও পাস: আমি প্রেমে পড়ি আর ভারতে আমরা বিয়ে করি
Flag Counter
Flag Counter