ধর্মনিরপেক্ষতা মানুষের উপর প্রভাববিস্তারকারী বিশ্বাস ও চিন্তার ধরনগুলিকে ধর্ম থেকে একটি বিস্তৃত পটভূমিতে নিয়ে গেছে।
রেনেসাঁ শব্দের অর্থ ‘পুনর্জন্ম’ । অন্ধকার আর মধ্যযুগ এবং সেগুলির সাথে সম্পর্কিত ব্ল্যাক ডেথের কথা যদি উল্লেখ নাও করা হয়, তবুও বাকি সব অশান্তি ও স্থবিরতার পরে, ইউরোপ দুই’শ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ১৪০০ থেকে ১৬০০ সাল পর্যন্ত গণিত, দর্শন, জ্যোতিষশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, বিজ্ঞান এবং শিল্প-সাহিত্যে মস্ত এক পুনর্জাগণের সাক্ষী হয়।
রেনেসাঁ শিল্প বলতে রেনেসাঁ সময়কালের চিত্রকলা, স্থাপত্য এবং আলংকারিক কার্যকলাপকে বোঝানো হয়, যা সেই সময়ে একটি নিজস্ব শৈলী নিয়ে মূলতঃ ইউরোপে আবির্ভূত হয়। যদিও রেনেসাঁ শিল্পের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আধুনিক বিশ্বকে প্রভাবিত করেছে, তবুও এটি ছিল এমন একটা পর্যায় যা বিশ্বকে একটি আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার দিকে পরিচালিত করে যেখান থেকে মানুষ মানবতাবাদের দর্শনের অন্বেষণ শুরু করে।
রেনেসাঁ শিল্পের উৎস: ১৩০০-১৭০০
ছাপাখানার আবির্ভাবের ফলে, জ্ঞান এক হাজার বছরেরও বেশী সময় পরে প্রথমবারের মতো যাজক, অভিজাত, কুলীন আর রাজকীয়দের বাইরের মানুষের নাগালের মধ্যে চলে যায়।
রেনেসাঁ বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে। আর সেগুলি ছিল এমন ধরনের পরিবর্তন যা আজও আধুনিক বিশ্বকে প্রভাবিত করছে। প্রাসঙ্গিকতা ছিল সেই প্রভাবের মধ্যে অন্যতম। এটি বিশ্বকে উচ্চতর আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার একটি স্তরে নিয়ে গিয়েছিল। এই পর্যায়ে পৌঁছেই মানুষ তার মানবতাবাদের দর্শন অন্বেষণ করতে শুরু করে। সেই সময় গ্রীস ও রোমের ধ্রুপদী যুগের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়া হয়েছিল, যেটি রেনেসাঁর আগ পর্যন্ত মানুষের কৃতিত্বের শিখর বা শৃঙ্গ বলে বিবেচ্য ছিল।
রেনেসাঁ শিল্প- পুনরুজ্জীবন এবং সৃজনশীলতার সময়কাল
নতুন করে জন্ম নেয়া আবেগ মানুষকে শেখার জন্য এবং কিছু একটা অর্জনের জন্য প্রবলভাবে তাড়িত করে। তখন শুরু হয় মানুষের গবেষণা। আর এই সমস্ত গবেষণাই কিন্তু বৃহত্তর শিল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে থাকে। রেনেসাঁ ছিল সেই বৃহত্তর শিক্ষা এবং কৌতূহলের একটি সময়, যা অনেক শিক্ষার্থী ও শিল্পীকে শিল্পের নতুন ধারা বিকশিত করতে সাহায্য করেছিল।
* ইতালির ফ্লোরেন্সই ছিল রেনেসাঁর আঁতুড় ঘর এবং সেই কারণেই মূলতঃ অনেক নিয়ম-শৃঙ্খলা ইতালিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
* রেনেসাঁ সময়কালে মানবতাবাদী শক্তি আধিপত্য বিস্তার করেছিল আর সে কারণেই গির্জা শিল্পীদের প্রকল্পগুলির “পৃষ্ঠপোষক” হতে চেয়েছিল।
* উচ্চ শিক্ষার জন্য গির্জার পৃষ্ঠপোষকতা আর চিত্রকর্মের জন্য ধনী ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের ফলে গির্জা এবং শিল্পীদের সাথে জড়িত সৃজনশীল উদ্যোগগুলি বেড়ে যায়।
* বিশ্ব যে পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল সে ক্ষেত্রে রেনেসাঁ শিল্প-সহায়ক ছিল। রেনেসাঁ শিল্পের যে পাঁচটি বৈশিষ্ট্য বিশ্বের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করেছিল, তা এখানে উল্লেখ করা হল।
১. শেখা ও অন্বেষণের জন্য ইতিবাচক ইচ্ছা
প্রযুক্তির সূচনা এবং নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে শিল্পী ও শিক্ষার্থীদেরকে আরও বেশী অনুসন্ধিৎসু করে তোলে। পশ্চিমা দুনিয়া যখন যুগপৎ আবিষ্কার ও উদ্ভাবন দেখেছিল, তখন ইতালির শিল্পীরা বিশ্ব ও প্রকৃতির সমস্ত সম্ভাব্য দিকগুলি অন্বেষণ করতে আরও বেশী আগ্রহী হয়ে ওঠে।
নবরীতির স্থাপত্য, ভাস্কর্য এবং চিত্রকলার আবিষ্কারের পাশাপাশি ইউরোপে তখন নতুন সমুদ্রপথ, মহাদেশ উপনিবেশও শামিল হয়েছিল। তারা বিশ্বাস করত যে, ধ্রুপদী পুরাকালের পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে সেই যুগের অনেক মূল্যবান ও আদর্শিক মানের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
২. মানুষের মর্যাদা ও মানবতাবাদে বিশ্বাস
রেনেসাঁর পূর্বে মানবতাবাদের এক নতুন জাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল যা রেনেসাঁর উত্থানে ব্যাপক অবদান রেখেছিল। সেই মানবতাবাদকে বলা হয় ‘রেনেসাঁ মানবতাবাদ বা মানবধর্ম’ । উল্লেখ্য, এই মানবতাবাদ কিন্তু প্রচলিত মানবতাবাদের মতো নয়।
মানবতাবাদ ছিল রেনেসাঁ যুগের একটি প্রধান শাখা এবং বৈশিষ্ট্য। যদিও রেনেসাঁ যুগের মানবতাবাদ ছিল একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন যা তের শতকের দিকে শুরু হয়েছিল। তখন দর্শনের প্রধান আদর্শটি শাস্ত্রীয় গ্রন্থের অধ্যয়ন এবং অপরাপর সমসাময়িকদের দ্বারা এই ধ্রুপদী চিন্তাধারার পরিবর্তনের চারপাশে আবদ্ধ ছিল। পনের শতকের দিকে, রেনেসাঁ মানবতাবাদ শিক্ষার প্রধান রূপ হয়ে ওঠে। এটি এত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল যে সেটি উন্নয়নের নানা পরিসরে বিবেচিত হয়েছিল। ফ্রান্সিসকো পেত্রার্ক(১৩০৪-১৩৭৪) কে ইতালীয় মানবতাবাদের জনক হিসেবে গণ্য করা হয়, দর্শনে তার অবদান ছিল বিশাল।
রেনেসাঁ মানবতাবাদ রেনেসাঁ রাজত্বের জন্য অত্যন্ত সহায়ক ছিল। সেই সময়ে এটির যেমন জনপ্রিয়তা ছিল তেমনি ছিল প্রাধান্য। এবং সেই প্রভাব এতটাই তীব্র ছিল যে গীর্জাকে পর্যন্ত এই মানবতাবাদকে সমর্থন, এমনকি “পৃষ্ঠপোষকতাও” করতে হয়েছিল।
মানবতাবাদীদের মধ্যে একটি অভিন্ন ধারণা ছিল যে ঈশ্বর মানুষকে অনেক সম্ভাবনা এবং ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাদের সেরাটি পেতে হলে নিজেকে মর্যাদা দিতে হবে এবং যথাযথভাবে সম্মান করতে হবে। সে কারণে তারা অনুভব করেছিল, তাদের এই বিশ্বাসের উপর কাজ করার এবং এটির সর্বোচ্চ ব্যবহার করার দায়িত্ব রয়েছে।
মানবতাবাদের মাধ্যমে, শিল্পকর্ম বিশেষভাবে গির্জার সমর্থন উপভোগ করেছিল। গির্জা সে সময় সৃজনশীল উদ্যোগ ও শিক্ষাকে অর্থায়ন এবং পৃষ্ঠপোষকতা করতে শুরু করেছিল। পাশাপাশি, ধনী রাজপরিবারগুলিও পৃষ্ঠপোষকতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল। তারা শিল্পীদের চিত্রগুলির জন্য সর্বদা উচ্চমূল্যের একটি বাজার প্রস্তুত রেখেছিল।
এভাবে, বুদ্ধিজীবী, কারিগর এবং সাধারণ মানুষ একটি উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে, চার্চ কখনই ঈশ্বর ও তার প্রেরিত পুরুষদের প্রতি তাদের বিশ্বাস এবং আচরণের জন্য দায়ী ছিল না। তারা নিজেরাই নিজেদের কর্মের জন্য দায়ী।
তাছাড়া, ধর্ম এবং মানবতাবাদের মধ্যে সমান্তরাল দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার করা হয়েছিল এবং আত্ম-গুরুত্ব সম্পর্কিত সম্মানের বিষয়ে চিন্তা করা হয়েছিল। গোজোলির আঁকা ‘পবিত্র ভূমির উদ্দেশ্যে সঙ্গীদলের সাথে ম্যাগির শোভাযাত্রার’ চমৎকার চিত্রটিতে ধার্মিক মুখের চেয়ে রাজকীয় মুখেরই বেশী সন্ধান পাওয়া যায়।
৩. রৈখিক দৃষ্টিভঙ্গির আবিষ্কার এবং আয়ত্ত
গণিত এবং অনুপাতের পুনরুজ্জীবন মানুষকে দুটি প্রধান পদ্ধতি উদ্ভাবনের দিকে ধাবিত করে। সেগুলির একটি হল রৈখিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহার আরেকটি হল অদৃশ্য বিন্দুর প্রবর্তন। এটিকে নবজাগরণ শিল্পের অন্যতম বৈপ্লবিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি সৃষ্টি করেছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত স্থপতি ফিলিপ্পো ব্রুনেলেসচি। তিনি সমান্তরাল রেখা ব্যবহার করে একটি রৈখিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে গণিতের উদ্ভাবনগুলি ব্যবহার করেছিলেন। তাছাড়া শিল্পে স্থান এবং গভীরতাকে বাস্তবসম্মতভাবে চিত্রিত করার জন্য একটি দিগন্তরেখা, একটি অদৃশ্য বিন্দু ব্যবহার করতেন।
যেহেতু চিত্রকলা একটি দ্বি-মাত্রিক কার্যকলাপ, তাই রৈখিক দৃষ্টিভঙ্গির আবির্ভাব অর্থাৎ বিষয়বস্তুর উচ্চতা, দৈর্ঘ্য, গভীরতা, অবস্থান ও দূরত্ব অনুযায়ী চিত্রাঙ্কনবিদ্যা চর্চার মাধ্যমে সেটির একটি ত্রি-মাত্রিক চেহারা দেয়া সম্ভব হয়েছে।
এটি সাধন করার জন্য, শিল্পীরা দৃষ্টির সমান্তরাল একটি দিগন্তরেখা নিতেন এবং সেটিতে একটি অদৃশ্য বিন্দু চিহ্নিত করতেন। পরবর্তীতে মুছে ফেলা যায় এমন ছককাটা চৌখুপী সৃষ্টি করে যার রেখাগুলি সেই অদৃশ্য বিন্দুতে মিলিত হতো। এটি দূরত্ব এবং গভীরতার একটি অনুভূতি সৃষ্টি করতো।
এভাবে অবিরাম অনুশীলনের মাধ্যমে, শিল্পীরা তাদের চিত্রগুলিতে একটি ত্রি-মাত্রিক প্রভাব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শুধুমাত্র রৈখিক পরিপ্রেক্ষিতেই যে শিল্প তখন একটি উচুঁ স্তরে প্রবেশ করেছিল তা কিন্তু না। সেই সাথে যোগ হয়েছিল শিল্পীর প্রশংসাযোগ্য চিত্রিত করার সক্ষমতা। তারা অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে অলীক স্থানে বাস্তব চরিত্র বা প্রতীককে ফুটিয়ে তুলেছেন।
এই অগ্রগতির পিছনে মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনটি গাণিতিক গ্রন্থের লেখক এবং একজন বিস্ময়কর শিল্পী পিয়েরো ডেলা ফ্রান্সেসকা। দৃষ্টিভঙ্গি (দ্বিমাত্রিক শিল্পকর্মে ত্রিমাত্রিক বস্তু বা স্থানের উপস্থাপনা), চিত্রকলা এবং চিত্তাকর্ষক চরিত্র অঙ্কনে তিনি অসাধারণ কৌশল ও সূক্ষ্মতা দেখিয়েছেন। তার কাজের এমন একটি ক্লাসিক উদাহরণ হল ‘দ্য ফ্ল্যাগেলেশন অব ক্রাইস্ট।’
৪. প্রকৃতিবাদের পুনর্জন্ম
এটি রেনেসাঁ শিল্পের আরেকটি বৈশিষ্ট্য যা বিশ্বের ধাঁচের পরিবর্তন এনেছে।
সেই সময়ে, শরীরবৃত্তীয় অঙ্গক এবং চিত্রকলার জাগরণ হয়েছিল। ইতালীর রেনেসাঁ শিল্পী – লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এই ধারার পথপ্রদর্শক ছিলেন। তিনি দেহকে অঙ্কন এবং চিত্রায়িত করার ক্ষেত্রে আঁকা শরীরবৃত্তীয় পরিমাপের নিপূনতার মানদন্ড নির্ধারণ করেন। মানবদেহকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বোঝার জন্য তিনি এটির উদ্ভব করেছিলেন। তাঁর অনুসন্ধিৎসু মনের বাসনা পূরণের জন্য তিনি অন্তত ২০টি মানবদেহ ময়নাতদন্ত করেছিলেন। এরপর তিনি মানুষের দেহ পর্যবেক্ষণ করে যা দেখেছিলেন, যেভাবে দেখেছিলেন, সেভাবেই একেঁছিলেন। মানুষের শরীরের হাড়ের গঠন, পেশী এবং বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্বন্ধে তার অর্জিত শরীরবৃত্তীয় জ্ঞানও তার নিজ অঙ্কনশিল্পে প্রয়োগ করেন। ইতালীর রেনেসাঁ শিল্পীরা জটিল দৃশ্যের বিষয়-বস্তুসমূহকে এমনভাবে সমন্বিত করেছেন যে যা একটি বিস্তৃত দৃষ্টিকোণের সৃষ্টি করে এবং শিল্পকে সমৃদ্ধ অথবা মূল্যবান করে তোলে। অঙ্কিত চিত্রশিল্পগুলির প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য তারা কার্যকরভাবে আলো-আঁধারি আর বিভিন্ন মাত্রার প্রয়োগ করেছেন।
লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে একজন বিজ্ঞানীর পাশাপাশি শিল্পী হিসেবেও বিবেচনা করা হতো। মানুষের পেশী কীভাবে ত্বকের নীচে থাকে তা দেখার জন্য ভিঞ্চি এবং মাইকেলেঞ্জেলো প্রায় সময়ই মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে দেখতেন।
মধ্যযুগীয় দিনগুলিতে মানুষ মনে করতো, মানবদেহ হল পাপপূর্ণ, দুর্গন্ধময় এবং জঘন্য, সে কারণে এটি সবসময় ত্বক দিয়ে আবৃত থাকে। কিন্তু তারপর, রেনেসাঁ সময়কালে, সেই ধারণার পরিবর্তন ঘটে। রেনেসাঁর চিন্তাবিদরা মানবদেহকে একটি সুন্দর জিনিস মনে করতেন। প্রকৃতপক্ষে, তারা এটিকে ঈশ্বরের এই মহাবিশ্বের একটি মডেল হিসেবে দেখতে শুরু করেন।
১৪৮৭ সালে ভিঞ্চির আকাঁ “ভিট্রুভিয়ান ম্যান” যার অর্থ “সার্বজনীন মানব”- এ তিনি প্রকাশ করেন কীভাবে একটি হাত-পা প্রসারিত মানব একটি নিখুঁত বৃত্তে এঁটে যায় এবং এটি তিনি একটি নিখুঁত বর্গক্ষেত্রে প্রসারিত বাহু এঁকে করেছিলেন।
এদিকে, মাইকেলেঞ্জেলোর নগ্ন মূর্তি, “ডেভিড” মানবদেহের প্রতি রেনেসাঁর মুগ্ধতার একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এটির মাধ্যমে তিনি যে বিশ্বাস তুলে ধরেন তাহলো মানবদেহ হল ঈশ্বরের সৃষ্টির সেরা কর্ম। তার “লাস্ট জাজমেন্ট” চিত্রে তিনি অনেক নগ্ন চরিত্র এঁকেছিলেন। সিস্টিন চ্যাপেলের দেয়ালে তিনি এটি করেছিলেন। কিন্তু কাজটি সম্পন্ন হবার কিছুদিন পর, ভ্যাটিকানের কর্তারা তার শিল্পকর্মের নগ্ন দেহে শালীন পোশাক চড়ানোর জন্য অন্য একজন চিত্রশিল্পীকে নিয়োগ করেন।
ধর্মনিরপেক্ষতা
ধর্মনিরপেক্ষতা: এটা হল রেনেসাঁর শেষ বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া এটি একটি দরকারী শক্তিও ছিল বটে। ধর্মনিরপেক্ষতা মানুষের উপর প্রভাববিস্তারকারী বিশ্বাস ও চিন্তার ধরনগুলিকে ধর্ম থেকে একটি বিস্তৃত পটভূমিতে নিয়ে গেছে। এই সময় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের মতো চর্চায় মানুষ মনোনিবেশ করে। রেনেসাঁ শিল্পীরা তখন অ-ধর্মীয় বিষয় আঁকতে শুরু করেন। উল্লেখ্য যে, গোটা মধ্যযুগীয় শিল্প একচেটিয়াভাবে ধর্মীয় আবহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
মধ্যযুগে, বেশীরভাগ লোক বিশ্বাস করত যে, পৃথিবী ১০০০ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়ে যাবে, তাই তাদের কাছে অন্য কোনও শিল্প অসঙ্গত মনে হয়েছিল।
রেনেসাঁ শিল্প ধর্মীয় বিষয় এবং বাইবেলের চরিত্রগুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল। তাই ধীরে ধীরে এই প্রবণতা ধর্মীয় নয়–এমন দৃশ্যের চিত্রকলার দিকে সরে যেতে থাকে।
রেনেসাঁ যুগের প্রথম দিকের অ-ধর্মীয় বিষয়বস্তুর উদাহরণগুলির মধ্যে একটি ছিল ভ্যান আইকের বৈপ্লবিক শিল্পকর্ম “আর্নলফিনি ম্যারেজ”। জ্যান ভ্যান আইক এই চিত্রশিল্পের মাঝে পিছনের দেয়ালে একটি আয়না যুক্ত করে তার কর্মের গভীরতা ও প্রতিফলন সৃষ্টি করেন। এভাবে, যে সকল মানুষ চিত্রটি দেখেছিল, তারা সেই দৃশ্যের মাঝে নিজেদের প্রতিফলন খুঁজে পেয়েছিল।
এই সময়কালে ধ্রুপদী রোমান সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহও পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। তখন রেনেসাঁ এমনসব চিত্রকর্ম সামনে নিয়ে আসে যেগুলি প্রায়শই গ্রীক এবং রোমান পুরাণের দৃশ্যগুলি তুলে ধরেছিল। গ্রীক ও রোমান সংস্কৃতির পুনর্জন্মের অন্যতম আরেকটি প্রমাণ ছিল ঐ সময়ের ভাস্কর্যের পুনরুজ্জীবন।
ক্লাসিক্যাল সময়ে, শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলি মূর্তি এবং ভাস্কর্যে পূর্ণ ছিল। কিন্তু রেনেসাঁর সময়, ক্লাসিক্যাল সংস্কৃতিকে পুনঃআবিষ্কার করতে মানুষের প্রত্নতত্ত্বের প্রতি আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল। রোমে প্রথম শতাব্দিতে খোদাই করা লাওকুনের আবিষ্কারের সময় মিকেলেঞ্জেলো বর্তমান ছিলেন।
মিকেলেঞ্জেলো শুধুমাত্র একজন চিত্রশিল্পীই ছিলেন না, তিনি একজন মহান প্রতিভাধর ভাস্করও ছিলেন। তিনি রোমের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার গম্বুজের স্থপতি হিসেবেও কাজ করেছেন। আর এই গির্জাটিই পৃথিবীর বৃহত্তম গির্জা হিসেবে প্রশংসা কুড়ায়।
সর্বশেষ ভাবনা
উপসংহারে, বিশ্ব আজ যেভাবে গঠিত হয়েছে সেটির উপর রেনেসাঁ শিল্প আমলের বিভিন্ন পর্যায়ের অসীম প্রভাব রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন এবং বিকাশের সেই সময়ের পরে যে সকল চিত্রশিল্পী ও ভাস্কররা এসেছেন, তারা সকলে নতুন নতুন প্রবণতার প্রতি ঝুঁকেছেন। এমনকি, আরও ভাল ডিজাইন এবং শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেছেন। এরপর, সময়ের সাথে সাথে – উদ্ভাবনগুলি এগিয়ে গেছে এবং প্রতিটি উত্তর প্রজন্মের সাথে জ্ঞান আরও পরিমার্জিত হয়েছে।
পূর্ববর্তী প্রজন্মের তালিম, শিক্ষনীয় বিষয় এবং উদ্ভাবন নতুনদেরকে শিল্প সাফল্যের প্রতি তৃষ্ণা বাড়িয়ে দেয়। এভাবে নতুন প্রজন্ম তাদের নিজস্ব সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, যা তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে এবং নতুন নতুন আবিষ্কারে অবদান রাখতে সাহায্য করে।
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এবং মাইকেলেঞ্জেলোর মতো প্রতিভারা তাদের অনুসন্ধান এবং উদ্ভাবনের সাহায্যে শিল্পক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। সেই সময়ে স্থাপত্যের মতো দক্ষতার অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিও উন্নতির ধারা থেকে বাদ যায়নি। এভাবে, স্থাপত্য এবং চিত্রকলা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ফয়সালার স্বাদ লাভ করেছে। রেনেসাঁ পর্যায়ের স্থাপত্য, বিগত শতাব্দির সমস্ত সুন্দর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ডিজাইনগুলির আরও বেশী উত্থান ঘটায়। সেই সময়ের ভক্তিমূলক বস্তু হিসেবে দেখা চিত্রকর্মগুলি এখনও শিল্পের মহান কাজ হিসেবে শোভা পায়।
কোন সন্দেহ নেই, রেনেসাঁ শিল্পের রীতিনীতি বর্তমান পৃথিবীর নানা দেশে প্রচুর অবদান রেখেছে। এটি আমাদের নীতি এবং আদর্শ শিখিয়েছে। এবং আজকের বিশ্বে আমাদের জীবনযাত্রার ধরন এবং নিদর্শনগুলিকে দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করে যাচ্ছে ও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তা এগিয়ে যাচ্ছে।
The artist পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ অবলম্বনে