তবে সময়কাল এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় তার মৃত্যুতে আরও ভয়ংকর কিছু ছিল কিনা তা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে সন্দেহ তৈরি হয়ে আছে।
আলোকচিত্র: ১৯৭১ সালে প্যারিসে নেরুদা
আলোকচিত্র: রাজনৈতিক সহযাত্রী সালবাদর আইয়্যেন্দের সাথে পাবলো নেরুদা
দীর্ঘ এক দশক তদন্তের পর, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের একটি দল কবর থেকে তোলা চিলির নন্দিত কবি পাবলো নেরুদার দেহাবশেষ বিষয়ে একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কেন তার মৃত্যু ঘিরে এত প্রশ্ন? চলুন প্রিয় পাঠক একটু অতীতে ফিরে যাওয়া যাক।
পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও ১৯৭৩ সালে অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে চিলির কবি পাবলো নেরুদার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ সারা পৃথিবীর সামনে এখনও অস্পষ্ট হয়ে রয়ে গেছে।
এই নোবেলবিজয়ী শুধুমাত্র পৃথিবীর অন্যতম একজন খ্যাতনামা কবিই ছিলেন না, চিলির একজন প্রভাবশালী সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীও ছিলেন। একজন স্পষ্টভাষী কমিউনিস্ট, তিনি ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত চিলির বামপন্থী রাষ্ট্রপতি সালভাদর আইয়্যেন্দের সমর্থক ছিলেন। এবং তার প্রশাসনিক কাজে যুক্ত ছিলেন।
অভ্যুত্থানের সপ্তাহ দুয়েকের ব্যবধানে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে নেরুদার মৃত্যু হয়। ক্যান্সারের ফলাফল হিসেবে এই মৃত্যু হয়েছিল বলে সেসময় নির্ধারিত হয়েছিল। তবে সময়কাল এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় তার মৃত্যুতে আরও ভয়ংকর কিছু ছিল কিনা তা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে সন্দেহ তৈরি হয়ে আছে।
অতিসম্প্রতি, যে আন্তর্জাতিক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দল নেরুদার দেহাবশেষ পরীক্ষা করেছেন তারা এক পৃষ্ঠার একটি ফলাফল প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা জানান তারা নেরুদার দেহাবশেষে ব্যাকটেরিয়া সনাক্ত করেছেন যা মারাত্মক হতে পারে। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন যে তিনি মারা যাওয়ার সময় তার শরীরে ব্যাকটেরিয়া ছিল। তবে তারা বলেছে তারা এই পার্থক্যটি করতে পারেন নি যে এটি ব্যাকটেরিয়ার একটি বিষাক্ত স্ট্রেন ছিল কিনা কিংবা এটি ইনজেকশনের মাধ্যমে তার শরীরে প্রবেশ করেছিলো কিনা অথবা দূষিত খাবার খাওয়ার ফলে হয়েছিলো কিনা।
এই ফলাফলটি আবারো এই প্রশ্নটি সামনে নিয়ে আসে–নেরুদাকে কি হত্যা করা হয়েছিল ?
পাবলো নেরুদা কে ছিলেন?
নেরুদা ছিলেন চিলির একজন আইনপ্রণেতা, কূটনীতিক এবং নোবেলবিজয়ী কবি। তাকে লাতিন আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদের একজন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭০ সালে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি সালবাদর আইয়্যেন্দের উত্থানের আগ পর্যন্ত চিলির বামপন্থী আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র ছিলেন।
১৯০৪ সালের ১২ জুলাই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষিণ চিলির একটি ছোট কৃষিপ্রধান জনগোষ্ঠী পারলালে বেড়ে ওঠেন। স্কুল শিক্ষিকা মা তার জন্মের পরপরই মারা যান। বাবা ছিলেন একজন রেলওয়ে কর্মচারী যিনি তার সাহিত্যিক হবার আকাঙ্ক্ষাকে পছন্দ করতেন না। তারপরেও নেরুদা ১৩ বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করেন।
জীবদ্দশায় নেরুদা ভারত, মিয়ানমার, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, স্পেন এবং ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি যেমন কবিতায় সক্রিয় ছিলেন একইভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও নিয়োজিত ছিলেন।
নেরুদা চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোর একটি ক্লিনিকে ৬৯ বছর বয়সে মারা যান। এর মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে নেরুদার বন্ধু ও রাজনৈতিক মিত্র সালবাদর আইয়্যেন্দের মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যু ঠিক নয়, আইয়্যেন্দে সামরিক বাহিনীর কাছে আত্মসমপর্ন এড়াতে আত্মহত্যা করেন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে তার সরকারের পতন হয়।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে কেমন ছিলেন নেরুদা?
একজন কূটনীতিক হিসেবে বার্সালোনায় থাকাকালে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেরুদাকে আরো বেশি ব্যস্ত রাজনৈতিক অবস্থানে ঠেলে দেয়। পরে তিনি লিখিছিলেন “ তারপর থেকে, আমি নিশ্চিত হয়েছি যে কবির কর্তব্য হচ্ছে তার অবস্থান বুঝে নেয়া”।
স্পেনে থাকার সময় নেরুদা স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। তিনি রিপাবলিকানদের সমর্থক হয়ে ওঠেন, ফলে তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে রিপাবলিকানরা জাতীয়তাবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তখন নেরুদা ফ্রাঙ্কোর একনায়কতন্ত্রের শাসন থেকে পালিয়ে আসা হাজার হাজার শরণার্থীকে বাঁচাতে কাজ করেছিলেন।
কমিউনিস্ট পার্টির আজীবন সদস্য নেরুদা মাত্র এক মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। একজন সিনেটর হিসেবে তিনি প্রেসিডেন্ট গাব্রিয়েল গনসালেস বিদেলার সরকারের সমালোচনা করেছিলেন। বিদেলা ১৯৪৬ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত চিলি শাসন করেছিলেন। সমালোচনার জেরে নেরুদাকে চার বছরের জন্য জোরপূর্বক নির্বাসনে পাঠানো হয়।
তিনি ১৯৫২ সালে দেশে ফিরে আসেন। একজন বামপন্থী সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য সালবাদর আইয়্যেন্দের প্রচারণাকে সমর্থন জানান। কিন্তু সেবার এবং পরে আরো দুটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৭০ সালে নেরুদা চিলির রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থিতার জন্য মনোনীত হয়েছিলেন কিন্তু তিনি আইয়্যেন্দেকে সমর্থন দিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। এবারের প্রচেষ্টায় আইয়্যেন্দে নির্বাচনে জয় লাভ করেন। আইয়্যেন্দে ১৯৭০ সালে চিলির প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি হিসেবে অভিষিক্ত হন।
কেন তিনি এত গুরুত্বপূর্ণ?
নেরুদা তার কবিতা এবং রাজনৈতিক সক্রিয়তার জন্য বিশ শতকের লাতিন আমেরিকার অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তার রাজনৈতিক সক্রিয়তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বিদেশে মার্কিন হস্তক্ষেপের সমালোচনা, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের নিন্দা করা এবং চিলির কমিউনিস্ট পার্টিকে সমর্থন করা। তার বই ৩৫টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
যাইহোক, এতকিছুর পরেও বিতর্ক নেরুদার পিছু ছাড়েনি। হাইড্রোসেফালাস নিয়ে জন্মগ্রহণ করা তার কন্যাকে অবহেলা করেছিলেন। কন্যাশিশুটি ১৯৪৩ সালে মাত্র আট বছর বয়সে মারা যায়। সম্প্রতি তার স্মৃতিকথায় একজন পরিচারিকাকে যৌন নিপীড়নের বর্ণনার আলোকে তাকে নতুন করে বিতর্কের কেন্দ্রে আনা হয়েছে।
সমসাময়িকচিত্রকর্মে পাবলো নেরুদা
তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ কী?
নেরুদা ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখক যিনি কবিতা ও গদ্য মিলিয়ে ৫০টিরও বেশি বই প্রকাশ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে রোমান্টিক কবিতা থেকে চিলির রাজনীতিবিদদের দুর্বৃত্তপনার প্রকাশ এবং গৃহযুদ্ধে জর্জরিত স্পেনের যন্ত্রণার প্রতিফলন। সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য তার উদ্যমী সক্রিয়তা এবং কবিতার বিস্তৃত অংশ বিশ্বব্যাপী প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এসবই তাকে লাতিন আমেরিকায় বিশ শতকের একজন বুদ্ধিজীবী আইকনে পরিণত করেছে।
১৯২৩ সালে ১৯ বছর বয়সে তার প্রথম বই “Crepusculario” বা “Book of Twilight” প্রকাশ করেন এবং পরের বছর তিনি “Veinte Poemas de Amor y una Canción Desesperada” (20 Poems of Love and A Song of Despair) প্রকাশ করেন। এই সংকলনটি তাকে একজন প্রধান কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং প্রায় এক শতাব্দী পরেও এটি স্প্যানিশ ভাষায় সবচেয়ে বেশি বিক্রিত কবিতার বই।
একজন কূটনীতিক হিসাবে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তার কাজকেও প্রভাবিত করেছিল, যেমন ” Residencia en la Tierra” (মর্তের এই বাসভূমি) শিরোনামের কাব্যগ্রন্থে। এবং কমিউনিজমের সাথে তার সংযোগ “Canto General” (সাধারণ গান) বইতে স্পষ্ট ছিল যেখানে তিনি হিস্পানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমেরিকার ইতিহাস বলেছেন।
কিন্তু কমিউনিজমের প্রতি তার ঝোঁক নোবেল পুরস্কার পাওয়াকে বিলম্বিত করে থাকতে পারে। তার সামগ্রিক কাজের জন্য ১৯৭১ সালে এসে তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। পুরস্কারের ওয়েবপৃষ্ঠা অনুসারে, তিনি “এমন একটি কবিতা সৃষ্টি করেছেন যা একটি মৌলিক শক্তির ক্রিয়া দ্বারা একটি মহাদেশের ভাগ্য এবং স্বপ্নকে জীবন্ত করে তোলে”।
তার মৃত্যুকে ঘিরে বিতর্কটি কী?
চিলির অভ্যুত্থানের পর, লাতিন আমেরিকার অন্যতম সহিংস সেনারা নেরুদার সম্পত্তিতে অভিযান চালায়। মেক্সিকান সরকার তাকে এবং তার স্ত্রী মাতিলদে উররুতিয়াকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু প্রস্টেট ক্যান্সারের জন্য তাকে চিলির সান্তা মারিয়া ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়।
১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ক্লিনিক জানায় যে জনাব নেরুদা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। আগের দিন, তিনি তার স্ত্রীকে ফোন করেছিলেন, যে তিনি কিছু ওষুধ গ্রহণ করার পরে অসুস্থ বোধ করছেন।
২০১১ সালে, মানুয়েল আরাইয়া, সেই সময়ে নেরুদার ড্রাইভার ছিলেন, তিনি প্রকাশ্যে দাবি করলেন যে ক্লিনিকের ডাক্তাররা তাকে বিষ প্রয়োগ করেছিল, তার পেটে একটি অজানা পদার্থ ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করিয়ে। আরো বলেন যে নেরুদা নিজেই মৃত্যুর আগে এটি তাকে বলেছিলেন। যদিও তার বিধবা স্ত্রীসহ অন্য সাক্ষীরা এই গুজব উড়িয়ে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে, নেরুদা ক্যান্সারে মারা গেছেন–এই দাবীকেও কেউ কেউ চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।
অভিযোগগুলি অবশেষে একটি আনুষ্ঠানিক তদন্তের দিকে এগিয়ে যায়। ২০১৩ সালে, একজন বিচারক কবির দেহাবশেষ উত্তোলন এবং নমুনা ফরেনসিক জেনেটিক্স ল্যাবরেটরিতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ও চিলির বিশেষজ্ঞরা সাত মাস পর প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী তার মৃত্যুতে বিষ প্রয়োগের কথা নাকচ করে দিয়েছেন। অনুসন্ধানে বলা হয়েছে যে সেখানে “প্রাসঙ্গিক রাসায়নিক এজেন্ট” উপস্থিত নেই যা জনাব নেরুদার মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত হতে পারে এবং “কোনও ফরেনসিক প্রমাণ নেই” যা প্রস্টেট ক্যান্সার ছাড়া মৃত্যুর কারণ নির্দেশ করতে পারে।
তবুও ২০১৭ সালে, ফরেনসিক তদন্তকারীদের একটি দল ঘোষণা করে যে জনাব নেরুদা ক্যান্সারে মারা যাননি এবং তারা নেরুদার চর্বন দন্তের একটিতে সম্ভাব্য বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়ার চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন। তদন্তকারীরা তার ফলাফলগুলি আদালতে হস্তান্তর করে। এবং আদালত থেকে তাদের ব্যাকটেরিয়ার উৎস নির্ধারণের চেষ্টা করতে বলা হয়।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ তারিখে একজন বিচারকের কাছে দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সেই বিজ্ঞানীরা জানান যে অন্যান্য পরিস্থিতিগত প্রমাণগুলি হত্যার তত্ত্বকে সমর্থন করে। এর মধ্য রয়েছে ১৯৮১ সালে তৎকালীন সামরিক স্বৈরাচার সরকার বন্দীদের বিষ প্রয়োগ করেছিলো যে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা তা নেরুদার দেহাবশেষে পাওয়া ব্যাকটেরিয়ার স্ট্রেনের অনুরূপ। কিন্তু তারা জানান যে, আরো প্রমাণের অভাবে তারা নেরুদার মৃত্যুর কারণ নির্ধারণ করতে পারেনি।
তথ্যসূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস