“কাহা দে লাস লেত্রাস” –মানে ‘শব্দের তোষাখানা’। পুরোনো মাদ্রিদ শহরের ব্যাংকের ভল্টের ভেতরে সংক্ষরিত স্প্যানিশ সাহিত্য ভান্ডার! মাদ্রিদ শহরে পুরোনো গ্রিক শৈলীতে নির্মিত এই ভবনের গভীরে একটি ভূর্গভস্থ ভান্ডার রয়েছে। এখানে আছে স্প্যানিশ সাহিত্যের সবচেয়ে বড় ভান্ডার। ভবনটি সের্বান্তেস ইনস্টিটিউটের সদর দপ্তর। অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপি স্প্যানিশ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রচারে কাজ করে। স্প্যানিশ ভাষায় প্রথম উপন্যাস দন কিহোতের লেখকের নামে নামরকরণ করা হয়েছে এর। ১৯৯১ সালে স্পেন সরকার সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করে। ২০০৬ সাল থেকে মাদ্রিদের এই ভবনে এর সদর দপ্তরের কার্যক্রম শুরু হয়। সেন্ট্রাল মাদ্রিদের ঐতিহাসিক আলকালা সড়কে অবস্থিত ভবনটি মূলত বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নির্মিত হয়েছিলো। ভবনটি সে আমলের গ্র্যান্ড ব্যাংক ‘ব্যাঙ্কো স্প্যানয়্যোঁল দেল রিও দে লা প্লাতা’র একটি বিশাল ভল্ট হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলো। বর্তমানে এই ভল্টের নামকরণ করা হয়েছে ‘কাহা দে লাস লেত্রাস’। যেখানে সত্যিকার অর্থেই আছে সাহিত্যের অগণিত ধন-দৌলত।
পুরোনো সিন্দুকের ১৭০০টি ড্রয়ারের মধ্যে রয়েছে নিকানোর পাররার টাইপরাইটার, হোসে সারামাগোর ফোন বুক, সঙ্গীতজ্ঞ হোয়াকিন সাবিনার একটি পশমী টুপি। ১৯০৬ সালে মেডিসিনে নোবেল পদক পাওয়া রামোন ই কাহাল-এর মেডেল। ফরাসি-মেক্সিকান সাংবাদিক এলেনা পনিয়াতৌস্কা’র বাবার ব্যবহার করা একটি ভাঙা পিতলের ব্রেসলেট। সর্বোপরি, অনেক বই, খসড়া এবং পাণ্ডুলিপি যার মধ্যে কিছু আছে অপ্রকাশিত। এটি স্প্যানিশ সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ,সংরক্ষণ এবং নথিভুক্ত করার প্রয়াসে সের্বান্তেস ইনস্টিটিউটের উদ্যোগের একটি অংশ। সের্বান্তেস ইনস্টিটিউটের পরিচালক লুইস গার্সিয়া মন্তেরো বলেছেন, “উদ্যোগটি হচ্ছে বাস্তবতার প্রতিক্রিয়া”। ” সের্বান্তেস ইনস্টিটিউটের সদর দপ্তর ভবনটি একটি আর্থিক লেনদেনের ভবন ছিল। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এখানে যখন বাংকো দেল রিও দে লা প্লাতা অবস্থিত ছিল তখন থেকে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এটি এখন সের্বাস্তেস ইনস্টিটিউটে পরিণত হয়েছে।
গার্সিয়া মন্তেরো বলেন, আমরা চেয়েছিলাম এরকম একটি স্থানের সুন্দর একটি মানে দিতে যেখানে বিশাল একটি ভল্ট আছে এবং ভাড়া করা যায় এমন সিন্দুক আছে। আমরা এই সুযোগটি গ্রহণ করেছি। আমাদের সংস্কৃতির প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা থেকে এটি করেছি। উদ্যোগে যোগদানের জন্য বিভিন প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া সত্ত্বেও সের্বান্তেস ইনস্টিটিউট আমানতকারীদের সাথে যোগাযোগ করার দায়িত্বে রয়েছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, এখানে সংরক্ষিত সকল কিছু তাদের উওরাধিকার সূত্রে মালিকদের কাছে ফিরে যাওয়ার আগে বা হেরিটেজ লাইব্রেরিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে কয়েক দশক বা এমনকি অনির্দিষ্টকালের জন্য এই ভল্টে থাকবে। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে এই ভবনের উত্তরণ প্রসঙ্গে গার্সিয়া মন্তেরো বলেন : “একটি দেশের প্রকৃত সম্পদ হল তার সংস্কৃতি। এখানে থাকা প্রতিটি বাক্স লোকেরা ভাড়া করে তাদের অর্থ, গহনা, নথিপত্র রেখে যেত। এখন আমাদের সাহিত্যের মহান ব্যক্তিত্বদের মহান নামগুলির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জায়গা হয়ে উঠেছে।”
ভারী ধাতব দরজার অন্তরালে আছে একটি দীর্ঘ দোতলা হলওয়ে। দরজাটি খুলে দিলে দেখা যাবে, বিভিন্ন আকারের ধাতব লকার দিয়ে সারিবদ্ধ দেয়াল যার মধ্যে অনেকগুলিতে বয়সের ছাপ স্পষ্ট দেখায়। অন্য লকারগুলির মধ্যে আছে পাবলো নেরুদা, বা ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কাজ। তবে আরও জাগতিক বস্তু যেমন ওয়ার্কবুক, ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফ এবং চিত্রাঙ্কন রয়েছে। কিছু সংগ্রহ এসেছে মরণোত্তর শ্রদ্ধার আকারে। যেমন সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী কলম্বিয়ান লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের জন্মস্থান আরাকাতাকা থেকে মাটির নমুনা। প্রায় ৬০টি বাক্সের মধ্যে প্রথমটি “স্মরণীয়”। গার্সিয়া মন্তেরো বলেন,”মহান ঐতিহাসিক নথিগুলো দৈনন্দিন জীবনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ,” । “আমি সাহস করে বলতে চাই যে উত্তরাধিকার হিসাবে মিগেল দে সের্বান্তেসের ‘কিহোতে দে লা মাঞ্চা’র প্রথম সংস্করণ পেতে চাই। কারণ আমাদের কাছে ইতিমধ্যেই নেব্রিহা’র স্প্যানিশ ব্যাকরণের দ্বিতীয় সংস্করণ রয়েছে৷ কিন্তু আমি আরো ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার এখানে চাই, উদাহরণস্বরূপ, হুয়ান মানুয়েল সেররাতের এমন একটা কিছু যা কবিতার সাথে তার সম্পর্ককে প্রতিফলিত করে।”
প্রিয় পাঠক, আমাদের বাংলা ভাষারও আছে সমৃদ্ধশালী ইতিহাস সংস্কৃতি শিল্প সাহিত্য যা সংরক্ষন প্রচার ও প্রসারে এখনকার সময়ের প্রেক্ষিতে এরকম সংগ্রহশালা অপরিহার্য। বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এরকম স্মারক ভান্ডার খুব দরকার। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতির এরকম ভান্ডার তৈরি করা কঠিন কিছু নয়।
তথ্যসূত্র: ইউরোনিউজ ডটকম