আমাদের মতো ছোট ছেলে মেয়েদের কাছে রোজার এক একটি দিন পার করা মানে ঈদের মহা আনন্দের দিন আরো কাছে ঘনিয়ে আসা।
ছোটবেলায় আমি পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খুব খেলতাম। খেলতাম কানামাছি এক্কা দোক্কা বউচি সাতচাড়া বরফ পানি পুতুলের বিয়ে পুতুলের জন্মদিন চুড়ুইভাতি কতরকমের খেলা! খেলার ঘোরে আমার সকাল থেকে সন্ধ্যা কাটতো। একটা সময় পর্যন্ত খেলার সাথীরা আমার কাছে ছিলো শুধুই বন্ধু শুধুই আমার মতোই মানব সন্তান। একদিন কিভাবে যেন হয়ে গেলো কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান! একদিন সকালে ঘরের মেঝেতে পাটি বিছিয়ে বাসার সবার খাবারের আয়োজন করছিলো মা আর সুধা মাসি। আর আমার মাথায় তখন চলছিলো খেলতে কখন যাবো? আমাকে তখন খেলতে যেতে দিবে না । আগে খাওয়া তারপর খেলা। কিন্তু আমার তর সইছিলো না। বাইরে খেলতে থাকা ছেলেমেয়েদের হল্লা আমাকে অস্থির করে তুলেছিলো। আমি বলেছিলাম ঠিক আছে খেলতে না হয় পরে যাবো, তাহলে পারভীনকে ডেকে নিয়ে আসি! আমার একা একা খেতে ভালো লাগে না বলে প্রায় কেঁদেই ফেললাম। মাসি সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, না পারভীনকে ডাকা যাইবো না! ওরা শেখ ওরা মুসলামান! সেই প্রথম আমি মনে হয় শুনলাম মুসলমান শব্দটি। আমি কিছুই বুঝলাম না। মুসলমান কী? আর মুসলমান হলে আমাদের সাথে খাওয়া যাবে না কেন? আমি তো ওদের সাথে কত খাই। খেলার ফাঁকে একটাকা দুইটাকা দামের আইসক্রিম আটআনা দিয়ে আচার লজেন্স কটকটি কত ভাগাভাগি করে খেয়েছি। মা বাবা তো কখনো নিষেধ করেনি। তখনও বুঝিনি গ্রাম থেকে আসা মাসি শুচিবাই আর ছোঁয়াছুয়িতে জাত চলে যাওয়ার অসুখে আক্রান্ত। মাসির এসব কথায় মা বাবার সায় না দেখতে পেয়ে আমি প্রবল উৎসাহে খেলতে চলে যাই। হিন্দু মুসলমানের বিভাজন যেন আমি তখনই ভেঙ্গে ফেলেছিলাম সারা জীবনের জন্য। কিন্তু আমার কাছে দূরের আশেপাশের অনেকে ভাঙ্গতে পারেনি। এটার জন্য তারাও দায়ী না। আমার কাছে ঈদ রোজা পূজা পহেলা বৈশাখ সব আনন্দের দিন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলো। ঈদ-উল-ফিতরের গন্ধ এসে লাগতো রমজান মাসে রোজার দিনগুলোয়। আমাদের মতো ছোট ছেলে মেয়েদের কাছে রোজার এক একটি দিন পার করা মানে ঈদের মহা আনন্দের দিন আরো কাছে ঘনিয়ে আসা। আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে ঢাকার হাইকোর্ট স্টাফ কোলনীতে। হাইকোর্টের মূলভবনের পেছনে এখন যেখানে এনেক্স ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সেখানে পুরোনো এক লিচু গাছ তলায় প্রথম বাসাটি ছিলো আমাদের। বাঁশের বেড়া আর টিনের চাল দেয়া ঘরে থাকতাম আমরা। পরে সেগুলো আধাপাকাও হয়েছিলো। ঈদ শব্দটির সাথে আমার পরিচয় ঈদ যে উৎসব এটা বোঝার আগেই খুব ছোটবেলায়। আমাদের বাসার পাশেই ছিলো হাইকোর্টের সামনের বিশাল ঈদ্গাহ ময়দান। ওইটি যে জাতীয় ঈদ নামাযের মাঠ তা আরেকটু বড় হয়ে জেনেছি। ঈদের দিন এখানে নামায পড়তে আসেন রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে দেশের অনেক গণ্যমান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগণ। সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠটির প্রান্তে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় ছিলো কিছু বড় বড় গাছ। পাম গাছসহ অনেক পুরোনো বিশালাকার আম গাছ আর একটা মাঝারি সাইজের পেয়ারা গাছ। হাঁটতে শেখার আগেই মা আমাকে ঈদ্গাহ ময়দানে খেলতে নিয়ে যেতেন । আমাকে মাঠের সবুজ ঘাসে বসিয়ে রেখে চুপ করে গাছের আড়ালে গিয়ে লুকাতেন। একটু পর টের পেতাম মা আমার পাশে নেই আমি এদিক ওদিক মাকে খুঁজতাম। যখনই কান্না জুড়ে দেবো তখনই মা ‘কুউক’ শব্দ করে গাছের আড়াল থেকে নিজের উপস্থিতি জানান দিতেন। আমি পিছন ঘুরে চেয়ে দেখতাম মা হাসছেন! কি ভালো লাগতো তখন মাকে দেখতে পেয়ে। আমিও খিলখিল করে হাসতাম। একটু বড় হয়ে ইদ্গাহ ময়দান ছিলো আমাদের প্রতিদিন বিকালের খেলার অন্যতম স্থান। ঐ পেয়ারা গাছটার মাঝখানের কান্ড থেকে বেরিয়ে যাওয়া ডালটাতে উঠে বসে আচার আর আইসক্রিম খাওয়া ছিল আমার প্রিয় কাজ। মাঠের চারপাশে কিছু কিছু জায়গায় দুই খুঁটির মাঝে লোহার শিকল দিয়ে বেড়ি করা ছিলো তখন। ঐ লোহার শিকলে বসে দোলনা বানিয়ে দোল খেতাম। আর মাঠের পাশে হাইকোর্ট মাজারের সামনের অংশে ছিলো ইমামের দাঁড়ানো স্থান। উচু বেদীর ছাদ ওয়ালা নকশা করা ঐ জায়গাটায় যে ঈদের নামাযের সময় ইমাম সাহেব দাঁড়ান তা আমাকে ছোটবেলায় কেউ বলেনি। কিন্তু সেখানে আমরা বাচ্চারা কেউ উঠতাম না। খেলার সময় কোন একদিন বড় কেউ নিষেধ করেছিলো ওখানে উঠিস না। কি কারণে মানা করেছিলো তা না জেনেই আমরা ছোটরা ঐ স্থানটাকে সম্মানের চোখে দেখতাম, জানতাম ওখানে উঠে খেলা যাবে না।
এই ঈদ্গাহে আমি প্রথম দেখেছি বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে। খুব সম্ভবত খোলা জীপে চড়ে আসতেন তিনি। তাকেসহ অন্যান্য বড় বড় লোকজনকে দেখতে আশেপাশের প্রচুর মানুষ ভীড় করতো ঈদ্গাহ ময়দানের কাছে। খুব স্পষ্ট মনে নেই বাবা আমাকেও কোলে নিয়ে ঐ ভীড়ে সামিল হয়েছিলেন দুয়েকবার। তখনো তো এখনকার মতো নিরাপত্তার এত কড়াকড়ি ছিলো না। এভাবেই খেলাধুলার দিনগুলোতে রমজান মাস আর রোজার ঈদের সাথে আমার পরিচয় ঘটে । রমজান মাস এলে আমাদের বাসার সামনে লিচুগাছ তলায় ইফতারের দোকান বসতো। আমাদের প্রতিবেশী একজন সবাই ডাকতো তানিয়ার বাপ বলে, সে ছোট ছোট পাতলা পেয়াজু ভাজতো বেগুনি আলুর চপ ছোলাও বিক্রি করত। আমরা দাঁড়িয়ে দেখতাম কিভাবে পেঁয়াজু আলুর চপ বেগুনিগুলো ফুটন্ত ডুবো তেলে বুদ্বুদ তুলে কেমন করে লালচে আর মচমচে হয়ে ওঠে। আমরা এলাকার অন্য বাচ্চারা এক টাকা দুটাকা দিয়ে সেসব কিনে ঠোংগায় করে বাসায় আনতাম। বরফের ফেরিওয়ালা আসতো তুষের কুড়া জড়ানো বরফ বিক্রি করতে। দুই বা পাঁচ টাকা দিয়ে এক খন্ড বরফ এনে বালতিতে খাবার জলে রাখতেন বাবা। আমি খেলাধূলা করে মাগরিবের সময় হয়রান হয়ে ঘরে ফিরতাম। বাবা তখন ধূপ ধুনো দেয়ার আয়োজন করছেন। আমাকে স্টিলের মগে ঠান্ডা জল খেতে দিতেন। আমি তো অবাক! কি যে ভালো লাগতো সে ঠান্ডা জল। তারপর আমি বাবা মা আর আমার ছোট ভাইটির মনে হয় তখনো জন্ম হয়েছে কি হয়নি কিংবা খুব ছোট আমরা একসঙ্গে গোল হয়ে বসতাম ইফতার খেতে। সেই তানিয়াদের দোকানের পিঁয়াজু ছোলাবুট চপ দিয়ে মাখানো গামলা ভর্তি মুড়ি। মা পেঁয়াজ মরিচ ধনেপাতা কুচি আর সর্ষে তেল যোগ করতেন। কখনো সেই মুড়ি মাখাতে জিলাপির টুকরো পেয়ে অবাক হতাম। বাবা হয়তো আনন্দ বাজার থেকে বাজার করে ফেরার সময় কিছু জিলাপিও এনেছেন। সেই জিলাপি মুড়ি মাখায় যোগ হয়ে তার স্বাদ বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুণ। মাঝেমধ্যে বান্ধবী আজমেরি আর আয়শা আফরোজা খালাম্মারা ইফতার সাজানো থালা নিয়ে আসতো আমাদের বাসায়।সাতাশ রোজার দিনে প্রতিবেশি বিপ্লবী পল্লবী সুরভী আন্টিদের বাসায় ইফতারের দাওয়াত পেতাম।অন্যান্য বাচ্চাদের সংগে আমিও মেঝেতে বসে ইফতার করতাম।ওদের দেখাদেখি আযানের সময় আমিও মাথায় কাপড় দিতাম।বাড়তি কাপড় বা ওড়না সাথে না থাকলে ওদের মতো আযান দিলে মাথায় তিনটা টোকা বা বাড়ি দিতাম। ছোট যে মেয়েরা ওড়না পড়তাম না তারা এমন করতাম। একদিন আমি ঠিক করলাম রোজা রাখব। অন্য বন্ধুদের মতো সারাদিন জল খাবার কিছুই খাবো না৷ যেহেতু আমাদের বাসায় ইফতার বানায় না তাই সারাদিনের সব খাবারগুলো জমিয়ে রাখবো। ইফতারের সময় খাবো। আমার কথা শুনে বাবা মা হাসতেন। সেহরির সময়ও আমি দুয়েকদিন ঘুম থেকে উঠে যেতাম। মনু খালা আর তারা মিয়ার বাসায় গিয়ে দেখতাম কেরোসিনের স্টোভে মাছের ঝোল গরম করছেন উনারা। আমাকেও একটা প্লেটে ভাত আর মাছের ঝোল তুলে দিতেন খেতে। ইফতারের আইটেমগুলো আমাদের বাসায় কখনো খুব একটা বানানো হতো না৷ সকাল থেকে বিকাল সরকারী চাকরি করে বাড়তি রান্নাবান্নার সময় পেতেন না বাবা মা। বেশিরভাগ সময় বাইরে থেকে কিনেই খেতাম। প্রেসক্লাবের সামনে বিএমএ ভবনের নিচে ইফতারের দোকান থেকে কিনে নিয়ে আসতেন বাবা। সেসময় হুইসেল বাজিয়ে জানানো হতো ইফতার সেহরির সময়। ঐ সময় রুহ আফজা কি জিনিস আমি চিনতাম না। ব্রিটিশ ভারতের গাজিয়াবাদের রুহ আফজাকে প্রথম চিনি যখন সাদাকালো টিভিতে এর বিজ্ঞাপন দেখি তখন থেকে। হাইকোর্ট থেকে চলে আসার পরে অনেক দিন এজিবি কোলনী আর পুরান ঢাকায় থেকেছিলাম। চকবাজার, লালবাগ,নাজিমুদ্দিন রোড, বকশী বাজার, হোসেনী দালান,নাজিরাবাজার, লক্ষীবাজার। তখন যে কত রকমের ইফতার আইটেম দেখেছি খেয়েছি তা বলে শেষ করা যাবে না। শুধু গরুর মাংস থাকতে পারে এমন আইটেম বাদে অন্যান্য সব আইটেম আনা হতো বাসায়। পুরান ঢাকার ইফতার মানেই বৈচিত্র্যে ভরা। হরেক রকম কাবাব চপ কাটলেট নানরুটি পরোটা গ্লাসি বিরিয়ানী কাচ্চি ফালুদা বিভিন্ন ডিজাইনের জিলাপী হালিম শরবত ও লাচ্ছি।
পুরান ঢাকায় যখন থাকতাম চকবাজারের ইফতার কিনে ব্যাগ ভর্তি করে মাঝেমধ্যে বাসায় পাঠিয়ে দিতো অজানা কেউ। দারোয়ান চাচাকে জিজ্ঞেস করে একপ্রকার তদন্ত করেই বের করতাম ইফতার পাঠিয়েছে পাশের বাড়ির বুলবুল নয়তো জিতু কিংবা পিয়াশ। এই গোপন গুণগ্রাহীদের পাঠানো ইফতার আমাকে চমৎকৃত করতো একইসঙ্গে বিব্রতও হতাম। মাকে বলতাম রায়সাহেব বাজারের বান্ধবী লায়লার বাসা থেকে এসেছে নয়তো হোসেনী দালানের আমিনারা পাঠিয়েছে। ঐ ইফতার ভর্তি ব্যাগের মধ্যে থাকতো বড়সর আস্ত তরমুজ বাঙ্গি পেঁপে কলা আপেল এসব ফল কেজি খানেক জিলাপী, দইবড়া, বড় মাটির বাটিতে হালিম আর ফালুদা কখনো বিরিয়ানীর প্যাকেট ইত্যাদি। তবে ওরা কখনো গরুর মাংসের কোন আইটেম আমাদের বাসায় পাঠাতো না। ঢাকাইয়া ছেলেদের মনটা যে ওদের পাঠানো ইফতারের মতো বড় তখনই বুঝেছিলাম। ইফতারের আগে যখন লেবু শসা তরমুজ বাংগি এসব কাটা হয় তখন যে ঘ্রাণটা আসে ঠিক একই ঘ্রাণ আসে পূজোর আগে ভোগের ফল কাটার সময়। বড় হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে রাস্তার মাঝখানে চত্বরে বসে পেপার বিছিয়ে মুড়ি মাখিয়ে ইফতার করেছি। হাইকোর্টের তৈয়ব আংকেল আমাদের বাসায় নিয়ে আসতেন একেকদিন এক একটা আইটেম। কোন খাবারটা কোন জায়গার কোনটা ভালো,খেতে কেমন ইত্যাদি নিয়ে গল্প হতো। দিদিমণিকে দেখতাম একাদশী উপবাসের পর শুধু দুধ জল সাবু আর ফল খেতে। আর অন্য কোন ধরনের খাবার থাকতো না। সে তুলনায় ইফতার যেন রাজা মহারাজাদের ভোজ। এজিবি কলনিতে থাকাকালীন সেহরির সময় কলনির ছেলেদের দেখতাম দল বেধে কাসিদা গাইতে। নানারকম জিনিসপত্র ব্যবহার করে শব্দ করে সুরেলা কন্ঠে গান ধরে সবাইকে জাগিয়ে তুলতো। চাঁদরাতে বকশিস নিতে এমনকি আমাদের বাসাতেও চলে আসতো ওরা। আমরা খুশি মনে যা দিতাম তাই নিয়ে যেতো। গ্রামের ইফতার সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই আমার। একবার এক রমজান মাসে আমি আর বান্ধবী আজমেরি দুজনে মিলে নরসিংদীর হাতিরদিয়া গেছি সুধামাসির বাড়ি বেড়াতে। একদিন বিকালে গ্রামের বাজার থেকে ইফতারের আইটেম কিনে আনি। ঠোংগা ভর্তি ছোট ছোট পিঁয়াজু আলুর চপ ছোলাবুট মাখা আর জিলাপি। মাসী আমাদের এক গামলা মুড়ি আর সর্ষের তেল দিলেন। মাসী পেঁয়াজ রসুন খান না তাই পেঁয়াজ দিতে পারলেন না। কিন্তু মাসীর বাড়িতে লোকনাথ বাবার আশ্রমের পাশের ঘরের সামনে ছিল বোম্বাই মরিচের গাছ। সেখান থেকে একটা ছোট পাকা বোম্বাই মরিচ তুলে ভালো করে ডলে দিলাম মুড়ি মাখায়। সেই স্বাদ আজ পর্যন্ত আর পাইনি। এখনকার ইফতার মানে ফ্রুটস, জুস, সফট ড্রিংক,স্পাইসি স্ন্যাকস, ফ্রাইস আর ডেজার্টস। আমাদের সময় ইফতার ছিলো এমনই। রমজান ফুরিয়ে আসতো চাঁদ রাত। তার আগে চলতো ঈদের নতুন জামা কেনার পালা। বন্ধুদের দেখতাম ঈদের নতুন জামাটি লুকিয়ে রাখতে, কিছুতেই দেখাবে না। আমার কাছে কি রহস্যময়ই না মনে হতো ঈদের নতুন জামাকে তখন। চাঁদ রাতে পাড়ার মেহেদী গাছগুলো শূন্য হয়ে যেতো। শীল পাটায় বেটে হাতে মেহেদী দেওয়ার ধুম পড়তো। আমিও পাড়ার বড় মেয়েদের মেহেদী পাতা তুলে সাহায্য করার বিনিময়ে অল্প কিছু মেহেদী পাতা পেতাম ভাগে। সেগুলো আমার দিদিমণি পাটায় বেটে হাতে লাগিয়ে দিতেন। সেসময় মেহেদী নকশা বলতে সেই হাতের তালুর মাঝখানে গোল করে দেওয়া আর পাঁচ আঙ্গুলের মাথায় দেওয়া। কখনো কাঠি দিয়ে হাতের তালুতে চিকন ছোট ছোট ফুলের নকশা এঁকে দিতেন দিদিমণি আমাকে। আমার কি যে আনন্দ হতো তখন! প্রথমে হালকা কমলা তারপর গাঢ় লাল কমলায় পরিণত হতো মেহেদীর রং। যার হাতের মেহেদীর রঙ যত বেশি গাঢ় তার বর নাকি তত বেশি আদর করবে! এরকম কথাবার্তা বলাবলি করতো পাড়ার মেয়েরা। আমি কি তখন আড়চোখে তাকাতাম আমার মেহেদী রাঙ্গানো হাতের দিকে? মনে নেই।
চাঁদ রাত পেরুলেই কাঙ্ক্ষিত ঈদ সকাল। সেসময়ের ঈদ ছিলো নানা রঙ্গে ঝলসানো একটি আনন্দের দিন। ঈদের পাড়ায় বেড়াতে বের হলেই চারদিকে কেবলই নতুন চকচকে রংবেরঙের জামা পড়া ছেলেমেয়েদের দল। কি যে ভালো লাগতো আমার সেই দৃশ্য। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম সারা বছর ময়লা পুরোনো জামা পড়া যে বন্ধুদের সঙ্গে আমি খেলতাম ঈদের দিন ওদের চেহারাটা কিভাবে বদলে যায়? সারা বছর নাক দিয়ে সর্দি ঝরা ধূলা ময়লা মাখানো রাসেলকে কেমন পরিচ্ছন্ন আর পরিপাটি দেখায়। গোসল করে মাথায় তেল চিরুনী দিয়ে আঁচড়ানো চুল আর নতুন জামায় রাসেলকে দেখতে কি ভালো লাগে। অন্যদিকে পাড়ার বড় মেয়েদের মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা চলে কার জামা কত চটকদার, কত দাম আর কোন মার্কেট থেকে কেনা হয়েছে এইসবের। মার্কেট বলতে আমি জানতাম কেবল কয়েকটা নাম: চাঁদনী চক, গাউছিয়া, নিউ মার্কেট, মৌচাক আর বংগবাজার। পরে যোগ হয়েছিল ইস্টার্ন প্লাজা। আমারও খুব ইচ্ছে করতো ঈদে মা যেন আমাকে এইসব মার্কেট থেকে নতুন জামা কিনে দেন। মা দিতেন, তবে দূর্গাপূজায়। ঈদের দিন অবশ্য মা আমাকে আলমারিতে তুলে রাখা ভালো একটা জামা বের করে পড়িয়ে দিতেন। আমার যাতে মন খারাপ না হয়। কিন্তু মন আমার খারাপ হতোই। আর যাই হোক ওটাতো আর বন্ধুদের মতো নতুন জামা নয়। কিন্তু পূজার সময় কিনে নতুন জামায় আমি ঈদের মতো আনন্দ পেতাম না। এর কারণ সম্ভবত সারা পাড়ায় হাতেগোনা মাত্র কয়েক ঘর হিন্দু, তাও আবার পূজোয় অনেকে গ্রামের বাড়ি চলে যেতো। পূজার দিনগুলোতে বাইরে বেরুলে ঈদের মতো নতুন জামা পড়া ছেলে মেয়েদের খুব একটা দেখা যেতো না। তবে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বা তাঁতিবাজার গেলে দেখা পেতাম অনেকের কিন্তু ওরা তো আমার খেলার সাথী নয়। ঈদের দুপুরে বন্ধুদের বাসায় পোলাও কোর্মা রান্না হতো। সেই সুবাসে পুরো এলাকা ম ম করতো। সকালে সব ঘরেই থাকতো সেমাই। বিকালে নুডলস আর চটপটি। আমার নিমন্ত্রণ থাকতো পাড়ার সব ঘরেই। এদিন যে বাসাতেই যেতাম সবাই ডাকাডাকি সাধাসাধি করতো সেমাই খেয়ে যাওয়ার। কিন্তু বাসা থেকে নিষেধ করা ছিলো যেন ভাত মাংস এসব না খাই। কারণ গরুর মাংস থাকতে পারে কিংবা গরুর মাংসের ছোঁয়া থাকার সম্ভাবনা আছে। ব্রাহ্মণ হওয়ার কারণে মা বাবা গরুর মাংসের ছোঁয়া বরাবর এড়িয়ে চলতেন। এমনকি আমাদের বাসাতেও একসময় মাংসের মতো আমিষ রান্না হতো খুবই কম। কোরবানীর ঈদে আমার ঘর থেকে বের হওয়া এক প্রকার নিষেধ ছিলো। গরুর মাংস রক্ত গরুর বর্জ্য এসবের ছড়াছড়ি থাকতো কলোনি জুড়ে। ছোঁয়া লাগা কিংবা চোখে দেখে ফেলার আংশকা থাকায় গৃহবন্দি হয়ে কাটতো আমার কোরবানীর ঈদ। ছোট বেলাটা আমার কেটেছে এক প্রকার মাংসহীন ভাবেই। এমনকি বাইরের ফাস্টফুড জাতীয় খাবারও এই ভয়ে চেখে দেখা হতো না। রোজার ঈদে কিন্তু এই ভয়টা তেমন ছিল না। ঈদের দিন আইসক্রিম খাওয়ার ব্যাপারে কোন নিষেধ ছিলো না। ছিল বরং উদারতা। অন্যসময় আমরা ঘন্টা বাজিয়ে সাইকেল গাড়িতে আইসক্রিমের বাক্স নিয়ে আসা আইসক্রিমওয়ালার কাছ থেকে দুটাকা দিয়ে লেমন ললি বা পাইপ আইসক্রিম কিনতাম আর পাঁচ টাকা দিয়ে চকবার। কিন্তু ঈদের দিন বিকালে দল বেঁধে আমরা যেতাম সেই প্রেস ক্লাবের বিপরীতে বিএমএ ভবনের নিচের তলার আইসক্রিমের দোকানে। যেখানে কোণ আইসক্রিম বিক্রি করা হতো। কিন্তু বাসা থেকে নিয়ম করা ছিলো কিছুতেই মাগরিবের আযানের পরে আসা যাবে না, ফিরতে হবে তার আগেই। না হলে কপালে আছে মার আর বকা। কিন্তু যেহেতু ঈদের দিন তাই সে মার আর বকাগুলো তোলা থাকবে, পরের দিন দেওয়া হবে। ঈদের দিন তাই অপার আনন্দের। একটু বড় হয়ে দেখতাম বন্ধুরা ঈদের দিন একটু দূরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে হাইকোর্টের পাশে শিশুপার্ক জাদুঘর কিংবা রমনায় নয়। ওরা যাচ্ছে সংসদ ভবনে বেড়াতে। কিন্তু মা আমাকে যেতে দিতেন না অতদূরে। আমি মন খারাপ করে ঈদের দুপুরে বিটিভিতে সিনেমা দেখতাম সন্ধ্যায় ছায়াছন্দ আর রাতে দেখতাম আনন্দমেলা। একটু বড়বেলার ঈদ অন্যরকম আনন্দ হয়ে ধরা দিতে থাকে। কিছুটা স্বাধীনতা খানিকটা বন্যতা আর একটু খানি অবাধ্যপনার আনন্দ এনে দেয় ঈদ। বন্ধুদের সঙ্গে গাড়িতে করে অথবা বাইকে চড়ে ফাঁকা ঢাকা শহর চষে বেড়ানো। গাজীপুর আশুলিয়ার অদেখা কোথাও হারিয়ে যাওয়া। আর অবশ্যই বাবা মায়ের শত চোখ রাঙানী উপেক্ষা করে মাগরিবের পরে বাসায় ফেরা।
আমার কাছে এটাই ছিল বাংলাদেশের সংস্কৃতি,যেখানে মৈত্রী ও মমতার বিস্তার। বিভেদের কথা আমাদের উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আজকের মতো এতটা তীব্র ছিল না। আর ছিল না বলেই মনে হতো এই ঈদ তো আমারও।